ঘটনাটি ১৯১৩ সালের। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এক জনের নামই বার বার ঘোষিত হচ্ছে স্বর্ণপদক প্রাপক হিসাবে। দেখা গেল মোট ২০টি স্বর্ণপদক তিনি পেয়েছেন বিভিন্ন বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার কারণে। সে বছর, এম এ ও এম এসসি ছাত্রদের মধ্যে তিনি সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে কেমিস্ট্রি নিয়ে প্রথম বিভাগে প্রথম হন। ২০টি স্বর্ণপদক ছাড়াও গবেষণার জন্য মাসিক একশো টাকা বৃত্তি ও অত্যন্ত সম্মানজনক ‘গ্রিফিথ মেমোরিয়াল’ পুরস্কারও পান।
সেই ছাত্রের নাম নীলরতন ধর। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রিয় ছাত্র ও পরবর্তী কালে সম্মাননীয় বিজ্ঞানী। ভারতে ‘ফিজ়িক্যাল কেমিস্ট্রি’ বা ভৌত রসায়নের প্রবর্তক তিনিই। এ ছাড়া সয়েল কেমিস্ট্রিতে নীলরতন ধরের অবদান সারা বিশ্বে স্বীকৃত।
১৮৯২ সালের ২ জানুয়ারি, অধুনা বাংলাদেশের যশোরে নীলরতন ধরের জন্ম। পিতা প্রসন্নকুমার ধর, মাতা নীরদমোহিনী দেবী। পাঁচ বছর বয়সে নীলরতন যশোর সরকারি জেলা স্কুলে ভর্তি হন। প্রতি বছর ক্লাসে ফার্স্ট হতেন। পনেরো বছর বয়সে এনট্রান্স পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিশনে বৃত্তি নিয়ে উত্তীর্ণ হন। স্কুলের পড়া শেষ করে চলে আসেন কলকাতায়, ভর্তি হন রিপন কলেজে। তখন মহেন্দ্রলাল সরকার প্রতিষ্ঠিত ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’-এ নিয়মিত বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে বক্তৃতা হত ও হাতে-কলমে পরীক্ষা করে তা দেখানো হত। নীলরতন ধরও প্রায়ই সেখানে যেতেন বক্তৃতা শুনতে।
১৯০৯ সালে নীলরতন বৃত্তি নিয়ে আই এসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ও প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়ন নিয়ে স্নাতক স্তরে ভর্তি হন। জগদীশচন্দ্র বসু ও প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো দু’জন বিজ্ঞানীকে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন। নীলরতন ইডেন হিন্দু হস্টেলে থেকে লেখাপড়া করতেন। তিনি সহপাঠীদের নিয়ে একটি দল তৈরি করেছিলেন। তাঁরা হাতে-কলমে বিজ্ঞানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। ১৯১১ সালে নীলরতন স্নাতক হন, প্রথম স্থান পেয়ে স্বর্ণপদক ও বৃত্তি লাভ করেন। এর পর প্রেসিডেন্সি কলেজে এম এসসি পড়তে পড়তে প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সঙ্গে ‘নাইট্রাইট’ বিষয়ে গবেষণায় যুক্ত হন। প্রফুল্লচন্দ্রের ‘আত্মচরিত’ গ্রন্থে আমরা পাই: “লন্ডনে থাকিবার সময় আমি এমোনিয়াম নাইট্রাইট সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ পাঠ করি। তাহাতে রসায়নজগতে একটু চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ইংলান্ডে আসিবার পূর্ব্বে কলিকাতায় থাকিতেই এ বিষয়ে গবেষণা করিয়া আমি সাফল্য লাভ করি। সৌভাগ্যক্রমে নীলরতন ধর আমার সহযোগিতা করেন এবং তিনকড়ি দে নামক আর একটি যুবকও আমার সঙ্গে ছিলেন।” ছাত্রাবস্থাতেই নীলরতন ধর, ১৯১২ ও ১৯১৩ এই দু’বছরে ১৬টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, যার মধ্যে চারটি গবেষণাপত্র প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সঙ্গে যৌথ ভাবে। ১৯১৩ সালে নীলরতন এম এসসি পাশ করেন। রসায়নে প্রথম বিভাগে প্রথম হন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বিদেশে পড়ার জন্য ‘স্টেট স্কলারশিপ’ পান। যুদ্ধের কারণে সবাই বারণ করলেও নীলরতন কারও বারণ না শুনেই লন্ডন যান। সেখানে ‘ইম্পিরিয়াল কলেজ অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’-তে প্রফেসর জে সি ফিলিপ-এর ল্যাবরেটরিতে কাজ করেন। ১৯১৭ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি এসসি উপাধি পেয়েছিলেন। তাঁর থিসিসটি এত উচ্চ মানের হয়েছিল যে, তাঁকে মৌখিক পরীক্ষা দিতে হয়নি। এর পর তিনি তিনি ফ্রান্সে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জর্জ আর্বাইন-এর কাছে কাজ শুরু করেন এবং ১৯১৯ সালে সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্যারিসের সর্বোচ্চ ‘স্টেট ডক্টরেট ডিগ্রি’ লাভ করেন। সাধারণত কোনও বিদেশিকে এই ডিগ্রি দেওয়া হত না, কিন্তু তাঁর অসাধারণ কাজের জন্য এই ডিগ্রি দেওয়া হয়েছিল তাঁকে।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি এসসি ডিগ্রি পেয়ে তিনি ‘ইন্ডিয়ান এডুকেশনাল সার্ভিস’-এর মাধ্যমে ইলাহাবাদের মুরি সেন্ট্রাল কলেজে রসায়নের অধ্যাপনার পদ নেন। ইংল্যান্ড থেকে ‘ইন্ডিয়ান এডুকেশনাল সার্ভিস’-এর মাধ্যমে চাকরি পাওয়ার জন্য মাসে তিনশো টাকা অতিরিক্ত ভাতা পেতেন। তাঁর প্রচেষ্টায় মুরি সেন্ট্রাল কলেজের রসায়ন বিভাগের যথেষ্ট উন্নতি হয়।
১৯২৬ সালে ছ’মাসের ‘স্টাডি লিভ’ নিয়ে তিনি ইংল্যান্ড ও ইউরোপের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বক্তৃতা দেন। সে সময় বার্লিনের বিখ্যাত ‘ফিজ়িকো-কেমিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রোকেমিক্যাল ইনস্টিটিউট’ পরিদর্শন করেন। তখন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী প্রফেসর ফ্রিৎজ় হেবার ছিলেন ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা।
বিজ্ঞানী নীলরতন ধর যে ভারতে প্রথম ফিজ়িক্যাল কেমিস্ট্রির প্রবর্তন করেন, সে কথার উল্লেখ প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ‘আত্মচরিত’ গ্রন্থে পাওয়া যায়— ‘১৯১০ সালে ‘ফিজ়িক্যাল কেমিস্ট্রি’ বৈজ্ঞানিক জগতে স্থায়ী আসন লাভ করিল। কিন্তু ১৯০০ সাল পর্য্যন্ত ইংলন্ডেও এই বিজ্ঞানের জন্য কোন স্বতন্ত্র অধ্যাপক ছিল না। ভারতে এই বিজ্ঞানের অনুশীলন ও অধ্যাপনার প্রবর্ত্তক হিসাবে নীলরতন ধরই গৌরবের অধিকারী। তিনি কেবল নিজেই এই বিজ্ঞানের গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন নাই, জে. সি. ঘোষ, জে. এন. মুখার্জ্জী এবং আরো কয়েকজনকে তিনি ইহার জন্য অনুপ্রাণিত করেন।”
১৯৩৫ ও ১৯৩৭ সালে ‘ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স’-এ সভাপতির ভাষণে নীলরতন ধর তাঁর আবিষ্কৃত বৈজ্ঞানিক তথ্য যা ‘ফোটোকেমিক্যাল নাইট্রোজেন ফিক্সেশন’ নামে বিখ্যাত, তা ব্যাখ্যা করেন। ক্যালশিয়াম ফসফেটের উপস্থিতিতে জৈব সার কী ভাবে সূর্যালোকের সাহায্যে বাতাসের নাইট্রোজেনকে মাটির সঙ্গে যুক্ত করে ও গাছের প্রয়োজনীয় পুষ্টি জোগায়, তা ব্যাখ্যা করেন।
অধ্যাপক ধর তাঁর গবেষণাকে শুধুমাত্র ল্যাবরেটরিতে সীমাবদ্ধ রাখেননি, সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে ছুটে গিয়েছেন তাঁদের মধ্যে। এলাহাবাদে অনেক পতিত জমিতে চাষবাস কিছুই হত না। তিনি খবর পেয়ে মাটি পরীক্ষা করে দেখলেন, তা অতিরিক্ত ক্ষারীয়। চিনিকল থেকে যে সব উপজাত বস্তু পাওয়া যায়, যেমন মোলাসেস ও প্রেস-মাড, তা অন্যান্য জৈবপদার্থের সঙ্গে মিশিয়ে তিনি জমিতে ব্যবহার করতে বললেন। উত্তরপ্রদেশে চিনিকল থাকায় এগুলি সহজলভ্যও ছিল। কিছু দিনের মধ্যেই জমি উর্বর হল।
অধ্যাপক ধর নোবেল পুরস্কার না পেলেও দু’বার তাঁর নাম নোবেল কমিটিতে সুপারিশ করা হয়েছিল। দেশ-বিদেশের অসংখ্য সম্মান লাভ করেছিলেন নীলরতন। লন্ডন কেমিক্যাল সোসাইটির ফেলো, ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের রসায়ন বিভাগের সভাপতি, ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও পরে সভাপতি, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স-এর সভাপতি ইত্যাদি।
ইউনেস্কোর আবেদনে ১৯৬৮ সালে রোমে বক্তৃতা দেন তিনি। তাঁকে সম্মানিক ডি এসসি উপাধি প্রদান করে কলিকাতা, বিশ্বভারতী, বেনারস, গোরক্ষপুর, এলাহাবাদ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রফেসর নীলরতন ধর, এলাহাবাদে ১৯৩৫ সালে ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সয়েল সায়েন্স’ প্রতিষ্ঠা করেন। ওঁর একক প্রচেষ্টায় এবং নিজের উপার্জিত অর্থে ভারতে প্রথম সয়েল কেমিস্ট্রির এই গবেষণাগার তৈরি হয়েছিল। পরে ওঁর স্ত্রী শ্রীমতী শীলা ধর প্রয়াত হলে উনি ওই প্রতিষ্ঠানের নাম রাখেন ‘শীলা ধর ইনস্টিটিউট অব সয়েল সায়েন্স’। ১৯৩০ সালে তিনি শীলা রায়কে বিবাহ করেছিলেন। তিনিও ছিলেন রসায়নবিদ। দুরারোগ্য ক্যানসারে তিনি ১৯৪৯ সালে মারা যান। পরে নীলরতন ধরের অনুরোধে, এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় ‘এগ্রিকালচার কেমিস্ট্রি’ বিভাগটিকে ওখানে স্থানান্তরিত করে। তিনি সারা জীবনে যা অর্থ উপার্জন করেছেন, তা এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী, চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানে দান করে গিয়েছেন।
১৯৫০ সালে নীলরতন ধর মীরা চট্টোপাধ্যায়কে বিবাহ করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কর্মব্যস্ত জীবন যাপন করে গিয়েছেন। দীর্ঘ ৭০ বছরের কর্মজীবনে তাঁর তত্ত্বাবধানে প্রায় ১৫০ জন গবেষক ডি এসসি ও ডি ফিল ডিগ্রি পেয়েছিলেন। সারা জীবনে তিনি প্রায় ৬০০টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন।
১৯৮৬ সালের ৫ ডিসেম্বর ৯৪ বছর বয়সে বিজ্ঞানী নীলরতন ধর প্রয়াত হন। তাঁর মতো বিজ্ঞানী বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেলে, তা হবে বাঙালি জাতিরই অবমাননা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy