Advertisement
০১ নভেম্বর ২০২৪

যাঃ, পেনাল্টি মিস!

ফুটবলে কত রকমের ভুল হয়! চিন্ময়ের ব্যাকপাস। জার্নেল সিংহ-র সেমসাইড। কিংবা গোলপোস্টের জাল ছেঁড়া— তাই বাইরে থেকে বল ঢুকে গোওওওল!১৯৭৭ সালে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল বড় ম্যাচ। খেলা চলছে। আমি আচমকা আসা একটা বল ক্লিয়ার করতে পারলাম না। ফসকে, পায়ের ফাঁক দিয়ে গলে গেল। সেটা থেকে ভলি করে গোল পেয়ে গেল মিহির বসু। ম্যাচটা জিতে গেল লাল-হলুদ। আমাদের সমর্থকরা রেগে আগুন। আমায় কত যে গালিগালাজ হজম করতে হল কী বলব।

সুব্রত ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৬ ০০:৫৬
Share: Save:

১৯৭৭ সালে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল বড় ম্যাচ। খেলা চলছে। আমি আচমকা আসা একটা বল ক্লিয়ার করতে পারলাম না। ফসকে, পায়ের ফাঁক দিয়ে গলে গেল। সেটা থেকে ভলি করে গোল পেয়ে গেল মিহির বসু। ম্যাচটা জিতে গেল লাল-হলুদ। আমাদের সমর্থকরা রেগে আগুন। আমায় কত যে গালিগালাজ হজম করতে হল কী বলব। পরের বছরও একই কাণ্ড। ইস্টার্ন রেলের সঙ্গে একটা খেলায় আমরা দারুণ সুবিধেজনক অবস্থায়। ৫-০ জিতছি। একটা বল আবার কী ভাবে যেন চুক্কি দিয়ে আমার পায়ের তলা দিয়ে গলে গেল। অপোনেন্ট সেই থেকে ৫-১ করে দিল! ম্যাচ শেষে সে কী ঝামেলা! মোহনবাগান সমর্থকরা ছেঁকে ধরল আমাকে। বেশ ক’দিন ধরে চলল ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-সমালোচনা। আশ্চর্য লেগেছিল। যতই হোক, ম্যাচটা তো আমরাই জিতেছি, তাও বিশাল ব্যবধানে। মাত্র একটা গোল শোধ করতে পেরেছে বলে এমন তুলকালাম করার কী আছে! মোহনবাগান-পাগল সমর্থকরা এ সব বুঝতই না। যত দিন না অন্য একটা খেলায় রিকভারি হচ্ছে, মানে টিমকে জেতাতে পারছি, নিস্তার মিলত না।

ভাগ্যও সাহায্য করত না অনেক সময়। রেফারি ভুল ডিসিশন নিয়ে ঝামেলায় ফেলে দিতেন। ১৯৭৭ সালের মোহনবাগান আর কসমস-এর ম্যাচটা আমাদেরই জেতার কথা ছিল। জিতলে আবার ইতিহাসে ঢুকত মোহনবাগান। মাঠে আমরা তখন বুঝে গেছি, যে ভাবে খেলছি তাতে ভিজিটর টিমের বিপদ আছে। ২-১’এ এগিয়ে গেছি। এমন সময় সুধীর পেলেকে ট্যাক্‌ল করল। ওটা কখনওই ফাউল ছিল না। পেলে ক্লেম করল। রেফারি ছিলেন লক্ষ্মীনারায়ণ ঘোষ। পেনাল্টিটা দিয়ে দিলেন। গোল হয়ে গেল। পেলে আমাদের দিকে তাকিয়ে মহা ফুর্তিতে চোখ মটকাল। অর্থাৎ, কেমন ঠকলে! ম্যাচটা ২-২ ড্র হয়ে গেল।

উলটপুরাণও হয়েছে। ১৯৭৯-তে ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে ডার্বি। এক গোলে হারছি। চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের একটা ব্যাকপাস ধরে নিল আমাদের মানস ভট্টাচার্য। সেকেন্ডের মধ্যে গোলশোধ। ম্যাচ ড্র। আমরা অল্প হলেও হাঁপ ছাড়লাম। হারলে আরও দুর্ভোগ ছিল কপালে! ভাগ্যে চিন্ময় ভুলটা করল!

আজ ইউরোতে পেনাল্টি মিসের ফুলঝুরি দেখে চোখ কপালে তুলছেন? আপনাদের কি মনে আছে, ১৯৭৮-এর ফেডারেশন কাপের সেমিফাইনালে আমরাও ১১টা পেনাল্টি মিস করেছিলাম! কোয়েম্বাটোরে ছিল ম্যাচটা। ‘ইন্ডিয়ান টেলিফোন ইন্ডাস্ট্রি’-র এগেনস্টে। দারুণ খেলত টিমটা সেই সময়ে। সে ম্যাচ নির্ধারিত সময় পর্যন্ত ড্র রইল। তার পর পেনাল্টিতেও ফয়সালা হয় না। এ বারে মারছে, ও ওপর দিয়ে ওড়াচ্ছে, দু’পক্ষই সমানে মিস করছে। গোলকিপারও গেল পেনাল্টি নিতে। শেষে খেলা গড়াল সাডেন ডেথে। আমাদের শিবাজি একটা দারুণ সেভ করে দিল। ম্যাচ শেষ। আমরা ফাইনালে।

খুব স্বস্তি লাগে ভেবে, কেরিয়ারে কোনও দিনও সেমসাইড গোলের ব্র্যাকেটে আমার নামটা বসেনি। মাঠের বাইরে থেকে চেঁচামেচি করা হয়, ওর দোষ, ও ডুবিয়েছে, ওকে বার করে দে। কিন্তু আজ পর্যন্ত যতগুলো সেমসাইড গোল দেখেছি সব ক’টা অ্যাক্সিডেন্ট। তখন আমার আর প্রদীপ চৌধুরীর জুড়িকে লোকে বলত দেওয়াল। ভেদ করার সাধ্য ছিল না কোনও টিমের। প্রদীপ ইন্ডিয়ার ক্যাপ্টেন ছিল অনেক দিন। আমার যেমন ছিল বল ডিসট্রিবিউশন পাওয়ার, তেমনি ওর জোরের জায়গা ছিল গ্রাউন্ড কভারিং। এমন ফুটবলারের নামেও আত্মঘাতী গোল রয়েছে। ওর মাথায় লেগে বল ঢুকে গিয়েছিল আমাদেরই জালে। লিস্টে আছেন খোদ জার্নেল সিংহও। রোভার্স কাপ ফাইনালে সেমসাইড হয়ে গিয়েছিল জার্নেলদার ঝুঁটিতে লেগে।

আর একটা ভুলে ভরা ম্যাচ হয়েছিল ১৯৬৬-তে। মোহনবাগান মাঠে খেলা। অপোনেন্ট চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইস্টবেঙ্গল। আমাদের টিম পেনাল্টি পেয়েছে। কোনও এক দুর্বোধ্য কারণে বাঘা বাঘা প্লেয়াররা মারতে চাইল না। চুনিদা গেল না। জার্নেলদাও না করে দিল। শেষে সুশীল সিংহ মারল। গোল পেল না। স্টেডিয়াম তখন ফুঁসছে।

কাছাকাছি একটা কাণ্ড হয়েছিল কাশ্মীরে। ১৯৮৬। ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গেই ম্যাচ। ফুল টাইমে সেই ০-০। টাইব্রেকার শুরু হবে। সত্যজিৎ কিছুতে শট নেবে না। আমি চুলের মুঠি ধরে নিয়ে গিয়ে বলের সামনে দাঁড় করালাম। তার পর স্টেডিয়ামে বিস্ফোরণ! গোওওল!

আশির দশকে আমার সঙ্গে বল কাড়ার লড়াই চলত চিমা ওকোরি-র। ও তখন ইস্টবেঙ্গলে। ১৯৮৭-তে, এক বার, আমি একটা বলকে ট্যাক্‌ল করতে পারলাম না। চিমা ছাড়বে কেন। চিতার ক্ষিপ্রতায় বল ধরে গোলে ঢুকিয়ে মুঠি পাকিয়ে ছোটাছুটি করতে লাগল। দর্শকের বিষের সামনে দাঁড়ালাম আমি।

২০০১-এ একটা অদ্ভুত কাণ্ড হয়েছিল। সালগাওকরের সঙ্গে আমরা একটা ক্রুশিয়াল ম্যাচ খেলছিলাম। ওই ম্যাচে গোলপোস্টের নেট-টা এক জায়গায় ছেঁড়া ছিল। তাই বাইরে থেকে বল জালে ঢুকে গোল হয়ে গেল! ওই গোলটা খাওয়াতে আমাদের পরিস্থিতি বেশ কঠিন হয়ে গেল। জেতা তো হলই না, উলটে ড্র করে পয়েন্ট টেবিলে পিছিয়ে গেলাম। চার্চিল ব্রাদার্সের সঙ্গে পরের ম্যাচটা হয়ে গেল ‘ডু অর ডাই’।

পেনাল্টি মিস আমি নিজে খুব একটা করিনি। টাইব্রেকারে শেষ শটটা সাধারণত আমিই মারতাম। জীবনে কিছু না হোক দুশোটা পেনাল্টি মেরেছি। মিস করেছি জাস্ট দুটো। তাও মারাত্মক ভুল এক বারও হয়নি। ডুরান্ডে একটা হল না মনে আছে। তখন চার গোলে জিতছিলাম। ওই গোলটা না পাওয়ায় কিচ্ছু অসুবিধে হয়নি। আর একটা মিস্ড চান্সও ও-রকমই। গুরুত্বশূন্য।

ফ্রি-কিক, কর্নার— এই সব রিস্টার্ট মুভে, কী করা হবে, কোন দিকে মারা হবে, কে ধরবে, কী ভাবে বল জালে পাঠাবে, সব কিছু প্র্যাকটিসেই সেট করা থাকত। কিন্তু মাঠে অনেক সময় ভুল হয়ে যেত। হয়তো রেফারি বাঁশি দেওয়ার আগেই বলে লাথি কষিয়ে বসল। ব্যস। ক্যানসেল। আবার বল বসাও, এ বার ঠিক করে বাঁশি শোনো, তার পর মারো। এই ধরনের ভুল করলে, স্ট্র্যাটেজি ফাঁস হয়ে যাওয়ার চান্স বাড়ে। কারণ, প্রথম বার যখন কর্নারটা হচ্ছে, তখন তো অপোনেন্ট আমাদের পজিশনটা দেখে রেখেছে। ফলে, কে কোথায় দাঁড়াবে কোন দিকে বল আসবে অপোনেন্ট আন্দাজ করে নিতেই পারে। তাই তখন খুব সাবধান থাকতে হয়। ১৯৮১ সালে, নাগজি টুর্নামেন্টে এমন একটা গন্ডগোল হয়ে গিয়েছিল। বম্বের টাটা স্পোর্টস ক্লাব আর আমাদের মধ্যে ফাইনাল। ১-১ ড্র যাচ্ছে। সুরজিৎ সেনগুপ্ত ফ্রি-কিক নেবে। আর বসিয়েই মেরে দিয়েছে। রেফারি বাঁশিই দেয়নি তখনও। তাই আবার মারতে হল। কিন্তু সুরজিৎ তো দারুণ বুদ্ধিমান প্লেয়ার। ও তক্ষুনি প্ল্যান চেঞ্জ করে দিয়েছে। এ বার আমাকে টার্গেট করে মেরেছে। আমিও চাইনিজ ভলি মেরে বল জালে জড়িয়ে দিয়েছি। ওই গোলেই ফলাফল গেল আমাদের পক্ষে। ২-১’এ ট্রফি এল ক্লাব তাঁবুতে। ভাগ্যে রি-কিকটা হয়েছিল!

আমি নিজেও দেখেছি, দেশের জার্সি গায়ে মরণ-বাঁচন সিচুয়েশনে নার্ভ ধরে রাখা সত্যিই টাফ। ১৯৪৮ সালের লন্ডন অলিম্পিকে ইন্ডিয়া খালিপায়ে খেলেছিল। তাও ফ্রান্সকে কোণঠাসা করে দিয়েছিল। কিন্তু শেষরক্ষা হল কোথায়? ভিলেন আবারও সেই পেনাল্টি মিস। একটা মান্নাদা পারলেন না, আর একটা মহাবীর প্রসাদ। মান্নাদার শটটা আবার গোলে না গেলেও পৌঁছে গিয়েছিল রানির বাড়ি। বাকিংহাম প্যালেস!

বিশ্বকাপের মঞ্চে আবার বরাবরই গোলের ভুল আর ভূতুড়ে গোল গন্ডায় গন্ডায়। তাই নিয়ে অভিযোগের পাহাড়। ১৯৬৬ বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠেছিল ইংল্যান্ড আর পশ্চিম জার্মানি। ঘরের মাঠে ফাইনালটা ইংল্যান্ড জিতল বটে, কিন্তু বিতর্ক পিছু ছাড়ল না। অ্যালান বল একটা ক্রস দিয়েছিলেন জিওফ হার্স্টকে। হার্স্ট গোলের বেশ কাছে দাঁড়িয়ে। বলটা ধরেই পলকের মধ্যে লাট্টুর মতো ঘুরে মারলেন। বল যাচ্ছে গোলের দিকে। কিন্তু পুরোটা ঢুকল না। বারপোস্টে লেগে নেমে এল গোললাইনের ওপরে। অনেকটা সময় নেওয়ার পর রেফারি শেষমেশ গোলের বাঁশি বাজালেন। গোলটা বৈধ ছিল কি না, তাই নিয়ে আজও বিস্তর চেঁচামেচি হয়। ইংল্যান্ড বলে, সে দিন পোস্টের পাশেই ছিলেন রজার হান্ট। তিনি তো রেফারির সিগনাল পাওয়ার আগেই পাক দিয়ে দিয়ে সেলিব্রেশন শুরু করে দিয়েছিলেন। গোল না হলে সেটা করতেন না। বরং বলটাকে আবার কন্ট্রোলে আনার চেষ্টা করতেন। জার্মানি বলে, ওটা নিখাদ প্লে-অ্যাক্টিং। তাদের খেলোয়াড়রাও লাইনের চকের গুঁড়ো উড়তে দেখেছিলেন। দাগের ওপর পড়েছে, মানে লাইন পেরোয়নি। অর্থাৎ গোল হয়নি। ভুল ডিসিশন।

এ রকম আর একটা ঝগড়া আছে ইতালিয়ানদের। ২০০২ জাপান-কোরিয়া বিশ্বকাপে তাদের গোলের দাবিগুলো পর পর খারিজ হয়ে যাচ্ছিল। যার জন্য কোয়ার্টার ফাইনালেও যেতে পারেনি ভিয়েরি-মালদিনির টিম। কোরিয়ার কাছে হেরে দেশে ফিরেছিল। কারণটা শুধুই ‘ম্যানুয়াল এরর’, না অন্য কিছু, তাই নিয়ে প্রচুর ঠোকাঠুকি আজও চলে।

এ বারের ইউরো আর কোপা আমেরিকায় মেসি-শোয়েনস্টাইগার-জাজা’র ভুলভাল শটগুলো আমাকেও তাজ্জব করে দিয়েছে। এরা এতটাই দক্ষ, টেকনিকালি স্ট্রং, প্ল্যানিংয়ে এমন ক্লিনিকাল, ওদের লেভেলে এ ভাবে আনতাবড়ি চালানোটা নেওয়া যায় না। কিন্তু তার পরও তো ওরা মানুষ। হয়তো আধ-মুহূর্তের জন্য অ্যাপ্রোচটা ক্যাজুয়াল হয়ে গেছে, কিংবা অত্যধিক সিরিয়াস হয়ে গেছে। মুলার যেমন। ওর রান-আপ’টাই যেন বড্ড ক্যাজুয়াল। আর জাজা যেন ওভার-কনফিডেন্ট। শটটা মারার আগেই রেজাল্টটাকে দেখতে পাচ্ছে। ফলে নার্ভটাকে ঠান্ডা রাখতে পারছে না। এ সব পর্যায়ে মানসিক চাপও তো অমানুষিক রকমের বেশি থাকে। মনটাকে ঠিক না রাখতে পারলে টেকনিকাল মিসটেক হয়ে যায়। স্টেপিংয়ের ছোট্ট একটা ভুলেই শটটা উনিশ-বিশ। আর গোলটা মিস!

অন্য বিষয়গুলি:

football subrata bhattacharya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE