Advertisement
২৪ মে ২০২৪
Bengali Serial Novel

খরস্রোত

কনকবালা আসেনি। দিদির কাছে ছোটমামার অনেক প্রশংসা শুনলেও, লোকটাকে ভাল লাগে না শশিকান্তর। মনে হয়, এই বুঝি একটা পেল্লাই ধমক দিলেন।

ছবি কুনাল বর্মণ।

ছবি কুনাল বর্মণ।

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০২৪ ০৭:৫৯
Share: Save:

কনকবালার চোখে জল দেখে উষাপতি তাকে বুকে টেনে নিলেন। বললেন, “দূর পাগলি, কাঁদছিস কেন? আমি তো আছি। কলকাতায় গেলে, তোর সঙ্গে দেখা করে আসব। ভাল করে লেখাপড়া কর। জেনে রাখবি, মেয়েদের লেখাপড়া শেখাটা খুব দরকার।”

এ বার কনকবালা আসেনি। দিদির কাছে ছোটমামার অনেক প্রশংসা শুনলেও, লোকটাকে ভাল লাগে না শশিকান্তর। মনে হয়, এই বুঝি একটা পেল্লাই ধমক দিলেন। অনেকটা তাদের স্কুলের অনিল স্যরের মতো। দেখতেও দু’জনকে অনেকটা এক রকম। শুধু অনিল স্যরের গোঁফটা আরও পুরু।

দিদি তাকে বলেছে, “তুই ছোটমামাকে ভয় পাস কেন? ছোটমামা বাঘ না ভাল্লুক?”

এ কথার কোনও উত্তর দেয়নি শশিকান্ত। শুধু মনে মনে ভেবে রেখেছে, এ বার ছোটমামার সঙ্গে অনেক গল্প করবে। ছোটমামার থেকে রবিঠাকুর সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে নিয়ে স্কুলে এসে সেগুলো গল্প করবে।

ছোটমামার ঘরে ঢুকে শশিকান্ত দেখে, বাবা আর ছোটমামা গল্পে মশগুল। শশিকান্তকে দরজার বাইরে দেখে রমানাথ ইশারায় ডাকেন। উষাপতিকে দেখিয়ে প্রণাম করতে বলেন। তার পর জিজ্ঞেস করেন, “তুমি জানো, ইনি কে?”

“লেখক,” শশিকান্ত উত্তর দেয়।

রমানাথ ও উষাপতি দু’জনেই হেসে ওঠেন। রমানাথ বলেন, “লেখক তো বটেই, উনি তোমার ছোটমামা হন, সেটা জানো কি?”

শশিকান্ত ঘাড় কাত করে জানায় যে, সে জানে।

“উনি যে লেখক, সেটা কে বলল তোমায়?” রমানাথ বলেন।

“দিদি,” শশিকান্ত বলে।

“দিদিকে নিয়ে এলে না কেন এ বার?” উষাপতি বলেন।

“দিদিকে পিসি আসতে দিল না,” শশিকান্ত বলে।

“পিসি?” অবাক হয়ে রমানাথের দিকে তাকান উষাপতি।

“আমার বোন, মানে, নিভাননী। ওদের পিসি। বিধবা হয়ে থেকে আমার কাছেই আছে। ছেলেপুলে হয়নি, ওদেরই নিজের ছেলেমেয়ে জ্ঞান করে,” রমানাথ বলেন।

“ও আচ্ছা,” বলে শশিকান্তকে কাছে ডাকেন উষাপতি।

কাছে এসেই শশিকান্ত বলে, “তুমি নাকি রবিঠাকুরকে চেনো?”

উষাপতি হেসে ফেলেন। বলেন, “চিনি তো। তুমি যাবে তাঁর কাছে?”

শশিকান্ত দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় যে, সে যাবে না।

উষাপতি শশিকান্তকে তার স্কুল সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেন। বলেন, “তোমার নতুন স্কুল কেমন লাগছে?”

“ভাল,” বলেই শশিকান্ত দৌড়ে একটা ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ঘুরে উষাপতিকে প্রশ্ন করে, “আমার মার ছবি এখানে কেন?”

“তোমার মা যে আমার বোন,” উষাপতি বলেন, “যেমন তুমি আর তোমার দিদি, তেমনই আমি আর তোমার মা। যাক, তুমি খেয়েছ কিছু? চলো, আমার সঙ্গে বেরোবে। রমানাথ, তুমি বিশ্রাম নাও। আমি ভাগ্নেকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি।”

উষাপতি শশিকান্তকে নিয়ে ঘরের বাইরে বের হন। রাখোমণির প্রসঙ্গ এলে আজও তার ভিতরে একটা অদ্ভুত কষ্ট হয়। অনেক দিন ভেবেছেন তাঁর ঘরের দেয়ালে টাঙানো রাখোর ছবিটাকে সরিয়ে দেবেন। কিন্তু পারেননি। মনের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব কাজ করে।

পিঠোপিঠি ভাইবোন রাখোমণি আর উষাপতি। উষাপতি বড়। তাই কান মুলে দেওয়া, চুল ধরে টানা— এগুলো ছিল তাঁর অধিকার। রাখোমণি মায়ের কাছে উষাপতির নামে নালিশ জানালেও কোনও কাজ হত না। কারণ, মা সব সময় উষাপতির পক্ষেই থাকতেন।

বাবার বদলির চাকরি। আজ পটনায়, তো কাল দিল্লিতে। বাড়িতে থাকলে, রাখোমণির শেষ আশ্রয় বাবা অঘোরনাথ মুখোপাধ্যায়। বাবার কাছে বকুনি খেয়ে মাথা নিচু করে যখন দাঁড়িয়ে থাকত উষাপতি, রাখোমণির ঠোঁটের ফাঁকে হাসির রেখা দেখা দিত। আবার জ্যৈষ্ঠের দুপুরে আম কুড়োনোর ধুমে দাদার সঙ্গ তার চাই-ই। আম কুড়িয়ে ফিরে এসেই আবার ঝগড়া। রাখোমণি যদি বলে সে দশটা আম কুড়িয়েছে, উষাপতি দাবি করে, সে এগারোটা আম কুড়িয়েছে। একটা বেশি। অথচ, তাদের কাছে মোট উনিশটা আম আছে। অনেক সময় রাখোমণি নিজেই মিটিয়ে নিত ঝগড়া। বলত, “আচ্ছা বাবা, মেনেই নিলাম, তুমি এগারোটা আমই কুড়িয়েছ।”

“কিন্তু এখানে তো উনিশটা আম। তুমি দশটা কুড়িয়ে থাকলে, আরও দুটো কোথায়?” উষাপতি যুক্তি দিত।

“দুটো আম পড়ে গেছে,” রাখোমণি হাসতে হাসতে বলত।

উষাপতিও হেসে উঠত এ কথায়। ছাদের চিলেকোঠার ঘরে দুই ভাইবোন মেতে উঠত আম খাওয়ায়।

উষাপতিকে আর ভয় পাচ্ছে না শশিকান্ত। বরং, তার ভালই লাগছে উষাপতির সঙ্গ। হাঁটতে হাঁটতে তারা একটা সুবিশাল আম গাছের নীচে দাঁড়ায়। অনেক দিন পর উষাপতি বাগানে এল। বোঝাই যাচ্ছে, বাগানটার আর আগের মতো যত্ন হয় না। একটি লোক রাখা আছে, সে কী করে, কেউ তার খোঁজ রাখে না। হঠাৎ শশিকান্ত বলে ওঠে যে, সে আম গাছে উঠবে। উষাপতি তাকে নিবৃত্ত করার আগেই সে তরতর করে গাছে উঠে যায়। উষাপতি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ছোট্ট বালকের দিকে। রাখোমণিও এই ভাবে গাছে উঠে যেত। গাছের উপর থেকে মুখ ভেংচে বলত, “এ মা! গাছে উঠতে পারে না।”

অপমানে দগ্ধ হয়ে বালক উষাপতি বলত, “এই মেয়ে গাছে ওঠে/ বাঁদরপানা ভেংচি কাটে।”

নাহ! আর আসবে না এখানে। স্মৃতি বড়ই নিষ্ঠুর। শশিকান্ত গাছ থেকে নেমে এলে তার হাত ধরে, লম্বা লম্বা পা ফেলে বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করেন উষাপতি।

সকাল থেকেই অাকাশ মেঘলা। থেকে থেকে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির ছাঁট যাতে না রেলের কামরায় ঢুকে বসার জায়গা ভিজিয়ে দেয়, তাই জানলা বন্ধ করেছে যাত্রীরা। বন্ধ করতে করতে, এক জন যাত্রী উষাপতিকে শুনিয়ে বলেছে, “এই জন্য আমাদের কিছু হয় না। একটু উঠে জানলা বন্ধ করবে, সেটাও পারে না।”

উষাপতি বোঝেন, তাকেই উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, তবু নিরুত্তর থাকেন। তার মাথায় তখন অনেক চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, এই বৃষ্টিতে কলকাতার রাস্তাঘাট কেমন থাকবে, আদৌ আজকের সভা হবে কি না। কলকাতায় এ বার তার আসার দু’টি উদ্দেশ্য। প্রথম উদ্দেশ্য নিছকই একটি সভায় উপস্থিত থাকা। অ্যান্টনিবাগান লেনে মৌলবি আবদুর রহমান খানের বাড়িতে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি স্থাপনের জন্য এই সভা।

উষাপতি এখানে আমন্ত্রিত। আমন্ত্রণ জানিয়েছেন খানসাহেব নিজেই। পত্রে তিনি উল্লেখ করেছেন কবি নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও কুমুদরঞ্জন মল্লিকের কথা। এঁরাও এই সভায় আমন্ত্রিত। এঁদের মধ্যে কুমুদরঞ্জনের সঙ্গে আলাপ থাকলেও, বাকি দু’জনের সঙ্গে আলাপ নেই উষাপতির। এই সভায় সেটাও সেরে ফেলতে হবে। দু’জনেরই কবিতার সঙ্গে পরিচিত উষাপতি। সম্প্রতি সত্যেন্দ্রনাথের লেখা একটি কাব্যগ্রন্থ তাঁর হাতে এসেছে। বইটির নাম ‘কুহু ও কেকা’। এখনও পড়া হয়ে ওঠেনি উষাপতির। সময় পেলেই পড়বেন। নজরুল ইসলামের কথা কুমুদরঞ্জনের কাছে শোনা। বর্ধমানে এই ছেলেটিকে তিনি পড়িয়েছেন। ভাষা শিক্ষার প্রতি অসীম আগ্রহ ছেলেটির। তবে স্বভাব বড়ই খামখেয়ালি।

কুমুদরঞ্জন এক দিন কথায় কথায় বলেছিলেন উষাপতিকে, “এই নজরুল ছোকরাটি বড়ই প্রতিভাবান হে! তুমি দেখে রেখো উষাপতি, এ এক দিন বড় কবি হবে। অনেক নাম হবে। তবে, বড্ড খামখেয়ালি। কখন যে কী করে! কবিতা চর্চার বিষয়। অনুশীলনে খামতি থাকলে, যতই প্রতিভা থাকুক না কেন, কিছু করে ওঠা মুশকিল।”

এই দু’জনের সঙ্গে আলাপ করা ছাড়াও, উষাপতির কলকাতা আসার আর একটি উদ্দেশ্য হল, নাটোরের মহারাজ জগদিন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গেও দেখা করা। মহারাজ ‘মানসী’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। অপর একটি পত্রিকা ‘মর্মবাণী’-র সঙ্গেও তিনি যুক্ত। এই পত্রিকাটি সাপ্তাহিক। মহারাজের ইচ্ছে দু’টি পত্রিকার সংযুক্তিকরণ। নামও তিনি ঠিক করে ফেলেছেন। নতুন নাম হবে ‘মানসী ও মর্মবাণী’। উষাপতিকে চিঠি দিয়ে তিনি অনুরোধ করেছেন নতুন পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়ভার গ্রহণ করতে। সম্পাদনার দায়িত্ব নিতে খুব আগ্রহী নন উষাপতি। হাতে তাঁর অনেক কাজ। সম্প্রতি একটি উপন্যাসে হাত দিয়েছেন। এ ছাড়া নিজের ওকালতি পেশা আছে। সব দিক বজায় রেখে পত্রিকা সম্পাদনাতে কতটা সময় দিতে পারবেন তাতে সন্দেহ আছে। তবে মহারাজের অনুরোধ আদৌ উপেক্ষা করা সম্ভব হবে কি না, তিনি জানেন না। তবু এক বার
দেখা করে, সব কিছু বুঝিয়ে বলতে হবে মহারাজকে।

উষাপতি অনুভব করেন, রেলের গতি ক্রমশ মন্থর হচ্ছে। তার মানে, হাওড়া স্টেশন অনতিদূরে। বেশ কয়েক বছর হল স্টেশনটির কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে। বছর পনেরো আগেও স্টেশন বলতে সরু এক ফালি টিনের ছাউনি দেওয়া একটা প্ল্যাটফর্ম ছিল। এখন সেখানে ছ’টি প্ল্যাটফর্ম। সারা দিন যে কত যাত্রী যাতায়াত করে, তার ইয়ত্তা নেই। নতুন স্টেশন চত্বরটিও সুন্দর। রোমান স্থাপত্য রীতিতে গড়ে ওঠা লাল রঙের স্টেশনটি উষাপতিকে খুব আকর্ষণ করে।

ট্রেন স্টেশনে ঢুকছে। যাত্রীদের ব্যস্ততা নজর এড়াল না উষাপতির। বাক্সপ্যাঁটরা কে কার আগে নামাবেন, তার প্রতিযোগিতা চলছে। তাঁর নিজের কোনও ব্যস্ততা নেই। একা মানুষের উপকরণ সামান্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র আর গুটিকয়েক জামা-প্যান্ট ভরা একটা ছোট সুটকেস তিনি বহন করছেন। সুটকেসটি সিটে রেখে উষাপতি উঠে দাঁড়িয়েছেন। সবাই নেমে গেলে ধীরেসুস্থে নামবেন।

“ও মশাই, আপনার নামার ইচ্ছে নেই না কি?”

প্রশ্নটা শুনে উষাপতি চমকে পিছনে তাকালেন। এক মাঝবয়সি ভদ্রলোক ঠিক তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে। প্রশ্নটি তাঁকেই করা কিনা সংশয় থাকাতে, উষাপতি লোকটিকে বললেন, “আমাকে বলছেন?”

“আপনাকে নয়তো কাকে বলব? চলুন, চলুন, শিগগির এগোন সামনে। এক্ষুনি আবার ভিড় শুরু হবে। পরের ট্রেনের প্যাসেঞ্জাররা উঠে পড়বে,” লোকটি বলে।

উষাপতি আর বাক্যব্যয় না করে সামনের দিকে এগিয়ে যান। এখন বৃষ্টি পড়ছে না। আকাশের মেঘলা ভাবটা অনেকটাই কেটে গেছে। কিন্তু হাওড়া স্টেশনের বাইরে বেশ জল জমেছে। এই জলের মধ্যেই যাত্রীরা দিব্যি হেঁটে চলেছে থপথপ করে। উষাপতি চিন্তায় পড়ে গেলেন। তার পরনে পাশ্চাত্যের পোশাক। এই পোশাকেই তিনি অভ্যস্ত। ছাত্রাবস্থায় ধুতি পরলেও, এখন মূলত পেশার কারণে অভ্যাস বদলেছে। অথচ, এখন তিনি ধুতি পরার প্রয়োজন অনুভব করলেন। ধুতি পরা থাকলে, দিব্যি অন্য যাত্রীদের মতো জলের মধ্যেই হেঁটে যেতে পারতেন।

“যাবেন কোথায়?”

উষাপতির পাশে ট্রেনের সেই লোকটি এসে দাঁড়িয়েছে। উষাপতি ভাল করে লক্ষ করলেন লোকটিকে। মাঝারি উচ্চতা। এক মুখ কাঁচাপাকা দাড়ি। দারিদ্রের চিহ্ন স্পষ্ট।

“ন’নম্বর অ্যান্টনিবাগান লেন,” উষাপতি বেশ বিরক্তির সঙ্গে জানান।

“মৌলবি সাহেবের বাড়ি।”

“চেনেন আপনি?”

“সে কী! কেন চিনব না? অ্যান্টনিবাগানের মৌলবি আবদুর রহমান খানকে কলকাতার কে না চেনে? কিন্তু উনি তো খুব বড় মানুষ। তার মানে আপনি... মশায়ের কী করা হয় জানতে পারি?”

“ওকালতি। সঙ্গে একটু লেখালিখি। গল্প, উপন্যাস।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, মৌলবি সাহেবও লেখালিখি করেন শুনেছি। আপনি এখন সেখানে যাবেন কী করে?”

“সেটাই তো ভাবছি।”

“রাস্তায় জল না থাকলে বলতাম— হেঁটে চলে যান। কিন্তু এই জলে হাঁটলে, আপনার প্যান্ট আর জুতোর বারোটা বেজে যাবে। আপনি বরং ওই জিন রিকশায় যান। দিব্যি টুংটাং শব্দ শুনতে শুনতে পৌঁছে যাবেন। বলেন তো আমি ডেকে আনতে পারি।”

উষাপতি তাকিয়ে দেখেন, অনতিদূরে বেশ কয়েকটি অদ্ভুত যান যাত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কয়েক বছর হল এই যানটিকে কলকাতার রাস্তায় দেখা যাচ্ছে। আগে মাল পরিবহণের জন্য ব্যবহার করা হত। সম্প্রতি ব্রিটিশ সরকার যানটিকে যাত্রী পরিবহণে অনুমতি দিয়েছে।

উষাপতির অনুমতির তোয়াক্কা না করে, লোকটি একটি জিন রিকশা ডেকে এনেছে। রিকশাওয়ালা অবাঙালি। সম্ভবত চিন দেশীয়। কিন্তু ভাল বাংলা জানে, তার সঙ্গে বাংলাতেই কথা বলছে। কোথায় যেতে হবে, রিকশাওয়ালাকে সেটা বুঝিয়ে, লোকটি এ বার উষাপতিকে তাড়া দেয়, “নিন, এ বার উঠে পড়ুন। কোনও ভয় নেই। আপনি উঠলে, আমি আপনার বাক্সটা তুলে দেব।”

প্যান্ট আর জুতো যতটা জলের হাত থেকে রক্ষা করা যায়, ততটা করে, উষাপতি রিকশায় উঠে বসেন। উষাপতির বাক্সটাও রিকশায় তুলে দেয় লোকটি। তার পর উষাপতিকে অবাক করে নিজেও উঠে পড়ে রিকশায়। উষাপতি বাধ্য হয়ে একটু সরে বসেন।

“আসলে ওই অ্যান্টনিবাগানের কাছেই থাকি কি না। আপনি যখন ও দিকে যাচ্ছেনই... হেঁ হেঁ... কিছু মনে করলেন না তো?” লোকটি দেঁতো হাসি হেসে বলল।

উষাপতি কোনও উত্তর দিলেন না। জলের মধ্যে এই নতুন যানটিতে চড়ে ভ্রমণ তার মন্দ লাগছে না। চিনা রিকশাওয়ালার হাতে একটা ঘুঙুর। তা থেকে মাঝে মাঝে টুংটাং শব্দ আসছে। শব্দের অনুরণনটা বেশ লাগছে উষাপতির। প্রায় সব রাস্তাতেই জল। বৃষ্টিটাও তো কম হয়নি! চিনা রিকশাওয়ালাটি প্রশস্ত হ্যারিসন রোড দিয়ে আসছিল। এ বার সে একটি গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল।

ট্রেনের সেই লোকটি এত ক্ষণ কোনও কথা বলেনি। এই বার বলল, “এই পাড়াটির নাম কলেজ স্ট্রিট। আজ বৃষ্টিবাদলার দিন বলে ভিড় নেই। অন্য দিন হিন্দু কলেজের ছেলেরা ভিড় করে। সংস্কৃত কলেজের ছেলেছোকরারাও ভিড় করে, তবে তাদের সংখ্যা কম।”

খানিকটা এগিয়ে বাঁ দিকে ঘোরার মুখেই ডান দিকে একটি বাড়ি দেখিয়ে লোকটি বলল, “এই বাড়িটি চেনেন?”

উষাপতি এত ক্ষণ চুপ করে ছিলেন। এ বার বললেন, “অ্যালবার্ট হল। এই জায়গাটি আমার অচেনা নয়। তা মহাশয়ের নাম কী?”

“আমাকে এত সম্মান দিয়ে কথা বলবেন না। আমি অতি সাধারণ মানুষ। অধমের নাম নিবারণ। নিবারণ দত্ত। কায়েত। তা, আপনার নামটাও তো জানা হয়নি।”

“উষাপতি মুখোপাধ্যায়।”

“বলেন কী! আপনি বামুন, আবার কুলীন? ছি ছি, কী রকম আক্কেল দেখুন আমার! কুলীন বামুনের সঙ্গে এক সঙ্গে রিকশ করে যাচ্ছি!”

উষাপতি সান্ত্বনার সুরে বলে, “তাতে কী হয়েছে? তা ছাড়া আপনি জানবেনই বা কী করে আমি বামুন না কায়েত। তা কী করা হয় আপনার?”

“কিছুই না। করতাম তো একটা সদাগরি অফিসে কেরানির চাকরি। কিন্তু হঠাৎ চাকরিটা চলে গেল।”

“কেন?”

“সে অনেক কথা। পরে এক দিন দেখা হলে বলব’খন। দাঁড়াও রিকশা, আমি এইখানে নামব।”

লোকটি রিকশাওয়ালাকে দাঁড় করিয়ে নেমে যায় এক জায়গায়। যাওয়ার সময় বলে, “আপনি তো বড় মানুষ। অনেক জানাশোনা। দেখুন না, কাউকে বলেকয়ে আমার জন্য একটা চাকরি জোগাড় করা যায় কি না।”

নিবারণ দত্ত চলে যায়। টুংটাং শব্দে রিকশা অ্যান্টনিবাগানের দিকে এগোতে থাকে।

গ্রীষ্মের দুপুর। মাথার উপর প্রখর রোদ ঝলসে উঠেছে। আদিগন্ত চরাচর যেন পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় জনমানুষের চিহ্ন নেই। সমস্ত পাড়াটা যেন ঝিমিয়ে পড়েছে এ সময়ে। শুধু ওরা ছাড়া। ওদের কাছে এটাই সুযোগ। ওরা মানে ঈশান আর বিশু, সঙ্গে শশিকান্ত।

স্কুলের গরমের ছুটি পড়ে গেছে। তাই হাতেও অঢেল সময়। বিশু আর ঈশানকে ভূতুড়ে বাড়িটার কথা বলেছিল শশিকান্ত। পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢুকতে বিশু এক কথায় রাজি হলেও, ঈশান রাজি হচ্ছিল না প্রথমে। কারণ ওই বাড়িতে যে অশরীরী আত্মা ঘুরে বেড়ায়, সে ব্যাপারে সে এক রকমের নিশ্চিত।

তা ছাড়া, বাড়ির ভিতরে যদি আম, লিচুর গাছ না থাকে, তা হলে কেনই বা ভিতরে ঢোকা। বিশু বলেছিল ঈশান গেলে সেও যাবে। ঈশান না গেলে তার যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। কারণ, শশিকান্তের সাহসের উপর তার ভরসা নেই।

ভূতুড়ে এই বাড়িতে ঢোকার পরিকল্পনা শশিকান্তর অনেক দিনের। কিন্তু একা ঢোকার সাহস তার নেই। তার ধারণা ছিল, বিশু আর ঈশানকে বললেই তারা রাজি হয়ে যাবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে, ঈশান রাজি হচ্ছে না। আবার ঈশানকে ছাড়া বিশুও যাবে না। পরিকল্পনাটা পুরো ভেস্তে যাচ্ছে দেখে, শশিকান্ত একটা মোক্ষম চাল দিল।

ক্রমশ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE