Advertisement
১৭ মে ২০২৪
জা স্ট যা চ্ছি

গ্লোবালদা, দুনিয়ার স্পিন, এসি কফিন

অনেকটা সময় অবধি অনেক রকম ইন্টারেস্টিং লোক দেখতে পেতাম। চোখের সামনে ঘুরছে-ফিরছে। অদ্ভুত কাণ্ড করছে, এমন সব কথা বলছে যে অবাক হয়ে যাচ্ছি। সবাই যে গুণী লোক তা নয়, এই যেমন পোটা— হাওড়া থেকে তারকেশ্বর অবধি সব ক’টা স্টেশনের নাম বলতে পারত, আপে, ডাউনে, কামারকুন্ডুতে ক্রসিংয়ের ব্যাপারটাও উল্লেখ করত প্রত্যেক বার।

ছবি: শুভময় মিত্র

ছবি: শুভময় মিত্র

শুভময় মিত্র
শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

অনেকটা সময় অবধি অনেক রকম ইন্টারেস্টিং লোক দেখতে পেতাম। চোখের সামনে ঘুরছে-ফিরছে। অদ্ভুত কাণ্ড করছে, এমন সব কথা বলছে যে অবাক হয়ে যাচ্ছি। সবাই যে গুণী লোক তা নয়, এই যেমন পোটা— হাওড়া থেকে তারকেশ্বর অবধি সব ক’টা স্টেশনের নাম বলতে পারত, আপে, ডাউনে, কামারকুন্ডুতে ক্রসিংয়ের ব্যাপারটাও উল্লেখ করত প্রত্যেক বার। এরা প্রত্যেকেই হঠাৎই হাওয়া হয়ে গেছে। কোথায় গেছে, কোথায় আছে কেউ বলতে পারে না। তবে অদ্ভুত পরিস্থিতিতে কারুর কারুর সঙ্গে দেখা হয়েও গেছে। এক বার গয়াতে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে, আমি দরজায়। পাশে আর একটা, উলটো দিকে যাচ্ছে। খুব ভিড়। দরজায় অনেক লোক, তার মধ্যেই দেখি শংকরদা, যে মধ্যজীবনে জার্মানি চলে গিয়েছিল। এখানে কী করছে? চোখাচোখি হতেই সেও মনে হল চিনতে পেরেছে। কিন্তু দুটো ট্রেনই চলতে শুরু করায় কথা বলতে পারলাম না। স্মৃতিকে আমার বর্তমান বলেই মনে হয়, কারণ সেটা লাইভ। রং চটে গেলেও তাকে ছোঁয়া যায়। শংকরদার এই চলে যাওয়া, সরে যাওয়া, ক্রমশ ছোট হয়ে যাওয়াটা ঘটল ভবিষ্যতের দিকে মুখ করে। অথচ রিয়েল-ফিল’টা অতীতের মতো, আসল লোক, আসল ঘটনাটা মিলিয়ে গেল একরাশ ভাবনা ভরা অজস্র বেলুন উড়িয়ে দিয়ে। বেরঙিন বেলুন সব।

স্কুলের বন্ধুদের প্রায় সবারই খোঁজখবর পাওয়া গেছে। দেখাও হয়ে যায় এখানে-ওখানে। হলেই সেই স্কুলের গল্প। এখানে একটু সেনসিটিভ ব্যাপার আছে, অতীত আর বর্তমানের আর্থিক পরিস্থিতির তফাতটা অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একটু বেফাঁস কথা লিক করলেই শেষ। সাক্ষাতে নয়, ই-মেল হোয়াটস্‌অ্যাপে রাগ-দুঃখ-হুমকি ঝরিয়ে ‘তোরা তোদের মতো থাক, আমাকে ডাকিস না আর’ বলে একদম কাট-অফ। আমি কারুর সঙ্গে কোনও ঝামেলায় জড়াচ্ছি না। একা লোক, জরুরি কাজও কিছু নেই, রক্ষা করার মতো মালপত্তরও নেই, আছে নানা রকম শিশিতে ভরা স্মৃতির আচার। তার ঢাকনা খুলে চাখাটাই লাক্সারি।

যেমন এই মাত্র দেখতে পেয়েছি এক জনকে যাকে আমি নিশ্চিত ভাবে চিনি, নামটা মনে পড়ছে না, কিন্তু পড়বে। একটু কথা বললেই সব মনে পড়ে যাবে। চেহারাটা ফিকে হয়ে গেছে, ভালই চেহারা ছিল, এখন রোগা, চুল উঠে গিয়ে কপাল হাঁটা দিয়েছে মাথার পিছনে, রগে প্রচুর শিরার উপনদী, শাখানদী। এটা দেখেই নিশ্চিত হলাম— এ হল গ্লোবালদা, ওই নামেই ডাকতাম। আসল নাম গোপাল হতে পারে। সারা দুনিয়ার খবর রাখত, ভবিষ্যদ্বাণী করত। বিশ্বাস করতাম না, কিন্তু সব ক’টা মিলেছে। সুনামি মিলেছে, বলেছিল সমুদ্র তেড়ে আসবে এক দিন। পাহাড় ভাঙা জলের তোড়ে ভেসেছে কেদারনাথ, বলেছিল। সবচেয়ে কথা বলত পৃথিবীর অতি-উষ্ণায়ন নিয়ে। সেটা তো প্রতি মুহূর্তে বুঝতে পারছি। খবর আসছে ভয়ংকর ও আরও ভয়ংকরের।

সুরাহার কথাও বলত গ্লোবালদা। কোনওটাই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। মনে হত ইয়ার্কি মারছে। গ্লেসিয়ারের স্পিড কী ভাবে মাপে? বিরাট ব্যাপার, লোকলশকর যন্ত্রপাতি অনেক কিছু লাগে, নিশ্চয়ই। না, গ্লোবালদার বক্তব্য, সামান্য ব্যাপারকে অকারণে কমপ্লিকেটেড করা হয়। গ্লেসিয়ারে একটা, পাশের জমিতে একটা লাঠি পুঁতে এক বছর পর কতটা সরেছে মেপে দিন-ঘণ্টা-মিনিট দিয়ে ভাগ করলেই ল্যাঠা চুকে যায়। বেসিক শিক্ষার অভাবে আমি চ্যালেঞ্জ করতাম না, শুনে যেতাম। গ্লোবালদা একাই বকে যেত।

বলতেই ভুলে গেছি ওর সঙ্গে দেখা হওয়ার ব্যাপারটা। শুকিয়ে যাওয়া একটা টিউবওয়েল দেখছিল মন দিয়ে, পাশেই নতুন রয়েছে, জল পড়ে। ভাবখানা হল, এটা কী দোষ করল? কাছে গেলাম। আমাকে দেখে উদ্বিগ্ন ভাবে বলল, ‘গলা টিপে মারছে একে একে। এক দিন রক্তও উঠবে না আর।’ বলার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝলাম ঠিক লোক, ভুল হয়নি। অনেক কথা বলে যাচ্ছিল যথারীতি, পরিবেশ বিষয়ে, ‘অগ্নিগর্ভ’ শব্দটা আগেও বলত, এখনও বলল। এই লোকগুলোর ভেতরে ফায়ার থাকে একটা, বুকটা হয় কাঠ-কয়লার মতো, সবটা পোড়ে না, আগুনটা ধিকিধিকি জ্বালিয়ে রাখে। শরীর বদলায়, মতিগতি পালটায় না। ‘চলো দেবনাথ, যেতে যেতে কথা হবে’ বলে আমার পিঠে হাত রেখে চাপ দিল। ভুল চিনেছে, কিন্তু আমি হাঁটতে থাকলাম ওর সঙ্গে। আমার চেনায় তো ভুল নেই। তা ছাড়া আমার তো আর কোথাও যাওয়ারও নেই। একটু পরে, ‘নাও, উঠে পড়ো’ বলতেই বড়, উঁচু এসইউভি চোখে পড়ল। উঠেও পড়লাম। দরজা বন্ধ করে কাচ তুলে এসি চালু হল, মুহূর্তের মধ্যে পালটে গেল দুনিয়াটা। এত ক্ষণ ঝাঁ-ঝাঁ রোদে দুনিয়া পুড়ছিল, আমিও পুড়ছিলাম। টিন্টেড গ্লাসের বাইরে সেই দুনিয়াই ভরদুপুরে চাঁদের আলোয় ভাসছে। হঠাৎ আমার ভীষণ কষ্ট হতে লাগল, নাকি আসলে ভাল লাগছিল? আমি প্রায় কেঁদেই ফেললাম। আসলে, দেখতে দেখতে এতটা বয়স হয়ে গেল। কিছুই করে ওঠা হল না। দুনিয়ায় কত কী ভাঙচুর গড়াপেটা হয়ে গেল, আমি তার কণামাত্র অংশীদার নই। খবর পেলে শ্রোতা, দেখতে পেলে দর্শক। তাই ভয়ানক রোদে বেরতে বাধ্য হলে আমার ভয়ানক চেহারার ছায়া পড়ে একটা, সেখানেই লুকোতে চাই, পারি না। এত বছরের বেকার জীবন আর মন্দ ভাগ্য হঠাৎই যেন শেষ হয়ে গেল আজ, গ্লোবালদা আমাকে তুলে নিল। ভাল কিছু হয়নি আমার, তাই কোনও দিন ভগবান মানিনি। আজ মনে হল ঈশ্বরের পাশে বসার সুযোগ হয়েছে। আবার চোখে জল আসতে লাগল। ‘তপন, এত উতলা হয়ো না, ভুল আমি করেছি। ইন ফ্যাক্ট বেশিটাই তো ভুল।’ একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েই ফের নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ‘একমাত্র তুমিই যা বলতে সেগুলো সত্যি হল। কত সাবধান করেছ, কেউ শোনেনি, কেউ বোঝেইনি গুরুত্বটা, এর পর কী হবে বলো তো?’ গ্লোবালদা খুবই রিল্যাক্সড হয়ে বসে আছে, অন্যমনস্ক ভাবে। হালকা স্পিডে গাড়ি চলছে, শাঁ শাঁ ঠান্ডাটাও অদৃশ্য অনেক পাখির মতো উড়ছে চার পাশে, মাথায়, কাঁধে বসছে। ‘একটা মেজর মিসটেক করতাম। থামাতে চাইতাম অনেক কিছু। বাট আই ওয়াজ রং। পারবে দুনিয়ার স্পিন থামিয়ে একটু রিপেয়ার করতে? না।’ আমি মন দিয়ে কিছুই শুনছিলাম না, শুধুই বাইরেটা দেখছিলাম। ভেতরে খুব হালকা গান চলছে। গাড়ি আস্তে আস্তে স্পিড বাড়াচ্ছে।

‘এত বড় ইয়ে তুমিও নও, আমিও না, যে দুনিয়াটা পালটে দেব। প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাওয়া যায় না, মোর ইম্পর্ট্যান্ট, প্রকৃতিকে বাঁচানোও যাবে না, ইম্পসিব্‌ল।’ ‘সব ধ্বংস হয়ে যাবে, তাই না?’ ‘একশো বছর ম্যাক্সিমাম, খবর বেরিয়েছে, স্রেফ খাদ্যাভাবে মরবে সব, ইস্টার আইল্যান্ডে যা হয়েছিল, জানো নিশ্চয়ই। যাকগে, আসল কাজ হল নিজের প্রোটেকশনের ব্যবস্থা করা, দ্যাট আই হ্যাভ ডান অ্যাট লিস্ট। ইফ ইউ কান্ট সেভ দ্য প্ল্যানেট, সেভ ইয়োরসেল্ফ।’

গাড়ির জানলা দিয়ে দেখছিলাম। ভবিষ্যতের রাস্তা আসছে, পাশে সরে যাচ্ছে সমকালের প্রকৃতি, পিছনের কাচে যাবতীয় ফেলে আসা ঘটনা। দুনিয়া ধ্বংস হলে কেউ বাঁচবে না এটা সবে ভেবেছি অমনি গ্লোবালদা বলল, ‘ধুলো গরম কাটিয়ে এসি গাড়ির ঠান্ডা ঠান্ডা বেশ লাগছে, ভাবছ বেঁচে গেছ। না। নো। হলোকাস্ট আসছেই, সবারই মৃত্যু অনিবার্য। যদি বেঁচে যাও, ভেবে দেখেছ কি এই মৃত্যু-উপত্যকায় দাঁড়িয়ে ঠিক কী করবে? বরং স্বেচ্ছামৃত্যু নাও। এখনই। শান্ত ভাবে। অযথা জীবনের ব্যালান্স শিট মিলিও না আর। ধীরে ধীরে, নিজেই কমাও সদ্য বিছানাপাতা কফিনের টেম্পারেচার। বরফ নামুক চোখের পাতায়।’

suvolama@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Just Jachchi Rabibasariya Subhomoy Mitra
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE