উত্তাল সমুদ্র। চারিদিকে নীলাভ অনন্ত জলরাশি জুড়ে ঢেউয়ের পর ঢেউ। তার মধ্যেই কলার ভেলার মতো দুলছে চার বাই তিন ফুটের একটা পাটাতন। কখনও ডুবছে, কখনও ভাসছে। আর সেটা আঁকড়ে বাঁচতে চাইছে এক জন অসহায় মানুষ।
সামনে নিশ্চিত মৃত্যুর হাতছানি। দশ-বারো ফুট উচ্চতার ঢেউ যে কোনও মুহূর্তে জীবনের উপর টেনে দিতে পারে দাঁড়ি।
পাশ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক বিশাল মালবাহী জাহাজ। কখনও মরিয়া হয়ে হাত তুলে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন তিনি। কখনও চিৎকার করছেন বাঁচানোর জন্য। কিন্তু কেউ শুনতে পাচ্ছে না। শুনতে পেলেও এগিয়ে আসার ঝুঁকি নিচ্ছে না কেউই। কোন ক্যাপ্টেনই বা অজানা-অচেনা লোককে বাঁচানোর জন্য জাহাজ ঘুরিয়ে মাঝসমুদ্রে নিজে বিপদে পড়তে চায়! আরও গতি বাড়িয়ে পাশ দিয়ে তাই হুশহুশ চলে যাচ্ছিল একের পর এক জাহাজ। জলের ঢেউয়ের ঝাপটা আরও বাড়িয়ে দিয়ে। আকাশে তারা, মেঘ, সূর্য-চাঁদ দেখতে দেখতে দিন-রাতের কত ক্ষণ ওই ভাবে কেটে গিয়েছিল, বলতে পারেন না ব্রাজিল থেকে সিঙ্গাপুরের দিকে ধাবমান জাহাজ ‘এম ভি ট্রু পেট্রিয়ট’-এর হাসপাতালে শুয়ে থাকা বার্নার্ড লুই পেরেইরা। তিনি তখন বাকরুদ্ধ। বাঁচার আনন্দে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে জল।
‘আমার জাহাজের ফিলিপিন্সের ক্রু-রা লোকটার সঙ্গে তখন সেলফি তুলছিল। ডেক থেকে দরকারি কাজকর্ম সেরে নীচে নেমে এ সব দেখে আমার করুণা আর রাগ দুটোই হচ্ছিল। ওঁকে প্রশ্ন করেছিলাম, বাড়ির লোকেদের কাছে ফিরতে চান? লোকটা এমন ভাবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল! চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল জলও। দৃশ্যটা কোনও দিন ভুলব না,’ বলতে বলতে ভারত মহাসাগরের ছ’শো মাইল ভিতরে থাকা সেই দিনটাতে যেন ফিরে যান রানিকুঠির দীপাঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়। সে দিনের এম ভি ট্রু পেট্রিয়ট জাহাজের ক্যাপ্টেন।
জাহাজ ও মাল— প্রায় সাতশো আশি কোটি টাকার ঝুঁকি কাঁধে নিয়ে, অসম সাহসিকতায় মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষকে বাঁচানোর জন্য কয়েক দিন আগে লয়েড্স লিস্ট এশিয়া সংস্থা নাবিকদের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ সম্মান ‘সিফেয়ারার অব দি ইয়ার’ পুরস্কার দিয়েছে এই বঙ্গসন্তানকে। নাবিক হিসেবে ভারতের ইতিহাসে যা অনবদ্য এবং সম্ভবত প্রথম ঘটনা। সিঙ্গাপুরে চারশো নাবিকের উপস্থিতিতে তাঁকে দেওয়া হয় এই পুরস্কার। দীপাঞ্জনের সঙ্গে লড়াইতে ছিলেন কোরিয়া এবং ফিলিপিন্সের আরও দুজন ক্যাপ্টেন ও তাঁদের জাহাজের ক্রু-রা। সমুদ্রের ভিতর তাঁরাও ঝুঁকি নিয়ে কিছু সাহসী কাজ করে দেখিয়েছিলেন বলে মনোনয়ন পেয়েছিলেন পুরস্কারের জন্য। সাহসিকতার লড়াইয়ে অবশ্য শেষ পর্যন্ত দীপাঞ্জনের মাথাতেই উঠেছে সেরার মুকুট।
ঘটনাটা ঠিক কী ঘটেছিল? রডরিগেস দ্বীপ থেকে মরিশাস— সমুদ্রপথে প্রায় দু’শো সত্তর মাইল। একটি আধুনিকতম বোট নিয়ে সেই পথ পেরোচ্ছিলেন ফ্রান্সের নাগরিক বার্নার্ড। মাঝসমুদ্রে ঝড় আর ঢেউয়ে উলটে যায় সেই বোট। তার পর? দীপাঞ্জন বলছিলেন, ‘ভাগ্যিস ওই লোকটার বোটে ভিএইচএফ (ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি) সিস্টেম লাগানো ছিল! তাই এসওএস কল দিতে পারছিল বিভিন্ন জাহাজকে। আমি যখন কল-টা পাই, তখন ভোরের আলো ফুটছে সবে।’ এর পর কী করলেন? ‘ভেবেছিলাম, একজন দায়িত্ববান মেরিনার হয়ে আমি এই ডাক এড়াতে পারি না। কিন্তু সমুদ্রে তখন পাঁচ-সাত ফুট উঁচু ঢেউ। ঝড়ের মতো হাওয়া বইছে। কাজটা যে কঠিন, জানতাম,’ বলতে বলতেই কেমন যেন আনমনা হয়ে যান মুম্বইয়ের নামী কলেজ থেকে নটিকাল সায়েন্স নিয়ে পাস করা ছাত্র।
তার পর যা ঘটেছিল তা আরও চমকপ্রদ। সমুদ্রে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ফ্রান্সের ওই নাগরিকের সঙ্গে দীপাঞ্জনের জাহাজের দূরত্ব ছিল প্রায় ৫০ মাইলের। ভিএইচএফ কল পাওয়ার পর নিজের কোম্পানি এবং সংশ্লিষ্ট নানা সংস্থার সঙ্গে কথা বলে অনুমতি আদায় করে নেন শান্ত স্বভাবের সাহসী দীপাঞ্জন। তার পর এগোতে থাকেন মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে। উলটো দিকের উত্তাল ঢেউ আর খারাপ আবহাওয়ার সঙ্গে লড়াই করতে করতে দীপাঞ্জন যখন তাঁর ক্রু-দের নিয়ে সেখানে পৌঁছন, তখন দুপুর হয়ে গিয়েছে। সময় লেগেছিল প্রায় ছয় ঘণ্টা। কিন্তু ঢেউয়ের এত তোড় ছিল যে লাইফ সেভিং বোট পাঠিয়ে মানুষটিকে তোলা সম্ভব ছিল না। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, অথচ পৌঁছনো যাচ্ছে না। একটাই রাস্তা ছিল— জাহাজকে একেবারে সামনে নিয়ে যাওয়া। আর সে জন্য দরকার ছিল জাহাজের মুখ ঘোরানো। এটা কোনও চওড়া হাইওয়ে নয় যে ইচ্ছে করলেই জাহাজের মুখ ঘোরানো যাবে। পনেরো বছরের অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন দীপাঞ্জনের কথায়, ‘আমার জীবনের ঝুঁকি তো ছিলই, আমার সঙ্গে থাকা কুড়ি জন সহকারীর জীবনও বাজি রাখতে হয়েছিল জাহাজ ঘোরানোর সময়।’
সেই মাঝসমুদ্রেও বঙ্গসন্তান মনে রেখেছিলেন, নাবিক জীবনের প্রথম শিক্ষার কথা। ‘সমুদ্রে কেউ অসহায় অবস্থায় পড়লে তাঁকে বাঁচানোর জন্য নিজেকে উৎসর্গ কোরো।’ ‘বিশ্বাস করুন, এক বারের জন্যও ভাবিনি আমাদের চেষ্টা ব্যর্থ হবে। বরং ভেবেছি, পারবই। সমুদ্রেই তো আমাদের বছরের অর্ধেক কাটে। মাঝেমধ্যেই আসে নানা বিপদও। রক্ষা করি নিজেদের। সেটাই আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল, বলতে পারেন,’ জানুয়ারির শেষ দুপুরে দক্ষিণ কলকাতার এক ক্লাবে বসে কথা বলতে বলতে মৃদুভাষী ক্যাপ্টেনের গলায় অদ্ভুত একটা তৃপ্তি
খেলা করে।
‘লোকটাকে জল থেকে তোলার পর মনে হচ্ছিল, নিজেই যেন নতুন জীবন পেয়েছি। জীবনে বহু আনন্দের মুহূর্ত এসেছে। কিন্তু তলিয়ে ভাবলে মনে হয়, এত আনন্দ কখনও পাইনি,’ বলতে বলতে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন দীপাঞ্জন। জাহাজ নিয়ে সমুদ্রের পর সমুদ্র পেরনোর সময় বহু জানা-অজানা সমুদ্র-জীবকে বাঁচিয়েছেন। কিন্তু মানুষ? এই প্রথম। উচ্ছ্বাস স্বাভাবিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy