Advertisement
১৯ মে ২০২৪
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৫

একটা [ভয় ] কষ্ট লজ্জা

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়মা যখন ছোটবেলায় স্রেফ চোখের ইশারায় ভরভত্তি টিভির ঘর থেকে তুলে নিয়ে আসত, রাগে, মনখারাপে, কান্নায় গুম হয়ে বসে থাকতাম। শুধু কি তাই? বছরে দু’দিন ছাড়া আলুকাবলি বরাদ্দ হত না। উঠতি বয়সেও বড়দের আড্ডায় ঢোকা বারণ।

শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

মা যখন ছোটবেলায় স্রেফ চোখের ইশারায় ভরভত্তি টিভির ঘর থেকে তুলে নিয়ে আসত, রাগে, মনখারাপে, কান্নায় গুম হয়ে বসে থাকতাম। শুধু কি তাই? বছরে দু’দিন ছাড়া আলুকাবলি বরাদ্দ হত না। উঠতি বয়সেও বড়দের আড্ডায় ঢোকা বারণ। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন সম্ভবত পেঁপে, কুমড়ো, নিমপাতা আর ছানা মারকাটারি উপকারী (সুতরাং, বাধ্যতামূলক) ছিল। কলেজবেলায় বেশি দেরি করে বাড়ি ঢোকা যাবে না, বেশি হিন্দি সিনেমা দেখা যাবে না, খুব দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা যাবে না। অসহ্য লাগত। হাঁপিয়ে উঠতাম।

তার পর কখন যে ইকোয়েশনটা পাল্টে গেল, মালুম পেলাম না। বয়স বাড়ার পর থেকে বোধ হয়। আমি নিষেধের এমন ফোয়ারা চালালাম যে বাড়ির সবাই হেই সামালো। বাবা কেন মিষ্টি খেয়েছে, মা তুমি নুন খাবে না, একা একা ভিড়বাসে উঠে রুনাদির বাড়ি যেতে কে বলেছিল, উঁহু, ভারী জিনিস তুলবে না। বেশ লাগছিল। বিশেষ ভাবার সময় পাওয়ার আগেই অনেকগুলো বছর দুড়দাড় কেটে গেল। বাড়িতে বেশ একটা কেউকেটা হয়ে উঠলাম।

আর আশ্চর্য, সঙ্গে সঙ্গে একটা ভয়ও সাঁত্‌ করে ঢুকে গেল ভেতরে। কই, আমায় তো কেউ কিছু বারণ করছে না! কই, আমি দেরি করে এলে তো কেউ প্রশ্ন করে না! আমি কিছু ভুল করে ফেলছি না তো? ঠিক ঠিক ভাবছি তো? যে সিদ্ধান্ত অন্যের হয়ে নিচ্ছি, তা ঠিক হবে তো? আমার জীবনটা শেষমেশ ঠিকঠাক একটা জায়গায় পৌঁছবে তো?

আগে জানতাম, বড় হওয়া মানে, হাতে টাকা মনে ইচ্ছে এবং চালাও পানসি বেলঘরিয়া। সেটা যে বেলতলাতেও গিয়ে ভিড়তে পারে, এবং ন্যাড়া মাথায় ঠকাসের দায়টা নিজেকেই ঘাড় পেতে নিতে হয়, কক্ষনও মাথায় আসেনি। এখন কোনও ডিসিশন নিতে গেলেই বড় বাইরে পেয়ে যায়। কোন ফ্রিজটা কিনব? বাবাকে কোন হাসপাতালে দেব? ট্রিটমেন্টের মাঝখানে ডাক্তার চেঞ্জ করলে উলটে উত্‌পত্তি হবে না? খেলা শেষ হওয়ার পরে যেমন দুজন এক্সপার্ট মিলে তারিয়ে তারিয়ে কাটাছেঁড়া করেন, তেমন আমার কাজগুলো ধেড়িয়ে গেলে সংসারের ব্যঙ্গভরা ব্যঁাকা হাসি আগাম দেখতে পাই। আমিই বা আমার কাছে মুখ দেখাব কী করে?

রোজ সকালে চোখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে বুক ধড়াসধড়াস শুরু হয়। কে যেন মাথার ভেতর একটা লিস্টি পড়তে শুরু করে। সে বলে, মাইক্রোওয়েভটা সারাবি? নাঃ, নতুন কিনে নে। অবশ্য সারালেও হয়। আগে কলাম লিখবি না গ্যাসের দোকানে কমপ্লেন করতে যাবি? বরং বাচ্চার ইস্কুলের খোঁজ কর। অনন্ত অংক পরীক্ষার সামনে পড়ে গেছি মনে হয়।

কখনও যদি নিজেকে আবিষ্কার করি, আধ ঘণ্টা ধরে এলিয়ে বই পড়ছি বা এমনিই সিলিং-এর দিকে মুচকি হেসে পা নাচাচ্ছি, হড়মড় করে উঠে বসি। এই রে, নিশ্চয় কোনও কিছুকে অবহেলা করে ফেললাম! নিশ্চয়ই এখন একটা খুব জরুরি কাজ করার কথা ছিল! ডাক ছেড়ে কেঁদে বলতে ইচ্ছে হয়, আমাকে কেউ একটা অর্ডার কর না রে, কখন এগজ্যাক্টলি কী করতে হবে। কী কী বারণ, কী কী অ্যালাউড। কিন্তু তাকিয়ে দেখি, সবাই আমার কাছেই সাজেশন নিতে সিরিয়াস মুখে দাঁড়িয়ে। এমনকী মা অবধি ভাবছে আমি সত্যি সত্যি বড় হয়ে গেছি। উফ, মা, নিজেকে টিভির ঘর থেকে ঘাড় ধরে উঠিয়ে আনার চেয়ে শক্ত কাজ আর পৃথিবীতে আছে কি?

amisanchari@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

ektubhoykostolajja sanchari mukhopadhay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE