চিনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। —ফাইল চিত্র।
আজি হতে শতবর্ষ পরে/ কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি/ কৌতূহলভরে—’ কবি জানতেন, তাঁর জীবন-কবিতার প্রতি শতবর্ষ পরেও বাঙালি জাতির কৌতূহল থাকবে।
তখন তাঁর নোবেলপ্রাপ্তির দশক পেরিয়ে গিয়েছে। খ্যাতির সূত্রেই দেশ-বিদেশের নানা স্থানে আমন্ত্রণ রক্ষার দায় আসছিল। পাশ্চাত্যের বুধমণ্ডলী তাঁর কাব্য পড়ে, কথা শুনে রীতিমতো বিস্মিত। প্রাচ্যের নানা দেশ থেকে তাঁর আমন্ত্রণ আসছে। তখন থেকে এক যুগ আগে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটেছে চিনে। নতুন নাম হয়েছে ‘রিপাবলিক অব চায়না’। নতুন করে সেজে উঠছে প্রাচ্যের সুপ্রাচীন সভ্যতার এই ভূখণ্ড। ‘পিকিং লেকচার অ্যাসোসিয়েশন’-এর পক্ষ থেকে প্রাচ্যের প্রথম নোবেলজয়ীকে সে দেশে ভ্রমণের আহ্বান জানানো হয়েছিল।
‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’তে তিনি লিখেছিলেন, “তোমাদের বইয়ে বোধহয় পড়ে থাকবে, পাখিরা মাঝে মাঝে বাসা ছেড়ে দিয়ে সমুদ্রের ওপারে চলে যায়। আমি হচ্চি সেই জাতের পাখি। মাঝে মাঝে দূর পার থেকে ডাক আসে, আমার পাখা ধড়ফড় করে ওঠে।”— ফলে চিনের আমন্ত্রণ গ্রহণে তাঁর বাধা থাকার কথা নয়। চিনে তাঁর ভ্রমণ-সহ সমস্ত ব্যয় বহনের দায়িত্ব কর্তৃপক্ষ নেবে, এই আশ্বাসে চিনযাত্রা নির্দিষ্ট করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সঙ্গে নিয়েছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন, নন্দলাল বসু, লেনার্ড এলমহার্স্ট, মার্কিন সমাজসেবী গ্রেচেন গ্রিন, কালিদাস নাগ এবং লিমডির রাজকুমার ঘনশ্যাম সিংকে। কবির সহচরদের চিন ভ্রমণের অর্থ জোগাড় করতে হয়েছিল নিজেদেরই। যদিও এই আমন্ত্রণের বছর খানেক আগে রাণু অধিকারীকে লেখা কবির একটি চিঠি বলছে — ‘হেনকালে চীন দেশ থেকে একজন ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তিনি বল্লেন, “চীনদেশে আপনাকে যেতেই হবে, সেখানকার যুবকেরা আপনার জন্যে অপেক্ষা করচে।”’ সেই আমন্ত্রণ ১৯২৩ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর, এই তিন মাসের জন্য করা হয়েছিল। শেষমেশ চিন-যাত্রা বাস্তবায়িত হল ১৯২৪ সালে। সে বছর তিন মাসের বদলে ১২ এপ্রিল থেকে ৩০ মে— চিনের আতিথেয়তায় সেখানে এই ঊনপঞ্চাশটি দিন কাটিয়েছিলেন কবি।
জানা যায়, পিকিং-এর এক দল বিদ্বান মানুষ ১৯২০ সালে একটি লেকচার অ্যাসোসিয়েশন গঠন করে পশ্চিমি দুনিয়ার বিদগ্ধ পণ্ডিতদের বক্তৃতা দেওয়ার জন্য চিনে আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথের আগেই সেখানে ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল, জার্মান বিজ্ঞানী ও দার্শনিক হান্স অ্যাডলফ দ্রেশ, মার্কিন দার্শনিক জন ডুয়ি প্রমুখ গিয়েছিলেন। আমন্ত্রণ পেয়ে কবির মন পুলকিত হয়েছিল বলেই চৈনিক ভদ্রলোকের সেই আহ্বানের পরেই তিনি এলমহার্স্টকে চিন সফরের বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার দায়িত্ব দেন। এলমহার্স্ট চিনে গিয়ে দেখেন, ইতিমধ্যেই সেখানকার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কবির অগস্ট মাসে সেখানে যাওয়ার বিষয়ে খবর প্রকাশিত হচ্ছে, এবং তা দেখে চিন সম্পর্কে কবিকে ইতিবাচক বার্তাই দেন তিনি।
অবশেষ ১৯২৪-এর ২১ মার্চ কবি সদলবলে জাহাজে যাত্রা করেন। জাহাজে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় দক্ষিণ চিনের অবস্থা, আধুনিক ভূগোল, ‘লিগ অব নেশনস’-এ চিনের অবস্থান, তার আদর্শ, আশা, আকাঙ্ক্ষা এবং বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হতে থাকেন। রবীন্দ্রনাথের জীবনে নানা ভ্রমণসাহিত্য থেকে জানা যায়, ভ্রমণরত দেশের ইতিহাস, ভূগোল থেকে জনজীবনের অনুপুঙ্খ খবরাখবর সংগ্রহ করেই তিনি যাত্রা করতেন। চিন-ভ্রমণেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
এই যাত্রাকালেই রেঙ্গুনে একটি চৈনিক মেয়ের সঙ্গে কবি এবং তাঁর সহচরদের আলাপ হয়। মেয়েটির নাম লিন সিয়াং ইন। তার কাছেই চিনের অভ্যন্তরীণ অনেক খবর পাওয়া গিয়েছিল। মেয়েটি ছিল তৎকালীন ‘বর্মা মর্নিং পোস্ট’-এর সম্পাদক, কবিকে নিয়ে একটি কবিতাও লিখেছিল। এঁর সম্পর্কে রাণুকে ২৮/২৯ মার্চ রেঙ্গুন থেকে পথে চিঠিতে লিখেছিলেন— “আসবার আগের দিন একটি চীনের মেয়ের সঙ্গে আলাপ হল।... তার ইচ্ছে বিশ্বভারতীতে গিয়ে অন্তত একবছর থেকে আমার কাছে সাহিত্য অধ্যয়ন করে।” কবির সঙ্গে এতটাই ঘনিষ্ঠ হয়েছিল মেয়েটি যে, যখন রেঙ্গুন থেকে জাহাজ ছাড়ছে, কবির হাত চেপে ধরে সে বলেছিল— “আপনি চলে যাচ্চেন, আমার কষ্ট হচ্চে— ফিরে এলে যেন আপনাকে দেখতে পাই।” কবি তাকে ‘গুডবাই’ বলায় তখন সে কবির বুকের উপর মাথা রেখেছিল। মেয়েটি চলে যাওয়ার সময় এলমহার্স্টকে বলেছিল কবির যত্ন নিতে। এলমহার্স্ট মজা করে যখন বললেন— “আমি এত বড় দায়িত্ব নিতে পারব না, আমার বদলে তুমি না-হয় এসো।” মেয়েটি দুই হাতে কবির হাত চেপে ধরে আক্ষেপ করে বলেছিল, সেই সুবিধা বা সম্ভাবনা থাকলে ‘দেখতে আমি কত যত্ন করতুম’।
প্রসঙ্গত মনে রাখতে হয়, সদ্য রাজতন্ত্র থেকে বেরিয়ে প্রজাতন্ত্রের পথে হাঁটা চিনের অভ্যন্তরে তখন নানা সঙ্কট। ১৯২১ সালে সেখানে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে সামাজিক অন্যান্য নানা কারণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল পরস্পরবিরোধী মতাদর্শের সংঘাত। সোভিয়েট ইউনিয়নে তত দিনে সমাজতন্ত্র এসেছে। তার প্রভাবে চিনে সমাজতান্ত্রিক সাম্যবাদে উদ্বুদ্ধ জনগণের সঙ্গে বিরোধ চলছিল প্রাচীনপন্থীদের। কারণ পশ্চিমি দুনিয়ার অনুকরণে শাশ্বত কালের চিনে তখন পাশ্চাত্য ভোগপ্রিয়তা বেড়েছিল। কবি সদ্য বলশেভিক আন্দোলন ও তার গতিধারা সম্পর্কে এতটাই সচেতন ছিলেন যে, চিনযাত্রার পথে এশিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আলোচনাকালে স্পষ্ট করে বলেছিলেন, “যত ভালই হোক না কেন সে-আদর্শ — ব্যক্তিত্ব (individualism) বাদ দিয়ে সমষ্টি (communism) দাঁড়াতে পারবে না কোনদিনই— যেমন unit-কে বাদ দিয়ে infinity-র মানে নেই। Communism যত সত্য individualism ততই সত্য।” স্মরণীয়, এর অনেক পর, ১৯৩০ সালে তিনি রাশিয়া যান এবং ‘রাশিয়ার চিঠি’ লেখেন। সেখানেই বলেছিলেন, “ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনো টেঁকে না— সজীব মনের তত্ত্বের সঙ্গে বিদ্যার তত্ত্ব যদি না মেলে তা হলে হয় একদিন ছাঁচ হবে ফেটে চুরমার, নয় মানুষের মন যাবে মরে আড়ষ্ট হয়ে, কিম্বা কলের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে।”
আজ সমাজতান্ত্রিক চিনকে দেখলে কবির কথা স্পষ্ট হয়। সেই সঙ্কটকালেই কবি যাচ্ছেন সে দেশে। এমনকি ‘স্বরাজ’ নামের একটি তামিল পত্রিকা চিনের এই সফর নিয়ে কবিকে ১৯২৩-এর নভেম্বর মাসেই সতর্ক করেছিল। লিখেছিল ‘গীতাঞ্জলি’র স্রষ্টার যে মানবতার আদর্শ, তা সেখানকার বস্তুবাদী চিনাদের তেমন ভাবে স্পর্শ করবে না।
তবু কবিকে নিয়ে জাহাজ ১২ এপ্রিল ভোরে চিনের ইয়াংসি কিয়াং নদীর ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলল। নদীকূলের গাছগাছালিতে তখন বসন্তের শোভা। কালিদাস নাগের ভাষায় “কচিপাতার সবুজ আভা চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছে।” তীরে ভিড়তেই ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি। হোটেলে দেখা করে গেলেন ‘চিত্রা’, ‘রাজা’, ‘ফাল্গুনী’র চিনা অনুবাদক চেউ। জানা যায়, কবি যাওয়ার আগেই চিনে তাঁর রচনার অনুবাদ হয়েছিল। চিনের নতুন প্রজন্ম কবির সাহিত্যকে বিশেষ আমল দেয়নি। ফলে চিনে কবির নানা বক্তৃতাসভায় যুবাদের বিক্ষোভ হত। রবীন্দ্রনাথকে ‘পরাধীন দেশের দাস’ বলে বিদ্রুপ করা হয়েছিল।
অথচ সর্বগ্রাসী বস্তুবাদের ফলে চিনের সমস্যা কত জটিল ও ভয়ানক হয়ে উঠছে, তা গভীর বেদনার সঙ্গে একের পর এক বক্তৃতায় অকুতোভয় কবি বলেছিলেন। সহচরদের সঙ্গে অবসরে আলোচনা করেছেন রুশ, চিন ও ভারতকে নিয়ে। কবির ধারণা “ভারতকে যখন ডাকছে চিন, তার মধ্যে শুধু জ্ঞানযোগের নয়, রাজযোগেরও প্রক্রিয়া হয়ত কাজ করছে।” বার বার অহিংস নীতির উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, “দুটি জিনিষ তোমাদের মনে রেখে সাধনায় নামতে হবে— যা কিছু মন্দ অসুন্দর তার সম্বন্ধে ঔদাসীন্য বর্জন করে তার বিরুদ্ধে লড়া— অবশ্য জানোয়ারের যন্ত্রে নয়, মানুষোচিত যন্ত্রে— পশুবলে নয়— অধ্যাত্মবলে, হিংসার বিরুদ্ধে হিংসা দিয়ে নয়, ক্ষমা, পরিপূর্ণ ক্ষমা দিয়ে— তবেই সার্থক হবে সাধনা— এই যুদ্ধে যদি প্রথম ক্ষয়ও হয়, তবু জেনো জয় তোমাদেরই।”
প্রথম বারের চিন ভ্রমণে কবি একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেছিলেন শাংহাইতে। রথীন্দ্রনাথকে লেখা একটি চিঠিতে জানা যায়— সেই আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, বিশ্বভারতী থেকে সংস্কৃত পণ্ডিত অধ্যাপক ও ছাত্র চিনে পাঠানোর পাশাপাশি, যদি বিশ্বভারতীতে চিনা ভাষা শেখানোর বন্দোবস্ত হয়, তারাও ছাত্র ও অধ্যাপক পাঠাবে। ফলস্বরূপ পরে শান্তিনিকেতনে ১৯৩৭-এ চিন-ভারত মৈত্রীর গবেষণা কেন্দ্র ‘চিনভবন’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
যে কবির লেখনী বার বার মানবজীবনের বন্ধনের কথা উচ্চারণ করেছে— ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো/ সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও’। তাঁর যে চিনের প্রতিও গভীর প্রীতি ও ঔৎসুক্য থাকবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নানকিং-এ এক সভায় গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন, “চীন বহু প্রাচীন কাল থেকে যে সভ্যতার আদর্শ নিয়ে আসছে— শান্তির ভিত্তিতে সেটি গড়ে উঠেছে— তা মানবের অমূল্য সম্পদ।” অথচ তথাকথিত পশ্চিমি ভোগবাদী আগ্রাসনে যে তা বিনষ্ট হতে চলেছে, “এই বিষম বিপদ সম্বন্ধে সজাগ করিয়ে দেবার জন্যে আমার এখানে আসা— কারণ চীন সম্বন্ধে গভীর আত্মীয়তাবোধ ভারতবাসীর আছে।” কবির এমনতর বাণী শুনে চিনের সিভিল গভর্নর হান সে সু স্বীকার করেছিলেন, সেখানকার নবীনরা এ কথা হয়তো বুঝবে না বা শুনবে না, কিন্তু প্রবীণরা এই বাণীর মর্যাদা বোঝে এবং ‘আশা করি ভবিষ্যৎ চীনও বুঝে পরিত্রাণ লাভ করবে।’
কবি বার বার নির্ভয়ে শুনিয়েছেন— যারা বস্তুগত শক্তির সাহায্যে ক্ষমতাশীল জাতি গড়তে চায়, তারা ইতিহাস জানে না ও সভ্যতাকেও বুঝতে পারেনি। নিছক শক্তির উপর নির্ভরতা বর্বরতার লক্ষণ, যারা তার উপর নির্ভর করেছিল তারা হয় ধ্বংস হয়েছে, অথবা বর্বরই থেকে গেছে। আর এখানেই প্রতিবাদীদের বিরোধিতা মুখর হয়েছে। তবু রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্ত সেথা ভয় শূন্য উচ্চ সেথা শির’ মনোভাব অটুট ছিল। এক দিন নানকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকেলে কবি বক্তৃতা দিতে গেছেন। সেখানে তিন থেকে চার হাজার লোকের জমায়েত। আরম্ভের মিনিট দশেকের মধ্যেই ঘটল এক দুর্ঘটনা। সে কথা লিখেছেন তিনি— “তারস্বরে আমি যেই বক্তৃতা আরম্ভ করেচি, দু চারটে কথা বলেচি মাত্র এমন সময় ধড়াম করে একটা শব্দ।” সভা কেঁপে উঠেছিল। বক্তৃতামঞ্চের উপরেই কাঠের গ্যালারি অতিরিক্ত লোকের ভারে খানিকটা ভেঙে গেছিল। সম্পূর্ণ ভাঙলে “আমারও কপাল ভাঙত। আমার মাথার উপর পুষ্পবৃষ্টি না হয়ে নরনারী বৃষ্টি হত।” সবাই তখন ভয়ে এ দিক-ও দিক ছোটাছুটি করছে। অথচ তিনি অনড়। হাত তুলে সকলকে শান্ত হতে ইঙ্গিত করলেন। বলেছেন— “যদি আমি ভয়ে ব্যস্ত হয়ে পালাবার পথ দেখতুম তাহলে সেই তিন হাজার লোক পালাবার ঠেলাঠেলিতে সর্ব্বনাশ কাণ্ড ঘটাত।” কবির সহচর কালিদাস নাগ এই ঘটনার প্রসঙ্গে ‘কবির সঙ্গে একশো দিন’ গ্রন্থে লিখেছেন — ‘আশ্চর্য নার্ভ কবির’। তার পর সভাঘরের সমস্ত লোককে শান্ত বিমোহিত করে বক্তৃতা দিলেন— “আমি চিরযৌবনের জয়গান করে আসছি — চীনের নবজাগ্রত যৌবনের কাছে— আমার সবচেয়ে নিকটের কথা হচ্ছে যে বীরের মতো যুদ্ধ করার জন্যে— দেশের প্রাচীন সভ্যতা বন্দিনী রাজকুমারীর মত অপেক্ষা করছে।” এই সভ্যতার গায়ে কালিমা লেপে দিচ্ছে পাশ্চাত্যজগৎ। তাকে ধুয়ে মুছে শুচি করে সুন্দর করে গৌরবের আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। “এই কাজে ভারতের দিক থেকে পূর্ণ সহানুভূতি জানাতে এসেছি।” সুন্দর সবল স্বাধীন চিনকে এ ভাবেই দেখতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সে বার চিনের প্রতিটি সভা, আলোচনা ও বক্তৃতায় এই শাশ্বত সত্য ও সৌন্দর্যের জয়গান গেয়ে বেরিয়েছেন। পিকিং-এর বুদ্ধিজীবীরা কবিকে সংবর্ধনা দেওয়ার সময় নেভি ক্লাবে বলেছিলেন, “আমরা রবীন্দ্রনাথকে ঋষি বা ধর্মসংস্কারক হিসাবে অভ্যর্থনা জানাচ্ছি না, তাঁকে আমরা এক জন মহান বিপ্লবী কবি বলেই মনে করি।” তবে তাঁর বেশ কয়েকটি সভায় তিনি লক্ষ করেন, এক দল যুবক ছাপানো প্রচারপত্র শ্রোতাদের মধ্যে বিলি করতেন। এ সব ছিল কবির পশ্চিমি দেশগুলির যুদ্ধপ্রিয়তা, আগ্রাসী শিল্পায়ন, আধ্যাত্মিকতা ধ্বংসের বিরুদ্ধে শান্তির বাণী প্রচারের বিরোধিতা। রবীন্দ্রনাথ এই বিরোধিতাকে গুরুত্ব দেননি। বরং প্রচার করেছেন যুবসমাজের কাছে— একমাত্র ভালবাসার পরশেই সব কিছু সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে উঠতে পারে বলে তাঁর বিশ্বাস। বহু জায়গায় বিভিন্ন সভার পরে ছাত্রদের কাছ থেকে নানা প্রশ্ন শুনেছেন, উত্তরও দিয়েছেন। এই সফরকালেই পিকিং নর্মাল ইউনিভার্সিটির অডিটোরিয়ামে কবি ধুতি-পাঞ্জাবিতে সুসজ্জিত হয়ে ৬৪তম জন্মদিনটি পালনের উদ্দেশ্যে উপস্থিত হয়েছিলেন। সে দিন তাঁকে চৈনিক ভাষায় ‘চু চেন তান’ লেখা একটি মূল্যবান প্রস্তর উপহার দেওয়া হয়। যার বাংলা ‘ভারতের মেঘমন্দ্রিত প্রভাত’।
এক দিকে নব্যপন্থীদের বিরোধিতা, পাশাপাশি সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষের অকুণ্ঠ ভালবাসা প্রাপ্তিই ছিল কবির চিন ভ্রমণের বরমাল্য। সে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরেছেন। দেখেছেন চৈনিক প্রাচীন নিদর্শনগুলি, বিশেষত কনফুসিয়াসের সমাধিস্থল, নিষিদ্ধপুরীর রাজপ্রাসাদ, বিভিন্ন বৌদ্ধবিহার। ঊনপঞ্চাশ দিনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের শেষ দিনে কবি চিনের জনগণের উদ্দেশে বলেছিলেন তাঁর এই ভ্রমণের কথা, “আজ বিদায়ের দিনে আমায় বলা হয়েছে স্পষ্ট করে চীন সম্বন্ধে আমার মতামত— এমনকী আমার সমালোচনাও জানিয়ে যেতে। আমি কবি, সমালোচনা আমার কাজ নয়।” যদিও সমালোচনার লোকই জগতে বেশি, এ কথাও সেই ভাষণে স্মরণ করিয়ে দেন। “আমি আমার মতন করেই আমার কথা বলে এসেছি, আজও বলছি— কে কীভাবে নিয়েছে সেটা ভাববার কথা আমার নয়। যাবার দিনেও ভেবে পাই না কী দিয়েছি— কিছু দিয়ে গেলাম কী! যদি কিছু দিয়ে থাকি তা কবি হিসেবেই দিয়েছি। আজ বিদায়ের সময় মনে পড়ছে জনাকতক মানুষের কাছে নিজের কথা বলেছি, জনাকতক মানুষকে বন্ধু হিসেবে পেয়েছি— তাইতেই আমার মন ভরে গেছে।” এ কথা বলে গভীর আনন্দের সঙ্গে এখন থেকে শতবর্ষ আগে ৩১ মে সকাল সাড়ে আটটার জাহাজে চেপে চিনের ভূখণ্ড থেকে জাপানের উদ্দেশে রওনা দেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy