Advertisement
০১ নভেম্বর ২০২৪
তাঁরা নিতান্ত দিন আনা দিন খাওয়া শ্রমিক। পরবে বাড়ি ফিরতে চাইলে ঠিকাদার দিল খুনের হুমকি। জুটল না মজুরি কিংবা খাবার। তাই কোনও অ্যাডভেঞ্চারে নয়, পরিবারের কাছে ফেরার তাগিদে মরিয়া ১৯ জন পালালেন। তার পর হারিয়ে গেলেন দুর্গম পাহাড় আর হিংস্র প্রাণীর জঙ্গলে। শেষ অবধি কী হল সেই বেপরোয়া মানুষগুলোর?
Bengali

অরুণাচলের জঙ্গলে সতেরো দিন

অবশ্য পথ হারাবেন বলে মোটেই ওঁরা পথে নামেননি। বরং অসহায় ভাবে বাড়ির পথ যত খুঁজেছেন, ততই হারিয়ে ফেলেছেন রাস্তা।

পলায়ন: এই শিবির থেকেই মরিয়া শ্রমিকরা পালিয়েছিলেন জঙ্গলের রাস্তায়। ডান দিকে, উদ্ধার পাওয়ার পর ওঁদের চার জন। বহু দিন পরে হাতে পেয়েছেন খাদ্য ও পানীয়।

পলায়ন: এই শিবির থেকেই মরিয়া শ্রমিকরা পালিয়েছিলেন জঙ্গলের রাস্তায়। ডান দিকে, উদ্ধার পাওয়ার পর ওঁদের চার জন। বহু দিন পরে হাতে পেয়েছেন খাদ্য ও পানীয়।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০২২ ০৮:২৭
Share: Save:

পেট জুড়ে খিদে, গাছ ভরা ফল। কিন্তু খাওয়ার উপায় নেই। অধিকাংশই হয়তো বিষফল! এত বিশাল, ঘন জঙ্গল। একেবারে প্রথমে ভয় ছিল বন্য প্রাণীর মুখে না পড়তে হয়। কিন্তু পরে বুভুক্ষু প্রাণগুলো বাঁচার তাগিদেই জঙ্গলে আঁতিপাতি করে অন্তত একটা কিছু জন্তুরই সন্ধান চালিয়েছে। কী আশ্চর্য! ১৭টা দিন অমন দুর্গম জঙ্গলে ঘুরেও বাঘ ভালুক দূরের কথা, একটা বাঁদরেরও দেখা মেলেনি!

অগত্যা প্রাণ বাঁচাতে ভরসা ছিল শুধুই জংলি কলাগাছ। কপাল এমনই, এই অকালে কলারাও পাকেনি। তাই মাঝে মাঝে কাঁচকলা, বাকি সময় মোচা আর কলাগাছ কেটে বার করা থোড়। সতেরো দিনের অজানা জঙ্গল সফরে পথ হারানো শ্রমিকদের ক্ষুন্নিবৃত্তি বলতে ছিল এটুকুই!

তেমন কোনও বড় বিপর্যয় না ঘটলে উন্নয়নের ঢক্কানিনাদের তলায় চাপা পড়া কয়লাখনির শ্রমিক, নির্মাণকর্মীদের মতো সব নিম্নবর্গীয়দের অনুজ্জ্বল, মিনমিনে জীবন যাপন নিয়ে সাধারণত কারও তেমন মাথাব্যথা নেই। তবে মাঝেমধ্যে ওঁদেরই কেউ কেউ বেআইনি কয়লাখনির মধ্যে বা সেতু তৈরি করতে গিয়ে বেঘোরে মরে গিয়ে খবর হন। অবশ্য তার মধ্যেই আবার দু’-একটা মৃত্যু অনায়াসেই চাপা পড়ে যায় প্রভাবশালীদের হাতযশে। তাই নিউজ়প্রিন্ট আর টিআরপি কাড়তে হলে সেই মরণ হতে হয় ‘গণমৃত্যু’। যেমন দেখা গিয়েছিল মেঘালয়ের কসানের খনিতে। যেখানে পাথরের দেওয়াল ভেঙে হুড়মুড়িয়ে ঢোকা নদীর জলে ডুবে মরেছিলেন ১৬ জন শ্রমিক। যেমন ঘটেছিল নাগাল্যান্ডের মনে। যেখানে কয়লাখনি-ফেরত শ্রমিকদের জঙ্গি ভেবে, ‘নিছক ভুল করে’ই ইজ়রায়েলি সাবমেশিনগানের টানা গুলিতে একেবারে নিকেশ করে দেন দেশের এলিট প্যারাকমান্ডোরা!

তেমনই ১৯ জন শ্রমিকের একটা দল অরুণাচল প্রদেশের পাহাড়ে বেমালুম গায়েব হয়ে গিয়ে জুলাইয়ের খবরে নজর কাড়লেন।

অবশ্য পথ হারাবেন বলে মোটেই ওঁরা পথে নামেননি। বরং অসহায় ভাবে বাড়ির পথ যত খুঁজেছেন, ততই হারিয়ে ফেলেছেন রাস্তা। ওঁরা ভাবছেন, এক সময় মিলবেই বাড়ি। পরিবার ভাবছে, হয়তো আসবে মৃতদেহ মেলার খবর। বিরোধীরা ভাবছেন, জায়গাটা যখন অরুণাচল, তখন নিশ্চয়ই ভারতীয় শ্রমিকদের কব্জা করেছে চিন।

সকলে যখন আশা ছেড়ে দিয়েছেন, প্রায় তখনই, ১৮ দিন পরে যমের দুয়ার থেকে অলৌকিক ভাবে ফিরে এলেন ওঁদের ১০ জন!

অরুণাচলের কুরুং কুমের জঙ্গলে পথ-হারানো শ্রমিকদের যখন উদ্ধার করা হয়, তাঁদের মুখ, গাল কোটরে ঢুকে গিয়েছে। শরীর জলহীন, রক্তহীন। প্রাণশক্তি তলানিতে। পায়ের দগদগে ঘা প্লাস্টিক বা কাপড়ে মোড়া। নাহারলাগুন আর কোলোরিয়াংয়ের হাসপাতালের চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে তাঁদের মধ্যে আট জন বাড়ি ফিরতে পেরেছেন। অভিশপ্ত জঙ্গল-যাপনের অভিজ্ঞতা নিয়ে মুখ খুললেন তাঁদেরই কয়েক জন।

নামে শ্রমিক হলেও অসমের কোকরাঝাড়, বঙাইগাঁও, ধুবুড়ি, বরপেটা, গ্রামীণ কামরূপের মতো জেলার দরিদ্র মুসলিম পরিবারের লোকেদের ক্রীতদাসের মতোই খাটান ঠিকাদারেরা। আগাম কিছু টাকার বিনিময়ে নিয়ে এসে দুর্গম পাহাড়ে নির্মাণ কাজে লাগিয়ে দেন তাঁদের। ছুটি, পেটভরা খাবার কিংবা পারিশ্রমিক— সব কিছুই তখন আকাশকুসুম। দামিনে প্রত্যন্ত এলাকায় সীমান্ত সড়ক সংস্থা বা বিআরও-র হয়ে হুরি থেকে চিন সীমান্ত পর্যন্ত সেতু-সড়ক তৈরির বরাত পেয়েছিলেন বিটি এন্টারপ্রাইজ়ের মালিক বেংগিয়া বাডো। থাকেন ইটানগরে। এ সব কাজে সস্তার নির্মাণ শ্রমিক মানেই অসমের সংখ্যালঘু দরিদ্র লোকজন।

বাক্সার ভকুয়ামারি গ্রামের বাসিন্দা, সংখ্যালঘু ছাত্র সংগঠনের সদস্য মইনুল হক বলছিলেন, শ্রমিক সরবরাহ করার চক্রটা বিরাট। প্রথমে অরুণাচল লাগোয়া লখিমপুরের রেজ়াউল হক ও রহমান আলি মূল ঠিকাদারের কাছ থেকে শ্রমিক সরবরাহ করার বরাত নেয়। সেই খবর ছড়িয়ে দেওয়া হয় নামনি অসমের দালালদের কাছে। ভকুয়ামারির মালেক আলি, সাহাদত আলিরা গ্রামের জয়নাল আলি, রুস্তম আলি ও হিকমত আলিকে রাজি করে। বলা হয়, মাত্র এক মাসের কাজ। প্রতি দিনের হাজিরা সাতশো টাকা। ইদের আগেই, প্রায় বিশ হাজার টাকা রোজগারের আশায় রাজি হয়ে যান তাঁরা। এ ভাবেই কোকরাঝাড়, ধুবুড়ি, বঙাইগাঁওয়ের শ্রমিক জোগানের অন্যান্য দালালের মারফত অসমের মোট ৩২ জন শ্রমিক হাজির হন ইটানগরে। কামরূপের চেঙার দালাল মহিদুল ইসলাম সেখানকার পাঁচ জন যুবককে পাশেই মরিগাঁও জেলায় কাজে লাগানোর কথা বলে নিয়ে যায় অরুণাচলে। বাড়ি ছাড়ায় সময়ই সকলের হাতে হাজার টাকা দেওয়া হয়। ভরসা বাড়ে। কিন্তু প্রথম ধাক্কা ইটানগরেই।

জয়নাল, আমিদুল, ইব্রাহিমরা জানতে পারেন, কাজ এক মাস নয়, চলবে তিন মাস ধরে। আশ্বাস মেলে, ইদে মিলবে ছুটি। ফিরে এসে কাজে যোগ দিলেই হল।

এর পর, কাছেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে জানিয়ে, দু’দিনের রাস্তা পেরিয়ে প্রথমে শ্রমিকদের কোলোরিয়াং নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে আরও ১৩০ কিলোমিটার দূরের পথ দামিন।

জয়নাল আলি, খাইরুল আলি, আবদুল আমিনরা বলছিলেন, ইটানগর থেকে যখন তাঁদের দামিনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখনই প্রমাদ গোনেন তাঁরা। বুঝতে পারেন এই অজ্ঞাতবাস থেকে সহজে মুক্তি মিলবে না। এ দিকে শহর পেরিয়ে পাহাড়ে ঢুকতেই মোবাইলের সিগন্যাল শেষ। শেষ বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগটুকুও।

দামিনে পৌঁছে সকলের আসল নথিপত্র ও মোবাইল জমা নিয়ে নেয় ঠিকাদার। বলা হয়, এলাকায় নেটওয়ার্ক নেই। মোবাইল, কাগজপত্র সঙ্গে থাকলে হারিয়ে যাবে। তাই সুরক্ষিত রাখা হল।

হুরি গ্রাম থেকে রাস্তা ঢালাই ও কালভার্ট তৈরির কাজ শুরু হয় মে মাসের প্রথমে। শ্রমিকরা কাজের বিনিময়ে পান সামান্য খাবার। হাতে টাকা আসে না। কারণ তাঁদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব সাব-কন্ট্রাক্টরের। সে তত দিনে উধাও।

এ ভাবেই চলে আসে কুরবানির ইদ। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব।

ইদের জন্য ছুটি চেয়েছিলেন আবদুল, মজিদুলরা। আর চেয়েছিলেন প্রাপ্য টাকা। ভাবতেই পারেননি পত্রপাঠ আবেদন নাকচ হবে। জয়নাল বলছিলেন, “ঠিকাদারের নিয়োগ করা স্থানীয় সর্দার সাফ জানিয়ে দিল, আমাদের টানা তিন মাস কাজ করানোর বিনিময়ে সাব-কন্ট্রাক্টরদের আগেই থোক বিশ লক্ষ টাকা মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে আমাদের হাজিরা ও রেশনের টাকা ধরা আছে। কাজ শেষ হওয়ার আগে কারও ঠাঁইনাড়া হওয়ার উপায় নেই। কিন্তু তখনও ছুটির দাবি ছাড়িনি আমরা। বার বার বোঝানোর চেষ্টা করি, ইদে বাড়ি ফিরব, এই শর্তেই কাজে রাজি হয়েছিলাম।”

অবাধ্য শ্রমিকদের ‘সমঝে দিতে’ লাইন দিয়ে দাঁড় করান টানি পদবিধারী ওই সর্দার। তার পর কোমর থেকে পিস্তল বের করে শ্রমিকদের পায়ের সামনে দু’রাউন্ড গুলি চালিয়ে তিনি সাফ বলে দেন, “বেশি গাঁইগুঁই করলে খুন করে ফেলব। পালানোর চেষ্টা করলে গাড়ি-সহ জ্বালিয়ে দেওয়া হবে।”

তার পর টাকা বা ছুটি তো দূরের কথা, নিরুপায় শ্রমিকদের তরফে অন্তত দু’বেলা খাবারের ব্যবস্থা করার অনুরোধটুকু করা হয়েছিল। জবাব মেলে, বিশ লাখের মধ্যেই খাবার বরাদ্দও আছে। বাজার করে দিয়ে যাওয়ার দায়িত্বও সাব-কন্ট্রাক্টরদের। কিন্তু তারা কিছুই করেনি। ফলে শুধু কয়েকটা আলু আর চাল বাদে আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না শ্রমিক শিবিরে।

রাগ করে ৫ জুলাই মধ্যরাতের পর সুযোগ বুঝে শিবির থেকে পালান দু’-তিন জন শ্রমিক। উঠতে থাকেন পিছনের পাহাড় বেয়ে। তা দেখতে পেয়ে যান বাকিরা। এর পর আলোচনা করে অন্য মুসলিম শ্রমিকরাও একই পথের পথিক হন। সংখ্যায় তাঁরা মোট ১৯। পালানোর ওই রাতেই শেষ বার ভাত পড়েছিল পেটে।

পালালেন তো, কিন্তু যাবেন কোন পথে?

সোজা হিসেব ছিল, পাহাড় বেয়ে উপরে উঠেছেন দামিনে। তাই পাহাড় বেয়ে নীচে নামলেই ইটানগর পৌঁছনো যাবে। কিন্তু পালানোর ঝোঁকে তাঁদের খেয়াল ছিল না, অরুণাচলের দুর্গম পাহাড়-জঙ্গলে পথের হিসেব অত সোজা নয়।

দিন যায়। উধাও শ্রমিকদের খোঁজ মেলে না। ঠিকাদার ১৩ জুলাই স্থানীয় থানায় নালিশ ঠুকে আসেন, বেয়াড়া শ্রমিকের দল পালিয়েছে শিবির ছেড়ে। পাত্তা দেয় না পুলিশ। ১৮ জুলাই পাহাড়ি নদীর জলে একটি মৃতদেহ ভাসতে দেখে গ্রামের মানুষ পুলিশে খবর দেন। তখনই গোটা ঘটনা জানাজানি হয়। অবশ্য পরে সেই দেহটিও আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

অরুণাচলের পুলিশ-প্রশাসন প্রকারান্তরে জানিয়ে দেয়, সেখানকার দুর্গম পাহাড় আর বিষাক্ত সাপে ভরা জঙ্গলে এত দিন ধরে নিখোঁজ থাকার পরে কারও পক্ষেই বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। খবর পৌঁছয় অসমের গ্রামে গ্রামে। স্বজনের মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানেরা। তবুও নিয়মরক্ষায় চলতে থাকে তল্লাশি অভিযান। ডাকা হয় বায়ুসেনার কপ্টার।

যাঁরা বাঁচলেন, তাঁরা তবে কী ভাবে বাঁচলেন! যাঁরা বাঁচলেন না, তাঁরাই বা কী ভাবে মরলেন?

আয়ুর্বেদ মতে, কলাগাছের প্রতিটি অংশই স্বাস্থ্যকর ও ভেষজ গুণে সমৃদ্ধ। গ্রামের মানুষ হওয়ায় কলা, মোচা, থোড়ের গুণাগুণ সম্পর্কে খানিক ধারণা ছিলই জয়নাল আলি, সামিদুল শেখ, মজিদুল আলি, হামিদুল হুসেনদের। সেই জ্ঞানে ভরসা রেখেই, কলাগাছকে জিয়নকাঠি করে অরুণাচলের কুরুং কুমে জেলার জঙ্গলে ১৭ দিন প্রাণ বাঁচিয়েছেন তাঁরা।

ভকুয়ামারির জয়নাল বলছিলেন, “প্রথম দু’দিন কিছুই খাইনি। অচেনা জঙ্গল আর অচেনা গাছগাছড়ার মধ্যে চেনা বলতে ছিল ওই কলাগাছ। অন্যান্য গাছের ফল বিষাক্ত হতে পারে বলে খেতে ভরসা পাচ্ছিলাম না। তবে পাতা, মূল চিবিয়েছি। ভরসা ছিল কলাগাছ। তার মোচা, থোড়, পাতা কিছুই বাদ দিইনি। তবে এই সময় সব গাছেই কলারা ছিল কাঁচা। কিন্তু খিদের জ্বালায় তা-ই সই।”

জঙ্গলে শিকার করে খাননি কিছু?

জয়নাল বলেন, “সেটাই আশ্চর্যের। আমাদের বাক্সার আশপাশের জঙ্গলে দুই দিন হাঁটলে হাতি, হরিণ, বাঁদর এমনকি বাঘও দেখা যাবে। কিন্তু অরুণাচলের অমন ভয়ঙ্কর জঙ্গলে এত দিন কাটিয়ে একটা বাঁদরেরও দেখা মেলেনি! শুধু দু’বার সাপের দেখা পেয়েছি। কেউ কাউকে কিছু না বলেই পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছি।”

চেঙার আমিদুল হক, ইব্রাহিম আলি, বকোর ইনামুল হকরাও বাড়ি ফিরেছেন সদ্য। তাঁরা জানান, পাহাড়ি নদীর টানে মাছও পাননি তেমন। তার মধ্যেই যে ক’টা ছোট মাছ পেয়েছিলেন তাই কাঁচা কাঁচা খেয়েছেন।

যে ইদের টানে এত কাণ্ড, সেই বকরি ইদের দিনটা কলার থোড় চিবিয়েই পেটের আগুন নিভিয়েছেন ওঁরা। জঙ্গলে মেলেনি গুহা বা ছাউনি। তাই রাত কাটাতে হয়েছে পাথরের গদিতে, বৃষ্টির চাদর জড়িয়ে।

জয়নাল বলেন, “১৭ দিন টানা হেঁটেছি। কিন্তু নামার রাস্তা পেলাম না। অবস্থা এমনই হয়েছিল, যেখানে পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছি, সেখানেই শুয়ে থেকেছি বাকি দিনটা। ওঠার ক্ষমতা ছিল না। বেশির ভাগ দিন জঙ্গলে ঘাসে বসে কাটিয়েছি। কখনও আবার পাহাড়ি নদী পেলে তার মধ্যিখানে থাকা বড় বোল্ডারে শুয়ে থেকেছি। কিন্তু ১৭ রাত ঘুম হয়নি। কারণটা সাপ নয়, বিছে নয় বা কোনও জংলি পশুও নয়। ক্ষুদ্র একটা পোকা। স্থানীয় নাম ‘ডাম ডুম’। আর ছিল জোঁক। যারা শরীরের অর্ধেক রক্ত শুষে নিয়েছে।”

অপর সদস্য, কলগাছিয়ার ইসরপুরের খইরুল ইসলাম বলেন, “দল বেঁধে হাঁটব বলে ঠিক করলেও কখন কী ভাবে একে অন্যের থেকে আলাদা হয়ে পড়ছিলাম খেয়াল নেই। শেষের দিকে আর হাঁটার ক্ষমতা ছিল না। চোখের সামনে তিন সঙ্গী জল না খেতে পেরে তেষ্টায় মরে গেল। তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না।”

জয়নাল জানান, চার দিন হাঁটার পরে প্রথম বড় নদী পড়ে। কী ভাবে পার হব ভেবে পাচ্ছিলেন না তাঁরা। পাড় বরাবর হাঁটতে হাঁটতে দেখেন, এক জায়গায় নদীর উপরে গাছ ভেঙে পড়ে আছে। প্রাণ হাতে করে একে একে ১৯ জন সেই গাছে পা রেখে নদী পার হওয়া শুরু করলেন। তা করতে গিয়ে জলে পড়ে যান দু’জন। এক জন সাঁতরে পারে ওঠেন। অন্য জন ভেসে যাচ্ছিলেন। কোনও মতে গাছের লতা, ডাল ছুড়ে তাকে আটকানো হয়। কিন্তু তাঁর পক্ষে আর পাথরে ফেরা সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু ও পারে আটকে ছিলেন হিকমত। ভয় পাচ্ছিলেন পার হতে। শেষ পর্যন্ত পার হওয়া শুরুও করেছিলেন। তার পরেই উধাও! জয়নালরা ১৭ জন ও পারে গিয়ে প্রথমে আটকে পড়া সঙ্গীকে উদ্ধার করেন। এর পর শুরু হয় হিকমতের খোঁজ। কিন্তু তিন ঘণ্টা টানা খুঁজেও হিকমতের সন্ধান মেলেনি। সেই প্রথম ওঁদের সঙ্গী বিচ্ছেদ।

ন’দিন হাঁটার পরে পাঁচ সঙ্গী জঙ্গলে বসে পড়লেন। আর ওঠার ক্ষমতা ছিল না তাঁদের। জয়নাল বলেন, “ঠিক হয় আমরা এগিয়ে যাব। গ্রামের মানুষ পেলে পরে ওঁদের উদ্ধার করে আনব। কিন্তু আর ফেরা হয়নি। বাড়ি ফেরার পরে জানলাম, জঙ্গলেই ওই এলাকাতেই ওঁদের আধা গলা লাশ পাওয়া গিয়েছে। চার দিন আরও হাঁটলাম জঙ্গলে। ছিটকে পড়লেন আরও তিন বন্ধু। টুলু নামে বঙাইগাঁওয়ের এক সঙ্গী ক্লান্ত হয়ে ধুঁকছিলেন। একটা পাথরের উপরে বসে সেখানেই নিথর হয়ে গেল তার দেহ। সেখানে পাথর চাপা দিয়ে তাঁকে কবর দিয়ে এলাম।”

কামরূপের চেঙার বাসিন্দা ময়জাল হক ও শাহিদুল ইসলামও জলে ভেসে যান।

এ ভাবেই ২২ জুলাই এল। তখনও ১০ জন কোনও মতে চলছেন। হঠাৎ যেন মনে হল কিছু ফাটার শব্দ পেলেন তাঁরা। শব্দটা চেনা। রাস্তা তৈরির সময় বিআরও কর্মীরা ডিনামাইট দিয়ে পাহাড় ফাটান। তখন এমন আওয়াজ হয়। মনে বল এল। তখন শুধু ওই শব্দকে অনুসরণ করে চলতে থাকলেন জয়নালরা। কিন্তু আবার পথে কোরক নদী। এ বারের নদী কী ভাবে পার করা যায়?

জয়নাল বললেন, “সঙ্গে দা ছিল। তা দিয়ে জঙ্গলে থাকা বাঁশ কাটা হল। সেই বাঁশ নদীর মধ্যে থাকা একটা পাথর পর্যন্ত পৌঁছল। প্রথমে বাঁশে পা রেখে নদীর মধ্যের সেই পাথরে পৌঁছে গেলাম। তার পরে ফের বাঁশ টেনে অন্য পারে ফেলে পার হওয়া। কিন্তু আমাদের মধ্যে তিন জনের সেই ক্ষমতা ছিল না। তাঁরা ও পারেই থেকে গেলেন। নদী পেরোলাম যখন, দিনের আলো পড়ে আসছে। একটা সময় মনে হল যেন জঙ্গলের রাস্তা নয়, মানুষে তৈরি রাস্তায় পা দিলাম। প্রথমে বিশ্বাসই হচ্ছিল না। সত্যিই কি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসেছি!”

তত দিনে আশপাশের এলাকার সব মানুষ জেনে গিয়েছেন জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া শ্রমিকদের কথা। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা কঙ্কালসার পাঁচ জন লোককে দেখতে পেয়ে গ্রামের মানুষের বুঝতে বাকি থাকেনি যে তাঁরা কারা। সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের একটা দোকানে নিয়ে বসানো হয়। খেতে দেওয়া হয় শসা, চা, ঠান্ডা পানীয়। পরে গ্রামের মানুষ গিয়ে আরও তিন জনকে উদ্ধার করেন। ২৩ জুলাই ৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তুলনায় সুস্থ থাকা দু’জনকে নিয়ে উদ্ধারকারীরা ২৪ জুলাই জঙ্গল থেকে আরও দু’জনকে উদ্ধার করেন। দাঁড়ানোর ক্ষমতা না থাকা ওই দু’জনকে পিঠে চাপিয়ে পাহাড় থেকে নামিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আনা হয়েছিল।

এসডিআরএফ-এর চতুর্থ ব্যাটেলিয়নের সাব-ইনস্পেক্টর লিচা টাথ জানাচ্ছিলেন, প্রথম যখন উদ্ধারকারী দলের মুখোমুখি পড়লেন, জঙ্গল থেকে বেরোনো শ্রমিকরা হাউহাউ করে কাঁদতে থাকেন। সেই কান্না আর থামে না। ৫ জুলাই শিবির থেকে পালানোর সময় ১৯ জনের দলটার সঙ্গে ছিল একটামাত্র টর্চ, এক বাক্স দেশলাই, একটা লাইটার, দুটো ছুরি, একটা দা, আর কিছুটা চাল। ভেবেছিলেন, সামনের পাহাড়টুকু পেরোলেই পৌঁছে যাবেন অসমে। কিন্তু প্রথম সমস্যার মুখে পড়েন নদী পার হওয়ার সময়। দলের নেতা নিজেই ভেসে যান জলে। ভিজে নষ্ট হয়ে যায় দেশলাইবাক্স আর লাইটার। জঙ্গলে কাঁচা কলাগাছ খেয়ে পেট খারাপ হওয়ায় শরীর আরও ভেঙে পড়ে সবার।

নাহারলাগুন আর কোলোরিয়াংয়ের হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন উদ্ধার হওয়া আট জন। দু’জন এখনও লখিমপুরের হাসপাতালে ভর্তি।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ছ’টি মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। তাঁদের মধ্যে চিহ্নিত হয়েছে ফরিজুল হক, মইজাল হক, সহর আলি ও আবুল হুসেনের দেহ। হিকমত ও বাকিদের দেহ উদ্ধার হয়নি এখনও।

যে টাকার আশায় জয়নাল, রুস্তম, হিকমতেরা ভকুয়ামারি গ্রাম থেকে এপ্রিলের শেষে রওনা হয়েছিলেন ইটানগরের উদ্দেশে, সেই টাকার কানাকড়িও হাতে পাননি কেউ। টাকা নিয়ে পালানো সাব-কন্ট্রাক্টরদের নামে এফআইআর হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তাতেও লাভের লাভ কিছু হয়নি।

জয়নাল দুঃখ করছিলেন, “আগেও শ্রমিকের কাজ করতে গিয়েছি। এমনটা কখনও হয়নি। রুস্তম, হিকমতদের বাড়িতে বৌ-বাচ্চা মিলিয়ে এতগুলো পেট। গ্রামের মানুষ চাঁদা তুলে কিছু সাহায্য করেছে বটে, কিন্তু সে আর কত দিন চলবে। সরকারের তরফে কোনও টাকা পাওয়ার আশাও দেখছি না।”

এখন অনেক দাবি উঠছে। সেই অসাধু ঠিকাদার-দালালদের গ্রেফতার করতে হবে। মৃতদের পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কিন্তু এও মাত্র কয়েক দিনের ব্যাপার। আসলে সবাই জানেন, কার টিকি কোথায় বাঁধা। জানেন, জীবনের অনিশ্চয়তা থাকলেও দুটো ভাতের তাড়নায় আবারও কোনও দালালেরই শরণাপন্ন হতে হবে তাঁদের। আবারও কোনও ঠিকাদারের কাছে লাখ কয়েক টাকায় বেচে দেওয়া হবে গরিব শ্রমিকদের কয়েক মাসের শ্রম। উৎসবে অনুষ্ঠানে পরিবারে ফিরে আসাও হয়ে উঠবে অনিশ্চিত। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঘরের পথ খুঁজতে বেরিয়ে পড়বেন তাঁদের অনেকেই। আবারও হারিয়ে যাবেন তাঁদের কেউ কেউ। কেউ ফিরবেন, কেউ ফিরবেন না আর।

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Arunachal Pradesh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE