Advertisement
০১ জুন ২০২৪

কবীরনামা

মৃত্যুমুখ থেকে ফিরেছেন বারবার। আত্মাকে বলতেন হাঁস। কবীর-প্রেমে মজেছেন কবিগুরুও। লিখছেন নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কেউ ভাবেন তিনি বৈষ্ণব, কেউ বলেন তিনি শৈব নাথ-যোগী পরম্পরার, কেউ ডাকেন সুফি! কারও মতে তিনি যত না কবি, তার চেয়ে বেশি তিনি কবীর।সমাজসংস্কারক।

শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৬ ০০:০৫
Share: Save:

কেউ ভাবেন তিনি বৈষ্ণব, কেউ বলেন তিনি শৈব নাথ-যোগী পরম্পরার, কেউ ডাকেন সুফি!

কারও মতে তিনি যত না কবি, তার চেয়ে বেশি সমাজসংস্কারক।

তিনি কবীর।

তাঁর ধর্ম, তাঁর পরিচয় নিয়ে যেমন ধোঁয়াশা, তেমনই তাঁর জন্মকাল নিয়েও। এমনকী তাঁর আবির্ভাব ঘিরেও গল্পের যেন শেষ নেই।

তেমন গল্প দিয়েই না হয়, শুরু হোক কবীর-কাহিনি।

ধ্বংস নেই আমার, কবীর আমি

স্বামীহারা এক ব্রাহ্মণের মেয়ে বাবার সঙ্গে গেল প্রখ্যাত এক সাধকের কাছে।

তাঁদের ভক্তি দেখে সেই সন্ন্যাসী চাইলেন মেয়েটির একটি পুত্রলাভ হোক। অচিরেই বিধবা মেয়েটির পুত্রসন্তান হল।

কিন্তু বিধবার আবার সন্তানলাভ কী?

লজ্জা আর গুঞ্জন এড়াতে দুধের শিশুকে ফেলে রেখে চলে এল বিধবা মা। রাস্তা থেকে সেই শিশুটিকে উদ্ধার করে দত্তক নিল এক তাঁতির স্ত্রী। এই পথ-কুড়োনো ছেলেই পরে সাড়া ফেলে দিলেন কবীর নামে।

এ বার দ্বিতীয় গল্প।

সাধক রামানন্দ চাইলেন তাঁর বরে পুত্রলাভ হোক এক ভক্তপ্রাণার। কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মে নয়, সাধক চাইলেন মেয়েটির হাতের পাতা থেকে জন্ম নেবে সেই সন্তান। হলও তাই।

জন্মের পর নবজাতককে রাখা হল এক জলাশয়ে পদ্মপাতার উপর। তাকে খুঁজে পেলেন নিরুর স্ত্রী নিমা। নিয়ে গেলেন বাড়ি। হাতের পাতা থেকে জন্ম বলে ছেলের নাম হল কর-বীর।

আর একটি কাহিনি।

স্বর্গ থেকে মর্ত্যলোকে নেমে এলেন তিনি। যেখানে ভূমিষ্ঠ হলেন, তার চারপাশে প্রস্ফুটিত পদ্ম। আশ্চর্য নির্জনতায় মৌমাছিরা গুঞ্জনে বিমুখ। শান্ত জলাশয়ের চারপাশে ঘুরে ঘুরে পাক খাচ্ছে ময়ূর। আরও কত পাখি!

তাঁতি নিরুর সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী নিমা যাচ্ছিলেন সেই পথে। প্রবল তেষ্টায় পৌঁছালেন জলাশয়ের ধারে। আর শিউরে উঠলেন পরিত্যক্ত এক শিশুকে দেখে।

নিমার মন বলল, এই সন্তান নিশ্চই কোনও হতভাগ্য কুমারী বিধবার লজ্জার ফসল।

নিরু চাইলেন শিশুটিকে বাড়ি নিয়ে যেতে। কেচ্ছার ভয়ে পিছিয়ে এলেন নিমা।

নিমা ভাবলেন, মহিলারা নিশ্চয় জিজ্ঞেস করবে পদ্মের মতো চোখ এই শিশুর মায়ের পরিচয়!

মনের ভয় সরিয়ে শিশুটিকে অবশেষে নিয়ে এলেন বাড়ি। এলাকার মহিলারা গান গেয়ে অভ্যর্থনা জানালেন তাঁদের। কিন্তু নিমার কোলে যেই তাঁরা দেখলেন এক শিশুকে, স্বভাবতই জানতে চাইলেন তার রহস্য।

নিমা শুধু বললেন, তিনি নিজে জন্ম দেননি এই সন্তানের। শুধু খুঁজে পেয়েছেন তাকে।

সকলের সব প্রশ্ন থেমে গেল সেখানেই।

শিশুপুত্রের যোগ্য একটা নাম দেবার জন্য বাড়িতে কাজী ডেকে আনলেন নিরু। কোরান ঘেঁটে আকবর, কিবরিয়া, কুবরার মতোই একটা নাম খুঁজে পেলেন কাজী— ‘কবীর’। তারপরই হঠাৎ যেন থমকে গেলেন তিনি। কোথাও যেন ঈশ্বরের আভাস এই নামে। খবর দ্রুত ছড়িয়ে গেল এলাকায়। ছুটে এলেন আরও ছয় কাজী। কোরান উল্টে তাঁরাও বললেন, তাঁতির ছেলের নাম হবে না কবীর। নিরুকে তাঁরা আদেশ দিলেন, ‘‘ধ্বংস করো এই ছেলেকে।’’

কাজির বিচার শিরোধার্য করে শিশুপুত্রকে হত্যার জন্য নিয়ে গেলেন নিরু। ঠিক তখনই সেই শিশুর মুখ থেকে নিঃসৃত হল গভীর বাণী—

‘‘মায়ায় অন্ধ বসুন্ধরায় কেউ চেনেনা আমাকে। বাতাসও নই মাটিও নই, আমি শুধুই জ্ঞান। সবার ঊর্ধ্বে আমি শুধুই শব্দের এক ফেরিওয়ালা। ধ্বংস নেই আমার, কবীর আমি।’’

রামানন্দের ‘চ্যালা’

মধ্য যুগের সাধক কবি কবীরের জন্ম নিয়ে ছড়িয়ে আছে এমনই সব কাহিনি। ১৩৯৮ থেকে ১৫১৮—কবীরের অনুগামী, অর্থাৎ কবীরপন্থীরা কবীরকে এত দীর্ঘ এক আয়ু দিয়েছেন।

আর গবেষকদের অনেকেই ধরে নিয়েছেন কবীরের জন্ম আর মৃত্যু ১৩৯৮ থেকে ১৪৪৮-এর মধ্যে।

এক মুসলিম তাঁতির পরিবারে জন্ম, বারাণসীতেই জীবনের বেশিটা সময় কেটেছে, প্রয়াত হয়েছেন মগ্হারে— কবীরকে নিয়ে এই সব তথ্য ঘুরে ফিরে আসে।

তাঁত বোনার কাজ করতেন কবীর নিজেও। তার মধ্যেই তাঁর ভাবনা খেপিয়ে তুলল যেমন মুসলমানদের, তেমন হিন্দুদেরও। মুসলমানরা বলল, কবীর কাফের।

মাথায় তিলক কেটে কবীর গলায় কন্ঠী পরলে রেগে গেল হিন্দুরা। ব্রাহ্মণদের কবীর বললেন, ‘‘আমি কাপড় বুনি, গলায় একটা সাধারণ সুতো পরি। তোমরা পরো পবিত্র পৈতে। গীতা আর গায়ত্রী মন্ত্র তোমাদের মুখে আর গোবিন্দ আমার প্রাণে। তোমরা খোঁজো পার্থিব এক সম্রাটকে, আর আমার মন হরি-তে।’’

কবীরকে আধ্যাত্মিক অভিভাবকহীন ‘নিগুরা’ বলে উপহাস করছে তখন অনেকেই। কবীর ভাবলেন, তিনি সন্ন্যাসী রামানন্দের শিষ্য হবেন। কিন্তু সেই পথ যে দুর্গম, কবীর জানতেন।

ভাবলেন, রামানন্দের গোপন মন্ত্রের অধিকারী হতে পারলেই তো তাঁকে শিষ্য করে নিতে বাধ্য হবেন এই সাধক। নদীর যে ঘাটে রোজ স্নানে আসেন রামানন্দ, তার সিঁড়ির উপর তখন শুয়ে কাটাতে লাগলেন কবীর।

ভোরের আবছায়ায়, অসাবধানে একদিন রামানন্দর পা পড়ল কবীরের গায়ে। আর চমকে সন্ন্যাসী বলে উঠলেন, ‘‘রাম রাম!’’

কবীর বুঝলেন, রামানন্দের গোপন মন্ত্র এটাই। —‘রাম রাম’!

সবাইকে তিনি বললেন, তিনি হয়ে গিয়েছেন রামানন্দের ‘চ্যালা’।

খবর জেনে হিন্দু আর মুসলমান দুই দলই গেল রামানন্দের কাছে। দু’দলেরই প্রশ্ন, এক ‘মুসলমান’কে কীভাবে দীক্ষা দিলেন রামানন্দ! রামানন্দের নির্দেশে হাজির কবীরও।

সন্ন্যাসী কবীরকে বললেন, ‘‘কবে আমি দীক্ষা দিলাম তোমায়?’’

উত্তরে কবীর বললেন, ‘‘শিষ্যদের কানে মন্ত্র দেন গুরুরা। আপনি সেদিন আমার মাথা ছুয়ে শিখিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর নাম— রাম!’’ রামানন্দের মনে পড়ে গেল স্নানঘাটের সেই ঘটনা।

মৃদু হেসে তিনি বললেন, ‘‘তবে সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে তুমি আমার শিষ্য।’’

এর পরে আর কথা হয় না।

বিক্ষুব্ধরা ফিরে গেল হতাশ হয়ে।

কবীরের সংসার

কবীরের বয়স তখন প্রায় তিরিশ।

গঙ্গার ধারে এক বনখন্ডি বৈরাগীর বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। গিয়ে বসলেন বাড়ির দাওয়ায়।

বছর কুড়ির একটি মেয়ে বেরিয়ে এল কিছুক্ষণ পর।

‘‘নাম কী? জাত-গোত্র?’’ — মেয়েটির এই দুই প্রশ্নের উত্তরেই কবীর বললেন, ‘‘আমার নাম কবীর।’’

ততক্ষণে বাড়ির উঠোনে এসে পড়েছেন সাধুরাও।

সাত বাটি দুধ নিয়ে এল মেয়েটি। পাঁচ বাটি সাধুদের। একবাটি কবীরের আর অন্য বাটি নিজের জন্য।

কবীর ফিরিয়ে দিলেন তাঁর ভাগ। বললেন, ‘‘ ঈশ্বরের শব্দই আমার আহার্য।’’

মেয়েটি, যার নাম লোই, কবীরকে বলল, ‘‘স্বামী আমাকে এমন শিক্ষা দিন যা মনে শান্তি এনে দেয়।’’ সাধকদের সেবায় নিয়োজিত হয়ে তাকে সত্যনাম জপ করার পরামর্শ দিলেন কবীর। তাঁর সঙ্গে লোই এলেন কাশী, অর্থাৎ বারাণসীতে। কবীরের মা নিমা ভাবলেন ছেলে বুঝি বউ এনেছে বাড়িতে। কিন্তু দিন কতক তাদের ভাল করে লক্ষ করে কেমন যেন খটকা লাগল তাঁর। এক দিন বলেই ফেললেন, ‘‘বিয়ে করার অর্থ কি, যদি দুজন না-ই থাকে স্বামী-স্ত্রীর মতো।’’

উত্তর এল না কোনও।

স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকেন না, অথচ কিছু দিনের মধ্যেই লোইয়ের কোল আলো করে এল এক ফুটফুটে শিশু।

সে’ও এক আশ্চর্য গল্প।

গঙ্গার ধারে হাঁটছিলেন কবীর। জলে ভেসে এল একটি মৃত শিশু। তার কানে কানে কিছু বললেন কবীর। প্রাণ ফিরে এল শিশুর। কবীর তার নাম দিলেন কমাল। আর লোইয়ের হাতে তুলে দিলেন তাকে।

বড় হতে হতে লোইকেই মা ভাবতে শিখল কমাল। আর লোইয়ের কোলে সন্তান দেখে সবাই ধরে নিল, এ বার নির্ঘাৎ বিয়ে হয়ে গেছে কবীরের।

‘পুত্র’র পর এ বার ‘কন্যা’ও।

পড়শির শিশুকন্যা মারা গেছে শুনে তার বাড়ি গেলেন কবীর। মৃত মেয়েটিকে নিয়ে এলেন নিজের বাড়ি আর তাঁর ‘শব্দ’ দিয়ে বাঁচিয়ে তুললেন তাকে। নাম দিলেন কমালী। কমালের পর কমালীও গেল লোইয়ের কোলে।

এখন আমি পুড়িয়ে দেব তাদের বাড়ি

কবীরের জন্ম, মৃত্যু, জীবন, বচন, কল্পনা— জিজ্ঞাসা আর অনুমানের ধোঁয়াশায় ভরা। কিন্তু তার ভিতর থেকেই ভেসে আসে নিজের সময় আর স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানো ঠোঁটকাটা, নির্ভীক, খোলামেলা, সহজ, গভীর-দর্শন-সঞ্জাত সেরা এক কবির স্বর।

ধরে নেওয়া হয় কবীর ছিলেন নিরক্ষর। তিনি নিজেও বলেছেন, ‘‘কালি ছুঁই নি, কাগজও না/ এই হাত ধরেনি কলমও কোনও দিন।’’ মুখে মুখে ছড়িয়েছে কবীরের বচন— নানা সময় নানা ভাষায় নানা হাতে লেখাও হয়েছে তাঁর মৃত্যুর বহু পর। কিন্তু কবীরের নামে এযাবৎ চলে আসা সাহিত্যের কতটা কবীরের রচনা, তা নিয়ে অবশ্য সন্দেহ থেকেই যায়।

এখনও অবধি তিনটি সংকলনে পাওয়া কবীরের বাণী প্রামাণ্য বলে ধরে নিয়েছেন গবেষকরা। পঞ্জাবের ‘গুরুগ্রন্থ’ অথবা ‘আদিগ্রন্থ’, রাজস্থানের ‘পঞ্চবাণী’, আর কবীরপন্থীদের সংকলিত ‘বীজক’।

অনুমান ‘বীজক’ আর ‘পঞ্চবাণী’ সপ্তদশ শতকের। ‘আদিগ্রন্থ’ পাওয়া যায় ১৬০৩ থেকে।

কেউ বলেছেন কবীর হিন্দি ভাষার প্রথম মুখ্য কবি। কিন্তু কবীরের সোজাসাপ্টা, রুক্ষ, তির্যক বচন গুলোকে অনেকের মনে হয়েছে একটু স্থূল এবং সাধারণ মানের।

কবির বদলে সমাজ সংস্কারকের আসনেই তাঁকে বসিয়েছেন অনেকে। আর কবীরের ধর্ম নিয়ে তো কত জনের কত মত!

তাঁর কথামালার টান এত প্রবল, শিখ ধর্মগুরু গুরু অর্জন ‘আদিগ্রন্থ’ উজাড় করে দিয়েছেন কবীরের ভাবনায় ভাবনায়। আবার কবীর-পন্থায় প্রাণিত হয়ে জোট বেঁধেছেন সমমনস্ক অনুরাগীবৃন্দ, যাঁরা পরিচিত ‘কবীরপন্থী’ হিসেবে।

মিথ্যা থেকে, ধর্ম থেকে, আচার থেকে, প্রথা থেকে, আকার এবং মায়ায় অন্ধ পৃথিবীর প্রবঞ্চনা থেকে, অজ্ঞানের অন্ধকার, পুরোহিত তন্ত্র, সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন কবীর। ‘শব্দ’, ‘নাম’ আর ‘রাম’ এই মুক্তির পথে সঙ্গী হয়েছে কবীরের।

তবে কবীরের ‘রাম’ হিন্দু পুরানের রাম নয়, দশরথের পুত্রও নয়. কবীরের ‘রাম’ কবীরের নির্বিকল্প পরমতম

তত্ত্ব। আত্মা যার অংশ। ভক্তি এবং ভালবাসায় মায়ার জীবনযাপন করে সেই পরম সত্যে বিলীন হওয়াই ছিল কবীরের সাধনা আর শিক্ষা।

যে সময় জন্মেছিলেন, উত্তর ভারতের মুসলমানদের অনেকেই তখন ক্ষমতাসীনের ধর্মে, হিন্দু থেকে, রূপান্তরিত মুসলমান। অনেকের ধারণায় ‘জুলাহা’, ম্লেচ্ছ পিতার সন্তান কবীরও ছিলেন সম্ভবত হিন্দু থেকে রূপান্তরিত মুসলমান পরিবারে বেড়ে ওঠা এক ব্যতিক্রমী আলোকবর্তিকা, যিনি অনায়াসে ছুড়ে ফেলেছিলেন প্রথা। আর চাপিয়ে দেওয়া ধর্মের বন্ধন। তাঁর পথের বিপদ যে অনেক, তাঁকে অনুসরণ করার ঝক্কিও যে অনেক, সেই বিষয়ে সচেতন করে গিয়েছিলেন নিজের সম্ভাব্য অনুগামীদেরও। বলেছিলেন, ‘‘আমার বাড়ি পুড়িয়েছি/ মশাল আমার হাতে/ এখন আমি পুড়িয়ে দেব তাদের বাড়ি/ আমার পথে হাঁটবে যারা।’’

আত্মাকে বলতেন হাঁস

কবীরের পথ কাঁটায় ছাওয়া, হাঁটতে গেলেই বিদ্ধ করে। কবীরের ঠোঁট অগ্নিশিখা, লেলিহানে শুদ্ধ করে। সোজাসাপ্টা, অকপট ভাষণে বিশ্বাসী কবীর বলেছিলেন, ‘‘পণ্ডিত.../ বলো আমায় অস্পৃশ্যতা এসেছে কোত্থেকে/ যেখানে তোমার বিশ্বাস!’’

বলেছিলেন, ‘‘সাধুগণ, দেখতে পাচ্ছি বসুন্ধরা অন্ধ/ সত্যি বললে আসছে আঘাত/ মিথ্যা বললে বিশ্বাস।’’

বললেন, ‘‘রামের দিকে যাও/ নেই হিন্দু, তুর্কি নেই কোথাও!’’

মুখের আগল খুলে নজর-কাড়া সম্বোধনে ‘বিপথগামী’ শ্রোতাকে চমকে দিয়ে কবীর এও বলেছিলেন: ‘‘হে বেশ্যার ছেলে,/ এই এখানে তোমার জন্য রইল অপমান,/ভালো রাস্তায় যাবার কথা ভাবো একটিবার।’’

জাত খোয়ানো কবীর বুঝেছিলেন ‘‘একই চর্ম, হাড়,/ একই মূত্র, মল/ একই রক্ত, মাংস/ একটি বিন্দু থেকে একটি বিশ্ব/ কে ব্রাহ্মণ? কে শূদ্র?’’ যে পরমসত্য থেকে বিশ্ব নিসৃত, সেই সত্যে জীবন মেলাতে চেয়েছিলেন কবীর। কবীর

বিশ্বাস করেছিলেন, আত্মা একটি হাঁস, মুক্তি পাবার জন্য শুধু দেহের ভিতর বাস। বলছিলেন, ‘‘একটি লোকের স্ত্রী তার সঙ্গে দরজা অবধি যায়/ বন্ধুরা যায় কয়েক কদম আরও/ মৃতদেহের মাঠে শুধুই মাটি ছড়ানোর লোক/ হাঁস, এবার নিজের মতো উড়ে যেতেই পারো।’’

সেই হাঁসের পালক উড়ে এল কত দূর!

আচার্য ক্ষিতিমোহন সেনের সুবাদে কবীরের ভাবধারার সঙ্গে গভীর পরিচয় ঘটেছিল রবীন্দ্রনাথের। যে বছর রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’-র প্রকাশ, রবীন্দ্রনাথের প্রেরণায় সেই ১৯১০-এই প্রকাশিত হয় ক্ষিতিমোহন সংগৃহীত ও সংকলিত কবীর বচনের প্রথম খন্ড, যা চার খন্ডে গিয়ে শেষ হয়। ১৯১৫-য় রবীন্দ্রনাথের অনুবাদে প্রকাশিত হয় কবীরের রচনা ‘Songs of Kabir”। আর সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমেই আইরিশ কবি উইলিয়ম বা়টলার ইয়েটস জানতে পারেন কবীরকে। ইয়েটসের চেতনায় তাই কি কবীরের সেই হাঁসের ছায়া? — “The Wild Swans at Coole”!

সাক্ষাৎ মৃত্যু

অপ্রিয় কথার মাসুল গুনতে হয় কবীরকে বারবার। তাঁর উপর আক্রমণ নেমে আসে কত অজস্র বার। প্রাণে মারার চেষ্টাও করা হয়।

এক বার যেমন, খোদ সম্রাট সিকন্দর লোধীর কাছে কবীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে চলে আসেন এক পীর।

অভিযোগ, কবীর দাবি করছেন তিনি ঈশ্বরের শক্তির অধিকারী। কাফের তিনি।

এই অভিযোগেই আটক হন কবীর। সম্রাটের সামনে আনা হলে কাজি তাঁকে প্রশ্ন করেন, ‘‘কবীর সম্রাটকে কুর্নিশ জানালেন না কেন!’’

উত্তরে কবীর বললেন, ‘‘তাঁরাই পীর যাঁরা বোঝেন অন্যের যন্ত্রণা। যাঁরা বোঝে না তাঁরা কাফের।’’

সম্রাট জানতে চাইলেন, তাঁকে সকালে আসতে বলা হলেও, নির্দেশ অমান্য করে তিনি বিকেলে এলেন কেন?

নিরুত্তপ্ত কবীরের উত্তর, একটা দৃশ্য নাকি তাঁর সব মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল, তাই এই দেরি!

বলেন, একটা ছুচের ছিদ্রের চেয়েও ছোট রাস্তা দিয়ে একদল উট পেরোচ্ছে দেখেছেন তিনি।

শুনে সম্রাট বলেন, ‘‘মিথ্যা বলছেন কবীর।’’

কবীর বললেন, ‘‘সম্রাট, ভাবুন একবার স্বর্গ আর মর্ত্যের দূরত্ব কতখানি। আর কত অসংখ্য উট আর হাতি এঁটে যায় সূর্য আর চাঁদের মধ্যবর্তী ব্যবধানে। আর এই সব কিছু দেখা যায় আমাদের চোখের একটা কোনা দিয়ে যা কিনা একটা ছুচের মাথার ছিদ্রের চেয়েও সংকীর্ণ।’’

কবীরের কথা শুনে সম্রাট বাকরুদ্ধ। মুক্তি দিলেন তাঁকে। চাপা রাগ, প্রচণ্ড হতাশায় ভেঙে পড়লেন পীর।

আর এক বারের কথা।

এক ‘নষ্ট’ মহিলা ও ‘চামার’ রায় দাসের সঙ্গে মেলামেশা কবীরের। তাই তিনি বিধর্মী। এই অভিযোগ ব্রাহ্মণদের।

কবীরের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ এল। তাঁকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে অনাহারে রাখা হল। শেষে মাঝনদীতে পাথর বোঝাই নৌকায় রেখে ডুবিয়ে দেওয়া হল। ডুবে গেল নৌকা।

কিন্তু কী আশ্চর্য, ভেসে উঠলেন কবীর!

আবার ধরা হল তাঁকে। এ বার পুড়িয়ে মারা হবে। একটা কুঁড়েঘরে বন্দি করে লাগানো হল আগুন।

দাউ দাউ আগুনে ছাই হয়ে গেল ঘর। আর সেই ভস্মের ধিকি ধিকি আগুন সরিয়ে জেগে উঠলেন কবীর!

হাতির পায়ে পিষে মেরে ফেলারও চেষ্টা হয় এক বার। সে বার কবীর উঠে আসেন সিংহের রূপ ধরে!

মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া সম্রাট ক্ষমা চান কবীরের কাছে, আর চান কবীরের হাতে নিজের শাস্তি।

কবীর বললেন, ‘‘যারা কাঁটা বিছিয়ে দেয়, তাদের জন্য ফুল ফোটানো দরকার।’’

শেষের সে দিন

গোরখপুর জেলার মগ্হারে কবীরের শেষ দিন। তাঁর আত্মা ছেড়ে গেছে পার্থিব আধার। শায়িত কবীরের শরীর। অথচ কবীরকে ঘিরে বিতর্ক যেন তাতেও শেষ হবার নয়।

আর তা’ও কী কারণে?

একদিন যাঁরা তাঁকে কাফের আর ‘নিগুরা’ বলেছিল, সেই তারাই তখন শবের মালিকানা চেয়ে তুমুল বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে।

ওই কোলাহল, তর্কের মধ্যে হঠাৎ সরে গেল কবীরের মৃতদেহ চাপা দিয়ে রাখা চাদর! আর এ কী দৃশ্য! দেখা গেল কিছু নেই, শুধু একরাশ ফুল পড়ে আছে শবশয্যা জুড়ে। সেই ফুল থেকে অর্ধেক তুলে কবর দিল মুসলমানরা। অপর অর্ধেক দাহ হল হিন্দু মতে!

চলে গেলেন পথের কবীর। সামনে কবির এক পথ...!

ঋণ: ‘Kabir and Kabir Panth’, Rev. G.H. Westcott, ‘The Bijak of Kabir’, Linda Hess and Sukhbir Singh ‘Kabir: The Weaver’s Songs’, Vinay Dharwadker, ‘কবীর’, ক্ষিতিমোহন সেন,

প্রাককথন: সব্যসাচী ভট্টাচার্য

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kabir
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE