Advertisement
১৭ মে ২০২৪
পান্তা ভাতে…

শট নিতে নিতে কাঁচি

নিতান্তই এক জন এডিটর। কিন্তু সেই সময়, মানে দেবানন্দ, গুরু দত্ত, দিলীপকুমার যে সময় বলিউড কাঁপাচ্ছেন, তখনকার বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এক জন এডিটর যে স্টার হতে পারেন, এ তাঁকে না দেখলে বিশ্বাস করা দায়। তিনি এবং আমি ছিলাম গুরুভাই।

গুলজার
শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৫ ০১:০৪
Share: Save:

নিতান্তই এক জন এডিটর। কিন্তু সেই সময়, মানে দেবানন্দ, গুরু দত্ত, দিলীপকুমার যে সময় বলিউড কাঁপাচ্ছেন, তখনকার বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এক জন এডিটর যে স্টার হতে পারেন, এ তাঁকে না দেখলে বিশ্বাস করা দায়। তিনি এবং আমি ছিলাম গুরুভাই। আমরা বিমল রায়ের কাছে একসঙ্গে কাজ করেছি। আমি ছিলাম বিমলদার অ্যাসিস্ট্যান্ট, আর উনি এডিটর। ভদ্রলোকটি পরে পরিচালক হয়ে ‘নমকহারাম’, ‘গুড্ডি’, ‘গোলমাল’, ‘খুবসুরত’, ‘মুসাফির’, ‘চুপকে চুপকে’ এবং আরও অনেক এমন সিনেমা বানিয়েছিলেন। এবং বানিয়ে সারা দেশের নয়নের মণি হয়ে উঠেছিলেন হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়।

খুব লম্বা। আর লম্বা লম্বা চিন্তাভাবনা। মধ্যবিত্ত যাপন আর নিম্নবিত্ত বাজেট নিয়ে উচ্চমানের ছবি— হৃষীদার অভিজ্ঞান। আমি তাঁর সঙ্গে প্রচুর কাজ করেছি। কোনও সিনেমায় লেখক হিসেবে কিংবা ডায়লগ রাইটার হিসেবে, কখনও বা অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে। প্রচুর শিখেছি, প্রচুর তর্ক করেছি, আর ভরপুর সিনেমা বানিয়েছি এক সঙ্গে।

হৃষীদার কাছে স্মল বাজেটের সংজ্ঞাটাই ছিল ওঁর নিজের মতো। হৃষীদা নিজের বাড়ির ড্রইংরুমে সেট লাগালেন, কিছু ক্ষণ পর সেখান থেকে চেয়ার টেবিল সরে গিয়ে অন্য এক সেট চেয়ার টেবিল এল— সেটা হল তখন মূল চরিত্রের অফিসঘর। তার কিছু পরে অফিসের ফার্নিচার সরে গিয়ে খাট ঢুকে পড়ল, সেটা তখন হল বেডরুম। হৃষীদার শালা ছিলেন আর্ট ডিরেক্টর, তাঁকে এই সব ঝামেলা অহরহ পোয়াতে হত। এক এক সময় হৃষিদা বলে উঠতেন, ‘অ্যাই, দুটো দেওয়াল রং করে দাও তো চট করে।’ তা না হলে দু’বার দেখানো দেওয়ালে আর অন্য বাড়ি বোঝানো যাবে না। অতএব একই ঘরে বিভিন্ন ঘর এবং অন্য বাড়িও দেখানো হয়ে গেল। বাজেট কী করে স্মল থেকে স্মলতর করতে হয় হৃষীদাকে দেখে শেখার।

‘খুবসুরত’ সিনেমায় একটা গানের দৃশ্য শুট করতে হবে। সেই গানের মধ্যে আবার একটা নাটক মঞ্চস্থ করার ব্যাপারও রয়েছে। হৃষীদা আর্ট ডিরেক্টরকে বললেন, ‘কী ভাবে কম খরচে করা যায় ভাবো। একটা দু’মিনিটের গানের দৃশ্যের জন্য আমি স্টুডিয়ো ভাড়া করতে পারব না। অনেক খরচ হয়ে যাবে।’ আর্ট ডিরেক্টর অনেক ভেবে বাড়ির ছাদে দৃশ্যটি শুট করার কথা বললেন। হৃষীদা যেন হাতে চাঁদ পেলেন, ‘এই তো, ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া। ছাদে জলের ট্যাঙ্ক, পাইপ আর খোলা জায়গা নিয়ে পুরো আলাদা একটা ক্যারেক্টার তৈরি হয়ে গেছে।’ তাই করা হল। কেবল দুটো বড় কাগজের কাটআউট দিয়ে আর কাপড় দিয়ে তৈরি হয়ে গেল মঞ্চ। এমনকী সিনেমায় ওই গানটা দেখার সময় মনে হয় যেন আত্মীয়তা আরও খানিক আঁটো হল ওই পরিবেশ পেয়ে।

কাজ করতে করতে বুঝতে পারতাম কেন হৃষীদা স্টার এডিটর ছিলেন। হৃষীদার মগজ থেকে কত রকম যে ব্রিলিয়ান্স ঝড়ে পড়ত টুপটাপ করে, বলে শেষ করা যাবে না। ‘নমকহারাম’ ছবির একটা গানের দৃশ্য শুট হবে। রাজেশ খন্না আর অমিতাভ বচ্চন-এর ডুয়েট সম্ভবত। রাজেশ খন্না সুপারস্টার তখন। এসে পৌঁছয়নি। অমিতাভ চলে এসেছে। হৃষীদা বললেন, শুটিং শুরু করো। বলে কী লোকটা! রাজেশ খন্না ছাড়া কী করে হবে শুট! ধমকে বললেন, ‘বলছি না শুরু করো! প্রথমে অমিতের বাঁ দিক থেকে ডান দিক ক্যামেরা যাবে, ওই একই লাইন রাজেশকে শুট করার সময় ক্যামেরা ডান দিক থেকে বাঁ দিক যাবে। দু-তিনটে জয়েন্ট শট নিলেই হয়ে যাবে।’ আর তা-ই হল। আর দারুণ হল। এই ভাবে যে একটা ক্রাইসিসকে কাজে লাগানো যেতে পারে, আমরা কোনও দিন ভাবতে পারতাম না।

লোকে বলে, ‘এডিটিং টেবিলে আমার রোল বা ডায়লগ ইচ্ছে করে কাঁচি করেছে।’ কিন্তু হৃষীদা শট নিতে নিতে কাঁচি চালাতেন। ডিরেক্ট করার সঙ্গে সঙ্গে এডিট করতেন মনে মনে। এত শার্প ফোকাস ছিল। রাজেশ খন্নাকে নিয়েই কোনও একটা সিনেমার শুটিং। শটের শেষে হৃষীদা কাট বললেন। আর সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘নেক্সট শট রেডি করো।’ রাজেশ এসে বলল, ‘আর এক বার শটটা নিতে হবে। আমি শেষ ডায়লগটা বলতে ভুলে গিয়েছি।’ হৃষীদা বললে,‘আমি জানি তো। কিন্তু ওটা নিয়ে ভেবো না। ওটা পরের সিনের সঙ্গে ওভারল্যাপ করে যাবে।’ এমন ঝকঝকে মাথা চলত হৃষীদার। তখন রাজেশ খন্নার মতো এক জন সুপারস্টারকে তার ডায়ালগ বলতে না দিয়ে পরের শটে চলে যাওয়ার মাস্তানি হৃষীদাই দেখাতে পারতেন। ইন্ডাস্ট্রির সমস্ত লোকের সঙ্গে আশ্চর্য র‌্যাপো ছিল ওঁর। হেন কোনও বড় হিরো-হিরোইন নেই যাঁর সঙ্গে হৃষীদা কাজ করেননি। দিলীপকুমার, রাজ কপূর, দেবানন্দ, গুরু দত্ত, নূতন, ওয়াহিদা— সবাই।

সবই ভাল, কিন্তু দাবার নেশায় পেলে হৃষীদাকে খুঁজে পাওয়া দায়। সেটেই মাঝেমধ্যে দাবা খেলতে বসে যেতেন। তখন আর কিচ্ছু খেয়াল থাকত না। এমনও হয়েছে, আমায় বলেছেন, ‘গুল্লু, তুম শট লে লো।’ মন তখন রাজা বাঁচানোয়। আমি শট নিতে গেলাম। এক বার এসে বললাম, ‘দাদা এ দিকে আলো লাগাচ্ছি।’ উত্তর এল, ‘হুঁ।’ পরের বার গেলাম, ‘ট্রলি পাতছি, ঠিক আছে তো?’ ফের, ‘হুঁ।’ আরও এক বার গিয়ে যেই বলেছি, ‘ভাবছি, এই ডায়ালগের পর ক্যামেরাটা বাঁ দিকে প্যান করব’— প্রচণ্ড রেগে উঠে বললেন, ‘গুল্লু, এ বার কি আলাদা করে মাইনে দিতে হবে, তবে তুই এই শটটা নিবি?’ আমি হাওয়া বুঝে গেলাম, নিশ্চয়ই রাজা ঝামেলায় পড়েছে। হৃষীদার ধর্মসংকট তখন, রাজা বাঁচাবেন না কি শট নেবেন। হৃষীদা রাজা বাঁচানোই শ্রেয় মনে করেছিলেন, কারণ শটটা আমিই নিয়েছিলাম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE