—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অভিনব উপায়ে সম্মান জানানোর কথা দীর্ঘ দিন ধরেই পরিকল্পনা করে আসছেন অরুন্ধতী দেব। এ বার তাঁরই উদ্যোগে ‘সঙ্গীত ভারতী মুক্তধারা’ রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে এমন এক সঙ্গীতানুষ্ঠান উপহার দিল, যা অত্যন্ত অভিনব। এই প্রথম বার সারা দেশ জুড়ে মোট ১১টি রাজ্যে একই সময়ে, একই সঙ্গে সহস্রাধিক কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিল্পী। কলামন্দিরের মঞ্চে শতকণ্ঠে রবীন্দ্রগানে মুখরিত হল এক রবিবারের সকাল। উদ্বোধনী সঙ্গীত থেকে শুরু করে শেষ গানটি পর্যন্ত প্রায় দেড় ঘণ্টা সটান দাঁড়িয়ে থেকে শিল্পীদের পরিচালনা করে গেলেন প্রবীণ শিক্ষয়িত্রী অরুন্ধতী। তাঁর সঞ্চালনায় একশোজনের কণ্ঠে ‘অন্তর মম বিকশিত কর’ থেকে ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ পর্যন্ত ‘উন্মেষ’ শীর্ষক গানমালা পরিবেশিত হল নিরবচ্ছিন্ন ভাবে। সৌরভ চক্রবর্তীর সুচিন্তিত যন্ত্রানুষঙ্গ রচনা ও পরিচালনায় ট্র্যাকের সঙ্গে সমলয়ে সঙ্গীত পরিবেশন করলেন শিল্পীরা। একই সঙ্গে মঞ্চে রাখা একটি পর্দায় ভেসে উঠছিল বাকি রাজ্যগুলির শিল্পীদের সঙ্গীতানুষ্ঠানের ভিডিয়ো। শুনতে শুনতে বেশ বোঝা যাচ্ছিল, দীর্ঘ দিনের মহড়া, অধ্যবসায় ও পরিশ্রম রয়েছে এমন এক অনুষ্ঠানের নেপথ্যে।
তবে এই প্রথম নয়, অরুন্ধতী দেব দীর্ঘ দিন ধরেই সমবেত কণ্ঠে রবীন্দ্রগানের পরিবেশনায় নিরলস ব্রতী। গীতবিতান প্রকাশনার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে সহস্রকণ্ঠে রবীন্দ্রগান পরিবেশন করা যায় কি না, এমন এক ভাবনা দীর্ঘ দিন ধরেই লালন করছিলেন তিনি। ইউরোপ ভ্রমণকালে সেখানকার কয়্যারের পরিবেশনা মুগ্ধ করেছিল রবীন্দ্রনাথকে। সহস্রকণ্ঠে সমবেত সঙ্গীত ও তার যন্ত্রানুষঙ্গের মূর্ছনা তাঁর স্মৃতিচারণে ফিরে আসত বারংবার। কবির এই ভাললাগার জায়গাটিকে পাথেয় করেই তাঁকে জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানানো যায় কি না, পরিকল্পনা করেছিলেন অরুন্ধতী। সেখান থেকেই তাঁর হাজার কণ্ঠের সমাহারে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনার ভাবনা। শুধু এই শহর বা রাজ্যের নয়, এক হাজার শিল্পীর খোঁজে ভিনরাজ্য ও বাংলাদেশের শিল্পীদেরও সংযুক্তির কথা ভেবেছিলেন তিনি। ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো/সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো’... কবিসৃষ্ট সম্মেলনের এই মূল সুরটি ধরেই এমন উদ্যোগ। একে একে এতে যুক্ত হয় মফস্সলের কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যারা দীর্ঘ দিন ধরে নিষ্ঠাভরে রবীন্দ্রগানের চর্চা করে আসছে। বাংলাদেশের রবীন্দ্রগোষ্ঠী ‘ছায়ানট’ও সাগ্রহ এগিয়ে এসেছিল। ‘মুক্তধারা’র শুরুটা ঠিক এখান থেকেই হয়েছিল। নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে ২০০৭ সালে পরিবেশিত হয়েছিল সহস্রকণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুষ্ঠান ‘বিশ্বমনাঃ রবীন্দ্রনাথ’, দেশে প্রথম বার।
এর পর থেকেই বিভিন্ন আঙ্গিকে এই অনুষ্ঠান পরিবেশিত হতে শুরু করল। ক্রমে বাংলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ল তা। এ বছর প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে এক হাজার শিল্পীকে দিয়ে একসঙ্গে গাওয়ানো হল অভিনব পন্থায়। এক ছাদের তলায় নয়, দেশের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্ত থেকে শিল্পীরা একযোগে অংশ নিলেন একই অনুষ্ঠানে। তাঁদের লাইভ পারফরম্যান্সের পাশে চলতে থাকল ভিনরাজ্যের অনুষ্ঠানের ভিডিয়ো। এ রাজ্য-সহ দেশের মোট ১১টি রাজ্যের মোট ১১০০ জন শিল্পী অংশ নিলেন একযোগে। ১৬৩ তম রবীন্দ্রজয়ন্তীতে এমন অভিনব সঙ্গীতানুষ্ঠানের সাক্ষী থাকল শহর কলকাতা।
যাঁরা এই অনুষ্ঠানের প্রশিক্ষণ ও মহড়ার দায়িত্বে ছিলেন, শাসন ও স্নেহে গড়েপিটে নিয়েছেন এতজন শিল্পীকে, সেই শিক্ষকরাও এ দিন গাইলেন অনুষ্ঠানের প্রথম সারিতে বসে। অনিতা মুখোপাধ্যায়, শমিতা মুখোপাধ্যায়, সীমা তরফদার, অরীন চট্টোপাধ্যায়, সুচন্দ্রা মৈত্র, সঙ্ঘমিত্রা সরকার, কাকলি দাস বিশ্বাস, রুমা ভট্টাচার্যের পাশাপাশি অরুন্ধতী নিজেও ছিলেন এ দায়িত্বে। গানগুলির চয়ন, বিন্যাসে পরিকল্পিত ভাবনাচিন্তার ছাপ পাওয়া যায়। মূল সুরটি ছিল ‘উন্মেষ’, তাই পর পর গানগুলি এমন ভাবে সাজানো হয়েছিল, যাতে নিজের অন্তরে আলোর সন্ধান, আত্মানুসন্ধান, সৃষ্টিকর্তার প্রতি সমর্পণ উঠে এল গানে গানে। শেষের দিকে গানগুলিতে জয়ধ্বনির সুর অনুষ্ঠানকে উন্নীত করেছিল এক অন্য পর্যায়ে। যন্ত্রানুষঙ্গ সৃজিত হয়েছিল সনাতন রবীন্দ্রগানের ধারা মেনে। সৌরভ চক্রবর্তী তাঁর ট্র্যাকগুলিতে ন্যূনতম যন্ত্র-সঙ্গতে রবীন্দ্রনাথের গানের মেজাজ অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। গৌরী গ্রামোর ধ্বনি প্রক্ষেপণ ও চন্দন মল্লিকের ব্যবস্থাপনায় সামগ্রিক ভাবে অনুষ্ঠানটি মনোজ্ঞ হয়ে উঠেছিল এ দিন। অনুষ্ঠান শেষে অরুন্ধতী বলছিলেন তাঁর এই পরিকল্পনার নেপথ্যকথা, যেখানে উঠে এল সংযুক্তির মূল মন্ত্র। বাংলার বাইরে এমন উদ্যোগকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিশেষ ভাবে সাধুবাদ প্রাপ্য তাঁর ও অনুষ্ঠানে জড়িত সকল শিল্পীর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy