অনেকের কাছে তিনি পাগল। অনেকের কাছে ‘আঁতেল’। আবার অনেকের কাছে বাংলার বুকে ‘স্বাধীনচেতা’ এক সাধারণ মানুষ। কিন্তু তাঁর এই ‘পাগলামো’-র রসদ কী? রোদ্দূরের ভাল নাম অনির্বাণ রায়। বর্তমানে দিল্লির বাসিন্দা হলেও তিনি আদপে পূর্ব মেদিনীপুরের রামনগরের ছেলে। স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন রামনগর কলেজ থেকেই। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করার সুবাদে কাজ করেন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায়।
কদর্য ভাষায় গান গাওয়া এবং ইউটিউবে অশ্লীল ভাষায় সমাজের একাধিক ধ্যানধারণাকে আঘাত করা রোদ্দূর ডিস্ক জকি (ডিজে) হিসেবেও কাজ করেছেন। নেশা করতে করতে গালিগালাজ করে গান গেয়ে এবং অদ্ভুত ভঙ্গিমায় কথা বলে ইউটিউবার হিসেবে রোদ্দূর বিভিন্ন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার পাশাপাশি লিখে ফেলেছেন কয়েকটি বইও। এর মধ্যে অন্যতম ‘অ্যান্ড স্টেলা টার্নস আ মম’। ইউটিউবে গান গাইলেও রোদ্দূর কি নিজেকে শুধুই ইউটিউবার এবং গায়ক ভাবেন? না কি তিনি নিজেকে কবি, চলচ্চিত্রনির্মাতা, সাহিত্যিক এমনকি, আধ্যাত্মিক গুরু বলেও মনে করেন? অন্তত তাঁর কথাবার্তা এবং যুক্তি শুনলে তেমনই মনে হয়।
গত দু’দশক ধরে শিল্পের অধিবাস্তববাদী এবং উত্তর-আধুনিকতাবাদী চিন্তাভাবনা নিয়ে রোদ্দূর একাধিক কাজ করেছেন। তিনি ‘মোক্সাবাদ’-এর জনক। কিন্তু কী এই মোক্সা (মোক্ষ) তত্ত্ব? যা মানুষের কাছে ‘মোক্ষ’, তা-ই রোদ্দূরের ‘মোক্সা’। রোদ্দূরের মতে মোক্সা স্বাধীনতা, প্রেম এবং শান্তির অনুশীলন। রোদ্দূরের দাবি, এই অনুশীলনের পাশাপাশি সাহিত্য, শিল্প ও আধ্যাত্মিকতা চর্চার মাধ্যমে সামাজিক ও ব্যক্তিগত ভাবে মোক্ষলাভ সম্ভব। নিজের কাজ, তত্ত্বকথা এবং চিন্তাভাবনার কথা শুনিয়ে দেশ-বিদেশের বহু স্বীকৃতিও রোদ্দূরের ঝুলিতে ঢুকেছে।
ভালই চলছিল জীবন। রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী পাল্টে সেই জায়গায় কদর্য শব্দ জুড়ে গান গেয়ে মনের ভাব প্রকাশ করলেও নেটমুখী বাঙালি ছেলে-মেয়েদের কাছে মজার বিষয় হয়ে উঠেছিলেন রোদ্দূর। কটাক্ষও জুটেছিল। আবার সমর্থনও মিলেছিল। বস্তুত, তাঁর একেকটি ইউটিউব ভিডিয়োয় লক্ষ লক্ষ দর্শক হত। শেয়ারও তেমনই। তাঁর ফেসবুক লাইভ সাড়া ফেলেছিল তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশের মধ্যে। তবে ধ্রুপদী বাঙালি রোদ্দূরকে বরাবরই এক ‘উটকো উৎপাত’ বলে মনে করেছে।
২০২০ সালের ৫ মার্চ। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বসন্ত উৎসব উপলক্ষে আবির খেলায় মেতে ওঠা পড়ুয়াদের মুখে রবীন্দ্রসঙ্গীত— ‘চাঁদ উঠেছিল গগনে...।’ কিন্তু তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গানে মেশানো রোদ্দূর রায়ের অশ্লীল শব্দ। তা গেয়েই উল্লাসে মাতোয়ারা নতুন যৌবনের দূতেরা। একই সঙ্গে ‘রোদ্দূর রায় ভার্সন’-এর গানের কথা পিঠে আবির দিয়ে লিখে ছবিও তুলেছিলেন তাঁরা। মুহূর্তে ভাইরাল হয়েছিল সেই সব ছবি। ফল? জনতার কাঠগড়ায় রোদ্দূর। তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে পুলিশের কাছে অভিযোগও দায়ের করা হয়।
রোদ্দূরের গানের ভাষায় কদর্যতার ছাপ মেলে। চিন্তাভাবনায় মেলে কি না, তা আপেক্ষিক এবং তর্কসাপেক্ষ বিষয়। তবে তাঁর কাছে সব সময়ই বড় হয়ে উঠেছে তাঁর মোক্সা এবং মোক্সার জন্য করা তাঁর পদক্ষেপ। সমাজের জন্য এই ধরনের ধ্যানধারণা ভাল কি না, তা-ও কেউ হলফ করে বলতে পারবেন না। তবে ভারতের সংবিধান এবং আইন যে তাঁর চিন্তার সঙ্গে সহমত নয়, তা মঙ্গলবার তাঁর গ্রেফতারে প্রমাণিত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy