বিমূর্ত: দেবভাষা গ্যালারিতে শিল্পী যোগেন চৌধুরীর চিত্রকর্ম
দেবভাষা গ্যালারিতে তাঁর ৮৫তম জন্মদিন উপলক্ষে যে প্রদর্শনীর উপস্থাপন করা হয়েছে, সেটি চলবে আরও এক বছর, তাঁর ৮৬তম জন্মদিন পর্যন্ত। যে ২২টি ছবি এখানে দেখা যাচ্ছে, সেগুলি প্রত্যেক মাসেই পাল্টে যাবে। নতুন আরও ছবি এঁকে দেবেন শিল্পী। এ এক অভিনব অভিজ্ঞতা। এ ছাড়াও ওখানে রাখা আছে একটি লম্বা ক্যানভাস… একদিকের দেওয়ালজোড়া। সেখানে প্রত্যেক মাসে শিল্পী নিজের সুবিধে মতো রঙে-রেখায়, আপন খেয়ালে কাজ করবেন এবং যখন তাঁর ৮৬তম জন্মদিন উদ্যাপিত হবে ২০২৪-এ, তখন সেই ছবি সম্পূর্ণতা প্রাপ্ত হবে। শিল্পীর নাম যোগেন চৌধুরী।
তাঁর ছোটবেলা কেটেছে বাংলাদেশের ফরিদপুরে। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ছিল। জমিদারি ছিল বলা যেতে পারে। শিল্পী ছোটবেলায় তখনকার পূর্ববঙ্গের গ্রামে কুমোরদের মাটির মূর্তি গড়া দেখেছেন। ঠাকুরের মূর্তি গড়ার পরে একেবারে শেষে কুমোর যখন দেবীর চক্ষুদান করতেন, অবাক বিস্ময়ে বালক যোগেন সেটা দেখতেন এবং তা থেকে চরম আনন্দদায়ক এক অনুভূতি ওঁর হত, যা উনি কোনও দিন ভুলতে পারেননি। সেই কারণেই হয়তো নারীমূর্তিকে সেই ভাবে ভাঙেননি কখনওই। কিন্তু ওই মূর্তি গড়া দেখার সময়ে হয়তো যৌনচেতনারও উন্মেষ ঘটেছিল বালকমনে, যে কারণে নারীর সুডৌল স্তন, কিছুটা মূর্তিতে যে রকম থাকে, ওঁর ছবিতে ফিরে ফিরে এসেছে।
সেই ছোটবেলায় জমিদারবাড়ি সংলগ্ন দিঘিতে মাছ ধরা, পুজোর সময়ে মূর্তি গড়া, চণ্ডীমণ্ডপের পাশে রাসযাত্রা, রামায়ণ-মহাভারতের গল্পের নাটক এবং অন্যান্য পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে যাত্রা… এই সবের মধ্যেই মাখামাখি করে বড় হওয়া। গ্রামীণ জীবনের রূপ-রস-গন্ধে ভরপুর একটা মন নিয়ে আট-ন’ বছরের ছেলেটি কলকাতায় চলে এসেছিল।
ছাত্রাবস্থায় কলকাতায় আর্ট কলেজের নীচে মিউজ়িয়ামে, যেখানে ছাত্ররা স্কেচ করত, সেখানে দক্ষিণের ঘরে এক ধ্যানরত বুদ্ধমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে মূর্তির প্রবল শক্তি উনি অনুভব করতে পারেন। পরবর্তী কালে পড়াশোনা করতে করতে বিজ্ঞানে পড়েছেন, সমস্ত জৈব বস্তুর মধ্যেই অণু-পরমাণু আছে এবং সেই একই কথার উল্লেখ উপনিষদেও আছে। সব জৈব বস্তুর মধ্যেই যে প্রাণশক্তির উল্লেখ আছে, সেই সত্যিটা উনি বুঝে ফেলেন খুব অল্প বয়সেই। সেই থেকেই নারী-পুরুষ, লতাপাতা, গাছ, ফল, ফুল সমস্ত কিছুর মধ্যেই প্রাণের সাড়া পান যোগেন। 'ও চাঁপা, ও করবী, তোরা উতলা হলি আজ কারে দেখে'... এই মূলমন্ত্রই যেন তাঁকে নিজেকে খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে। যার ফলে লতাপাতা আঁকার সময়ে তার ভিতরেও মানুষের সব অনুভূতির স্পর্শ পেয়েছেন। আবার মানুষকে যখন সামনে থেকে দেখেছেন, তাদের নানা ভঙ্গিতে গাছ, লতাপাতা, ফলফুল এই সবেরই চেহারা দেখেছেন, প্রাণের স্পর্শ পেয়েছেন। প্রদর্শনীর একটি ছবিতে আমরা দেখি ফুলগাছ লতিয়ে উঠেছে। উপরে ফুল এবং সুন্দর পাতার বিন্যাস কিন্তু নীচের অংশে যেন এক নারীমূর্তি। এক হাত মাথার উপরে তুলে বসে আছে। সম্পূর্ণ এক বিমূর্ত ছবি। কিন্তু লতাপাতার মধ্যে রমণীভাব নিশ্চিত ভাবে অনুভূত হয়।
বাস্তবধর্মী ড্রয়িংয়ের হাত ছোটবেলা থেকেই খুব নিখুঁত ছিল যোগেনের। সেই কারণেই হয়তো আর্ট কলেজে খুব ভাল রেজ়াল্ট করা সত্ত্বেও সব সময়েই নিজেকে প্রকাশ করার অন্য একটা ভাষা খুঁজেছেন। দু’বছর ইউরোপে কাটানোর পরে ফিরে আরও অস্থিরতা বেড়েছে। ইউরোপীয় মাস্টারদের অনুকরণ নয়। দেশের সাধারণ মানুষের কথা, তাদের গল্প বলতে হবে নিজস্বতা দিয়ে, আধুনিক এক ভাষায়। তার পর খোঁজাখুঁজি করতে করতে পড়াশোনা করে মনের একেবারে গভীরে ডুবে গিয়ে পেলেন সেই রত্ন… নিজের এক অনন্য ভাষা।
প্রদর্শনীতে একটি সাধারণ পুরুষ চরিত্রের দেখা মিলল। কালো পেনসিলের এক টানে আঁকা। সে যেন মুখ হাঁ করে কিছু দেখছে বা শুনছে। চোখের ভাবে পূর্ণ মনোযোগ। তিনটি দাঁত বেরিয়ে আছে। এর বেশি কিছু করার দরকার বোধ করেননি শিল্পী। চমৎকার অভিব্যক্তি।
কুমোরদের সঙ্গে মাটিতে হাত লাগিয়ে কাজ করেছেন বলেই হয়তো তাঁর ছবিতে আমরা শুধুমাত্র ড্রয়িং দেখি না। দেখি এক আশ্চর্য থ্রি-ডায়মেনশনাল ব্যাপার। প্রায় সব ড্রয়িংয়েই ওজন অনুভব করা যায়। নারী-পুরুষেরা যেন মাটি কামড়ে থাকে। আঙ্গিকের নান্দনিক উপাদানগুলো রেখেই বিমূর্তকরণ করেছেন। শিল্পী বলছেন, ‘‘যা গুণগতভাবে প্রাণবন্ত তা এই বিমূর্ততার স্পর্শ ছাড়া কিছুতেই মূর্ত হয়ে ওঠে না।’’
আর একটি ছবি এক পাখির। সেটি হাঁস বলেই মনে হয়। কিন্তু ও তো জীবন্ত। ওর চোখ মানুষের চেয়েও সজাগ। পায়ে যেন জন্ম জন্মান্তরের মাটি কামড়ে বেঁচে থাকার বাসনা। সারভাইভাল ইন্সটিংক্ট ওর সর্বাঙ্গে। ওর ডানায় পালকের আভাস, না কি নেহাতই একটা ডিজ়াইন, যেটা খানিকটা মাছ ধরার জালের মতো? মাছ ধরতে গিয়ে ওই জালে আটকা পড়ার আশঙ্কা কি ওই চোখে? সামান্য ক'টা রেখার ছবি কত ভাবায়। এই ছবিটিতে ভলিউম বা আয়তনের আন্দাজ (যেটি যোগেন চৌধুরীর লাইন ড্রয়িংয়ের বিশেষত্ব), সেটি ধরতে পারা যায়।
এ বার আসা যাক একটি মেয়ের মুখের কথায়। ওই চোখে কি সেই ছেলেবেলার দুর্গাপ্রতিমার ছায়া? না কি নেহাতই মনের অবচেতন থেকে উঠে আসা একটি মুখ? হয়তো বারবণিতার অবয়ব। সেজেগুজে অপেক্ষারত, একটি মানুষের জন্য? শিল্পী যোগেন চৌধুরীর প্রত্যেকটি মুখের এবং শরীরের অভিব্যক্তি বা এক্সপ্রেশন অনেক কথা ভাবতে বাধ্য করে।
আর একটি নারীমূর্তির কথাও বলা যাক। মুখ ফিরিয়ে রেখেছে সে। মিশ্র মাধ্যমের কাজ। হাতের আঙুলগুলিতে সেই লতাপাতার ভাষা কিন্তু লতাপাতার কোমলতা নেই। মহিলা কাউকে প্রত্যাখ্যান করতে চাইছে। চোখে উষ্ণতা নেই। ঠান্ডা, ফিরিয়ে নেওয়া চোখ। ওই ঘোরানো হাতের কব্জি যেন নৃত্যশিল্পীর!
অন্য একটি ছবিতে একটি মেয়ের পার্শ্বমুখ। চুল উঁচু করে বাঁধা। সে সংযমের পরাকাষ্ঠা। আড়চোখে কিছু দেখছে। একটু যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এটিও মিশ্র মাধ্যমে করা। আরও একটি ছবিতে নারীর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। রহস্যময়ী এক কন্যা। এর চোখে একটু বেদনার ছায়া, একটু প্রত্যাশার আলো, ঠোঁটে হাসির আভাস। সব মিলিয়ে এই মেয়েটিকে জানতে ইচ্ছে করে। ঠিক এইভাবেই শিল্পী যোগেন চৌধুরীর ছবি অনেক কথা বলে। প্রত্যেকটি ছবিতেই গল্প আছে। ভাবার সুযোগ দেয়।
সবচেয়ে বড় যে ব্যাপারটা দেখা গেল, সেটা হচ্ছে এই প্রদর্শনীর প্রত্যেকটি কাজ তুলি, পেনসিল বা কলমের এক টানে করা। কাগজে কলম রেখে সেটা টেনে নিয়ে গিয়েছেন এঁকেবেঁকে নানা ভাবে যতক্ষণ ওই কাজ শেষ না হয়েছে। ছবি কতটা আয়ত্তে থাকলে বা প্রাণের কোন উৎস থেকে বেরোলে সেটা সম্ভব, জানা নেই।
শমিতা বসু
a
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy