Advertisement
২২ মে ২০২৪

শেষ যাত্রায় গায়ে দশহাজারি শাল

হাটখোলার সুধাংশুকুমার দত্তের প্রিয় তাফতার সালের দাম সত্তরের দশকেই ছিল দশ হাজার। আংটির ভেতর দিয়ে গলে যায় সেরা জাতের শাহতুশ। আসল পশমিনার দক্ষিণা এখন লাখদুয়েক। ধার-করা জামিয়ারে সাহিত্যসভায় যাওয়া পছন্দ করতেন না রবীন্দ্রনাথও। ঋজু বসু হাটখোলার সুধাংশুকুমার দত্তের প্রিয় তাফতার সালের দাম সত্তরের দশকেই ছিল দশ হাজার। আংটির ভেতর দিয়ে গলে যায় সেরা জাতের শাহতুশ। আসল পশমিনার দক্ষিণা এখন লাখদুয়েক। ধার-করা জামিয়ারে সাহিত্যসভায় যাওয়া পছন্দ করতেন না রবীন্দ্রনাথও। ঋজু বসু

মনোহরণ: কলকাতার বিপণিতে হরেক শালের সম্ভার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

মনোহরণ: কলকাতার বিপণিতে হরেক শালের সম্ভার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২০ ২৩:৫৯
Share: Save:

দুই কামরার ফ্ল্যাটের মধ্যমণি রঙিন পোর্টেবল টিভিটা এ বার চোখে পড়ল না। সন্ধ্যার আয়েশি নিশ্চিন্তির জমিতে ভেসে এল না কোনও উমদা রান্নার সুবাস! সেই খোলা গলার স্মিত মেহমানদারির বদলেও কি খানিক থমথমে আড়ষ্টতা?

তালতলার নামহীন তস্য গলির পেট-চিরে বেরনো ডেরার নাম ‘কাশ্মীর-কোঠি’। এ তল্লাটের বেশ কয়েকটি বাড়িরই এমন খ্যাতি, কতিপয় আবাসিকদের গৌরবে। রাত ন’টায় আলতো ভেজানো দরজাটা ঠেলে অনায়াসে দোতলার ভেতর ঘরে ঢুকে পড়া গেল। প্রায় দশ মাস বাদে ফের আসা! একটু অনিশ্চয়তা আর অস্বস্তি ছাড়ান দিচ্ছিল না। এ ঘরের অর্ধেকের বেশি দখল করে চুড়ো হয়ে থাকা লুধিয়ানার কম্বল আর জ্যাকেটের ছড়াছড়ি। জানুয়ারির প্রথম কয়েক দিনের মধ্যেই যার প্রায় সবটা ফাঁকা হয়ে ঘরে ফের টিভি বসবে। পেমেন্ট ‘কুছু-কুছু’ মিললে রোজকার প্যান্তাখ্যাঁচা ডাল-আন্ডার বদলে মাংস-টাংস রান্না হবে তখন! বাডগামের গুলাম নবি ডার, আব্দুল কাইয়ুম ডার, নুর মহম্মদ ডারদের সঙ্গে সে-বার অনেক রাত অবধি ইন্ডিয়া-অস্ট্রেলিয়া টি-টোয়েন্টি ম্যাচ দেখা হয়েছিল। সঙ্গে নৈশাহার। এই শীতকালের ব্যস্ত সময়ে সেই ফুরসত আর মন, দুটোরই কি অভাব ঘটছে?

কিছু কিছু না-থাকার মধ্যে এক ধরনের প্রতীকী ব্যঞ্জনা থাকে। সাবেক কলকাতার বড়-বাড়ির প্রবীণ কর্তার স্মৃতিতে, দাদামশায়ের পোকায়-কাটা শাল-স্মৃতি যেমন। এমন টুকরো বিষাদ মিশে থাকে বুকের ভেতর পুরনো দেরাজ-আলমারিতে। তালতলার ম্যাড়মেড়ে রংচটা ঘরটায় আব্দুল কাইয়ুম, গুলাম নবিদের সঙ্গে কথা বলতেও ন্যাপথালিনের গন্ধের মতো অতীত ঠেলে বেরোতে চায়। সে-বার কাইয়ুম বলেছিলেন, লাদাখের সুউচ্চ পাহাড়ের ঢালে কনকনে ঠান্ডার দেশে শিং-তোলা বুনো ছাগল বা অতি বিরল অ্যান্টিলোপদের কথা। সেই ছাগলের রোঁয়াই না কি পশমের রাজা বা শাহতুশ। জামিয়ারের মতো শাহতুশে কোনও কারুকাজের হিড়িক নেই। কিন্তু উলের মহিমায় তা মহার্ঘতম। মসলিনের মতো সেরা জাতের শাহতুশকে ঘিরেও আংটির ভেতর দিয়ে শাল গলে যাওয়ার লোকগাথা জারি আছে। বাতাসের মতো ফিনফিনে, আদরের আশ্লেষের মতো উষ্ণ সে শালের বর্ণনা দিতে বুঝি অবন ঠাকুরকে ডাকতে হবে! কলকাতার ছায়া-শীতে তোশক-পাতা মেঝেয় কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে কাইয়ুম বলেছিলেন, ‘‘সে আর এখন দিতে পারব না, মানেকা গাঁধীজি ওই আইটেম ব্যান করে দিয়েছেন, কিন্তু বললে বিশ্বাস করবেন না, শাহতুশের ওমে পায়রার ডিম ফুটে ছানা হতে দেখেছি।”

কার্গিলের কাছের জংলি ছাগলের রোঁয়ায় আবার পশমিনার মাহাত্ম্য। নিউ মার্কেটের ‘কাশ্মীর গিফট হাউস’-এর বহুদিনের কর্মচারী সাবির আহমেদ ডার থেকে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজার-পাইকপাড়ায় স্বচ্ছন্দ সাইকেল-বিহারী নাজ়ির আহমেদ বাটেরা সুযোগ পেলেই বলবেন, কী ভাবে কোন একটা কিড়ার জ্বালায় অস্থির হয়ে শীত শেষে জংলি ছাগলে পাহাড়ের ঢালে গা ঘষতে শুরু করে। মানুষের চুলের থেকেও ছয় ভাগের এক ভাগ সূক্ষ্ম ঝরে-পড়া সেই পশমেই পরম আদরে অসীম ধৈর্যে প্রাণের নকশা ফুটিয়ে তোলেন ভূস্বর্গের মেয়েপুরুষ। উপত্যকার দেশহারা কবি, অকালপ্রয়াত আগা শহিদ আলির কথা মনে পড়ে যায় চকিতে! যাঁর কবিতায় কাশ্মীরে শ্মশানের মতো স্তব্ধ, ধ্বস্ত শূন্যতাই শান্তির কথা শোনায়।

আজ যখন বুনো ছাগলে পাথরে গা ঘষে,

তার ঝরে-পড়া পশম কে কুড়োবে পাহাড়ের ঢালে?

কোথায় অদৃশ্য, কত যত্নে বোনা শালের নকশাও,

স্যাকরার ওজনে কে আর জরিপ করবে ফিনফিনে রোঁয়া?

এখানে শূন্য মরুভূমি বলছে, থমথমে শান্তির বাণী!

(ফেয়ারওয়েল/ বিদায়, আগা শহিদ আলি)

সেরা জাতের পশমিনা নাকি এত দিন সব অনলাইন বিক্রি হয়ে যেত। সে-অবশ্য ভূস্বর্গে ইন্টারনেট চালু থাকার দিনকালের খবর। নিউমার্কেটের শতক ছুঁই-ছুঁই কাশ্মীরি দোকানেও আজকাল সচরাচর শোকেসে খাঁটি পশমিনার হদিস মেলে না। তেমন রসিক ক্রেতাই বা ক’জন! তবে মালিক, কর্মচারীরা বড়ই ভদ্রলোক! তাই অকাজের খেজুরে আলাপের আবদারেও আলমারির চাবি খুলে কয়েক খান নিখাদ জামিয়ার বের করে দেখালেন। তালতলা-রিপন স্ট্রিটের শালওয়ালারাও বলেন, গ্যারান্টি সাব, চাইলে আসলি পশমিনা আপনাকে আনিয়ে দেব। গড়পড়তা গেরস্ত বাঙালি খদ্দেরের জন্য তা অধরা, বলাই বাহুল্য। সেরাদের দাম এখন লাখ দুয়েকের কম হবে না। শোভাবাজারের অশীতিপর অলককৃষ্ণ দেব বাড়ির পুরনো কাশ্মীরি শালওয়ালাদের নাম-ধাম কাগজে লিখে রেখেছেন। পাঁচ দশক আগে শ্রীনগরে গিয়ে ওস্তাগর-গলিতে তাঁদের খুঁজে এসেছিলেন। হাটখোলার আস্তিক দত্তের বাল্যস্মৃতিতে, শালওয়ালারা খোকাবাবুর জন্য খেলনাও আনতেন দারুণ-দারুণ। দত্তবাড়ির কয়েক পুরুষের পুরনো আহরণ, তখনই দুর্লভ জামিয়ার, দোশালা কিনে নিতেও প্রবল আকুতি ছিল তাঁদের। ১৯৪০-এর দশকে সেই পুরনো বাসি শালের দাম ৫০ টাকা মতো হবে, ১৯৬০-৬১’তে তা বাড়তে বাড়তে দু’-তিন হাজার। কলকাতার বড়বাড়ি তাক করে পুরনো শালের নকশা নকল করতে কিছু টাকা জমা রেখে তা নিয়ে গিয়েছেন গুজরাত না রাজস্থানের কারিগরেরা। আর ফেরত দেননি, এমনও হয়েছে! আস্তিকবাবুর বাবা সুধাংশুকুমার দত্তের প্রয়াণের পরে শেষযাত্রায় তাঁর দেহে প্রিয় তাফতার চাদরখানা বিছিয়ে দিতে হয়েছিল। পরে শোনেন, ১৯৭০-এর দশকেও সেটির দাম দশ হাজারের কম ছিল না!

শালের দু’পিঠে সুতোর কাজ দৃশ্যমান হলে দোশালা। ভাঁজ করে কাঁধের কাছের নকশাটুকুর বাহারে, দোরোখা। লং শালের ঠিক মাঝখানে গোলাকার জমিটুকু শুধু কাজবিহীন। আবার পাড়ের মাপ ক’ইঞ্চি, আঁচলের কাজের ঢঙেও শালের কত না রকমফের। ধার-করা জামিয়ারে সাহিত্যসভায় বাবুয়ানি তাঁর না-পসন্দ, লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। কিন্তু নানা কিসিমের কাশ্মীরি শালের ঠিকুজি কুষ্ঠি আবহমান কাল ধরে মুখস্থ রসিক বাঙালির। নিউ মার্কেটের দোকানের প্রবীণ কর্তা মহম্মদ শফি ফরিদের কাছে শোনা গল্প, ১৯৬০-৭০ এর দশকের সন্ধিক্ষণে শহিদ মিনারের মাঠে বক্তৃতা দিতে আসেন কাশ্মীরের তখনকার মুখ্যমন্ত্রী গুলাম মহম্মদ সাদিক। তাঁর দাদামশাইও নাকি কলকাতায় শাল ফিরি করতে আসতেন!

সেই রসিক বাঙালি বা খাঁটি পশমি শাল, কারও দেখা মেলাই খুব সোজা হবে না এ কালে। কাশ্মীর ছাড়া লুধিয়ানা, অমৃতসরে বোনা শালও কাশ্মীরি তকমা পেয়েছে শালওয়ালাদের পসরায়। তবে সাবেক শাল-সংস্কৃতিই বাংলা ভাষাকে পরম আদরে নুর, কাইয়ুম বা নাজ়িরভাইদের জিহ্বাগ্রে বসিয়ে রেখেছে। দেরাজের পুরনো শালের মতো সেই ‘বাংলা’তেও এক ধরনের ইতিহাসের সুরভি। কয়েক প্রজন্ম, কয়েক শতক ধরে অটুট একটা সম্পর্কের সিলমোহর। কলকাতায় জীবনভর কাটিয়েছেন এমন বহু অ-বাংলাভাষীরও এত চমৎকার বাংলা রপ্ত হয়নি। পড়শি রাজ্য উৎকলে পুরীর জগন্নাথের পান্ডারা ছাড়া মনে হয় না, এত ভাল বাংলা আর কোনও অবাঙালি বলতে পারেন। কাশ্মীরি জবানিতে ‘র’ বা ‘আর’ বলার শেষে একটা ভারী মিষ্টি রেশ রেখে যায়। আর ‘ড়’ কে ‘ড’ কিংবা স্কুলকে ‘সকুল’, স্টেশনকে ‘সটেশন’ উচ্চারণও বাঙালির কাছে এক ধরনের কাশ্মীরিয়তের ছাপ! রিপন স্ট্রিটের জনৈক শাল ব্যবসায়ী এ শহরেই থাকছেন, আজ তিন দশক। তাঁর ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষিত। চাকরি, বিয়ের সূত্রে কলকাতাতেই থিতু। সকলেই ঝরঝরে বাংলা বলেন। বাড়ির জমায়েতে বাবার ‘হাবডা সটেশন’ বলা নিয়ে হাসাহাসি একটা চালু পারিবারিক রসিকতা হয়ে উঠেছে।

দশ মাস বাদে তালতলার আড্ডায় পুরনো কাশ্মীরি বন্ধুদের সঙ্গে সহজ হাসি অবশ্য আজ তত সহজ হচ্ছে না। পুলওয়ামা-কাণ্ডের পরে কলকাতায় বিক্ষিপ্ত সাম্প্রদায়িক উসকানির সামনেও দিলখোলা হাসছিলেন নুর-গুলামেরা। সিজ়নের শেষ বেলায় গত মার্চে হঠাৎ বাডগাম থেকে উদয়, দাঁতের ডাক্তার দোস্ত সৈয়দ বাশারাতের। তাঁকে ঘিরেই ডেরায় উৎসবের মেজাজ। ডক্টরসাব সদ্য দিঘা ঘুরে প্রথম সমুদ্রস্নান সেরে একটু কালো হয়ে ফিরেছেন। সকলে হেসে কুটিপাটি। কোথাও উদ্বেগের লেশমাত্র নেই। সু-রাঁধুনে গুলাম নবি হালকা গরম মশলা, মৌরিতে মাংসের পায়ার সুরুয়া তরিবত করে ফুটিয়ে চলেছেন। সবাই মিলে ক্রিকেট দেখতে দেখতে চলছিল তারই প্রতীক্ষা। শালওয়ালাদের মহাজন পাশের বাড়ির অভিভাবকপ্রতিম কাশ্মীরি প্রৌঢ় শ্রীনগরের মুশতাক আলি খান সাহেবের কণ্ঠের প্রত্যয়েও চিড় ধরেনি। দুর্গাপুরে তাঁর ব্যবসার পার্টনার টিটো সেনগুপ্তর ছেলেটা দাদু বলে ডাকে, গায়ে লেপ্টে থাকে ‘খানসাহেবে’র! তিনি রীতিমতো গদগদ, “বঙ্গাল কি কলকাত্তার সঙ্গে আলাদা বিশওয়াসের সম্পর্ক আমাদের। দু-একটা উল্টাপাল্টা ঘটনা দুনিয়ার সবখানে হতে পারে, কিন্তু এমন দিল সে লেনদেন আর কোথাও হয় না।” দেশে-বিদেশে শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত কাশ্মীরিরা এখন নানা ভূমিকায় ছড়িয়ে পড়ছেন। তবে উপত্যকার শালওয়ালাদের কাছে বাংলাই ‘সেকেন্ড হোম’। নগদে বাকির কারবারেও কদাচিৎ মন কষাকষি ঘটে এখানে। খান তিরিশ কাশ্মীরি পাইকারি কারবারি থাকলে, ঘরে-ঘরে পসরা ফিরি করা শালওয়ালা, তা হাজার দশেক হবে।

দশ মাস বাদে কলকাতায় ফেরা কাইয়ুমের চেহারা অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। নাজ়িরের টেনশনে ডায়াবিটিস ধরেছে। শ্রীনগরের লালবাজারে ইদের আগে তাঁর ফলের রস, নরম পানীয়ের দোকানে ঢালাও বিক্রির মাল তুলে রেখেছিলেন। কে জানত, এমন ঘটবে! তখন টুরিস্ট থিকথিক করছে উপত্যকায়। তার ক’দিন বাদেই ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ। রাতারাতি সব মরুভূমি! কম করে ৭০ হাজার টাকার ক্ষতি। দশ মাস আগে কাইয়ুম জানতেন, বাবা হতে চলেছেন আর কিছু দিনেই। গুলমার্গের কাছে মুসু গ্রামে মেয়ে হয়েছে, ২০ জুলাই। বৌয়ের ডেট ভাগ্যিস এগিয়ে এল! আর ক’টা দিন দেরি হলে, কার্ফু ঠেলে পোয়াতি বৌটাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে কী ঝামেলায় পড়তে হত!

সুগায়ক কাইয়ুমের সঙ্গে যত বার দেখা হয়েছে, গান শোনা হবেই। গ্রামের কাশ্মীরি পণ্ডিত বন্ধুর দেওয়া ‘হিন্দু জাগরণ মন্ত্র’-এর বইটাও সঙ্গে থাকে তাঁর। গণেশ, বিষ্ণু, হনুমানের স্তব সুর করে গেয়ে শুনিয়েছিলেন নিজে। আর সেই সঙ্গে মুকেশ-রফি ও প্রিয় মান্না দে-র গান। রাতের শহরে কাশ্মীরি ভাষায়, ‘অ্যায় মেরে পেয়ারে ওয়াতন’-এর সুর জেগে উঠেছিল সে-গলিতে! এ জিনিস মোবাইলে রেকর্ড না-করে পারা যায় না! এ বার কাইয়ুমকে গানের কথা বলা গেল না।

‘‘সব কিছু আপন করার মনটাই হল কাশ্মীরিয়ত! কাশ্মীরীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে এই খোলা মনের সুফিবাদ। যতই মগজধোলাই করা হোক, এই মনটাকে বদলানো সোজা নয়।’’—কলকাতার এক চেনা কাশ্মীরি শালওয়ালার কন্যার কাছেই কথাটা শোনা। তিনি এখন এ শহরে সমাজতত্ত্ব নিয়ে পিএইচডি করছেন। তাঁর এমফিল-এর বিষয় ছিল, কাশ্মীরি মিডিয়ায় সুফিবাদের প্রভাব। নিজেই বলেন, ‘‘আমি ধর্মবিশ্বাসী। মাঝে কিছু দিন হিজাব পরতাম। সুফিবাদের কাশ্মীরিয়তকে চেনার পরে বুঝেছি, ওটা পশ্চিম এশিয়ার সংস্কৃতি। ধর্মের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই।’’

উপত্যকার পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে কীই বা বলার গুলাম, কাইয়ুমদের। হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানো নয়, বেদনার অবিরাম ভার, যেন একাকার থম মেরে যাওয়া নীরব চোখে চোখে। বছর শুরুর ব্যস্ত মরশুমে শোকতাপের সময় না-থাকাটা অবশ্য একটা সুবিধে কাশ্মীরি শালওয়ালাদের পক্ষে। ভরসন্ধ্যায় এখন মহাজনের কাছে ছুটোছুটির ব্যস্ততা, ইস্কুলের ব্যাগ গুছোনোর ঢঙে পরের সকালের বাছাই শাল, স্টোল, জাফরানের ডিবে, কম্বল-টম্বল গাঁটরিতে বেঁধে রাখা। তারই ফাঁকে ফোনে রাখা দু’বছরের নাতনির ভিডিয়ো ঘাঁটেন গুলাম নবি, সদ্যোজাত মেয়ের ছবি দেখান কাইয়ুম। ওর নাম ইসাল ফাতমা। ইসাল মানে জন্নতের ফুল!

সদ্য ফোটা ফুলের ছবিটুকু চোখে মেখে উঠে আসার তোড়জোড় করার সময়ে হঠাৎই ঠোঙা ভরা আখরোট নিয়ে এলেন গুলাম নবি। স্মিত হাসেন, খুব ভাল আখরোট, আমাদের গ্রামের! পুরনো কাস্টমার দোস্তদের জন্য যা পারি নিয়ে আসি! অপরাধীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে কাইয়ুম বলেন, “আজ আপনাকে ঠিক সম্মান করতে পারিনি আমরা। নিজের খাওয়া না-মিললেও মেহমানকে যত্ন করাই আমাদের কাশ্মীরিয়ত।” ধর্ম-রাজনীতির টানাপড়েনে এফোঁড়-ওফোঁড় প্রাচীন সম্পর্কের জমিতে বোনা হয় আশা কিংবা দুরাশার নকশা। আখরোটের ঠোঙাটা হাতে দেওয়ার সময়ে গোটা-গোটা বাংলায় নবি বলেন, “যেখানে যাই ঘটুক, শেষে শুধু ভালবাসাটাই থেকে যাবে। দেখবেন!”

রাতের রিপন স্ট্রিটে পা রেখেও সেই স্বর বুকের ভেতরে বাজে।

কৃতজ্ঞতা: ইজাজ আহমেদ ভাট (পাম্পোশ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kashmiri Shawl
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE