জয়পুরের এসএমএস মেডিক্যাল কলেজে পড়তে চান রূপা। ছবি: সংগৃহীত।
বছর নয়েক আগের কথা। ভারতীয় টেলিভিশনে সাস-বহু সিরিয়ালের কচকচানিতে দর্শক যখন ক্লান্ত, তখনই স্বস্তির হাওয়ার মতো শুরু হয়েছিল একটি ধারাবাহিক। রাজস্থানের প্রত্যন্ত গ্রামের বালিকা বধূ আনন্দীর জীবনকাহিনি দেখে স্বাদ বদল করেছিল দর্শক। এরপর টানা ৯ বছর আনন্দীর জীবন থেকে চোখ ফেরাতে পারেনি দর্শক। এই সময়ের মধ্যেই একদা ৮ বছরের বালিকা বধূ আনন্দী কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে উপনীত হয়েছে। জীবনের ঝড়-ঝাপটা সামলে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, গ্রামের একদা সরপঞ্চ আনন্দী মেয়েদের শিক্ষিত, স্বনির্ভর করার কাজে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন।
আনন্দীর জীবন উদ্বুদ্ধ করলেও কতটা বাস্তব তা বার বারই ভাবিয়ে তুলেছে দর্শকদের। সত্যিই কি রাজস্থানের প্রত্যন্ত গ্রামের বালিকা বধূর পক্ষে এত কিছু করে ওঠা সম্ভব? পুরুষশাসিত সমাজে মেয়েদের, বিশেষ করে বিবাহিত মেয়েদের স্বপ্ন দেখাই যেখানে স্পর্ধা সেখানে রক্ষণশীল পরিবারে আনন্দীর শ্বশুর-শাশুড়িরা কি সত্যিই বাস্তব চরিত্র? গল্প যে আসলে বাস্তবেরই প্রতিফলন তা বুঝিয়ে দিলেন রাজস্থানেরই একদা বালিকা বধূ রূপা যাদব।
না। আনন্দীর মতো কোনও কল্পকাহিনির নায়িকা নন রূপা। জয়পুরের কাবেরি গ্রামের মেয়ে রূপা রক্তমাংসের এক বাস্তব চরিত্র। মাত্র ৮ বছর বয়সে বিয়ে হয় তাঁর। দশম শ্রেণির গণ্ডি পেরনোর আগেই তাঁকে যেতে হয় শ্বশুরঘর করতে। আগামী ৫ জুলাই ২১ বছর পূর্ণ করবেন রূপা। আর সেই সঙ্গেই ভর্তি হবেন রাজস্থানের সরকারি মেডিক্যাল কলেজে। গল্পের আনন্দীর মতোই বাস্তবের রূপারও কিন্তু ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নের শরিক তাঁর শ্বশুরবাড়িই।
তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময়েই ১২ বছরের শঙ্কর লালের সঙ্গে বিয়ে হয় রূপার। শ্বশুরবাড়ি থেকেই ৮৪ শতাংশ নম্বর পেয়ে ক্লাস টেন পাশ করে রূপা। শঙ্করদের গ্রামে কোনও স্কুল ছিল না। তাই রূপার স্বপ্নপূরণে তাঁকে গ্রাম থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে এক প্রাইভেট স্কুলে ভর্তি করে দেন রূপার শাশুড়ি। ক্লাস টুয়েলভ পাশ করার পর বিএসসি পড়তে কলেজে ভর্তি হন রূপা। ডাক্তারি পড়ার স্বপ্নে বসেছিলেন অল ইন্ডিয়া প্রি-মেডিক্যাল টেস্টে। ২৩ হাজার র্যাঙ্ক করে মেডিক্যালে সুযোগ পাননি। ‘‘এক জন আমাকে বলেন, কোটা গিয়ে কোচিং করলে আমি পরীক্ষায় ভাল র্যাঙ্ক করতে পারবো। আমার ইচ্ছা থাকলেও শ্বশুরবাড়ির সম্মতি পাবো কি না বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু আমারা স্বামী, শ্বশুরবাড়ির সবাই রাজি হয়ে যান। আমাকে পড়ানোর জন্য ওরা অটোরিকশা চালাতে শুরু করে’’— কথাগুলো বলছিলেন বাড়ির গর্বিত ‘বহু’ রূপা।
স্বামী শঙ্করের সঙ্গে রূপা। ছবি: সংগৃহীত।
২০১৬ সালে পরীক্ষা দিয়েও মেডিক্যালে চান্স পাননি। আরও এক বছর রূপাকে পড়ানোর সামর্থ ছিল পরিবারের। গ্রামেও এর মধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে বাড়ির বউয়ের ‘স্পর্ধা’ নিয়ে কানাঘুষো, নিন্দামন্দ। যদি কোনও কিছু তুমি মন থেকে চাও, সেই অদম্য ইচ্ছাপূরণে কোনও না কোনও ভাবে সাহায্য ঠিক জুটেই যায়। ঠিক এমনটাই ঘটেছিল রূপার সঙ্গেও। কোচিং ইনস্টিটিউট তাঁর ফি ৭৫ শতাংশ কমিয়ে দেয়।
এই বছরের এনইইটি-তে রূপা ৭২০-র মধ্যে ৬০৩ নম্বর পেয়ে পাশ করেছেন। সারা ভারতে র্যাঙ্ক ২,২৮৩। জয়পুরের এসএমএস মেডিক্যালে কলেজে ভর্তি হতে চান রূপা। রূপার সাফল্যে গর্বিত কোটার সেই কোচিং ইনস্টিটিউট প্রতি মাসে স্কলারশিপ ঘোষণা করেছে মেধাবী ছাত্রীর। বউয়ের সাফল্যে গর্বিত শঙ্করও। কলা বিভাগে স্নাতক হওয়ার পর পরিবারের ১৩ বিঘা জমিতে বাকি ভাইদের সঙ্গে চাষবাস করেন শঙ্কর।
আরও পড়ুন: অ্যাসিডে পোড়া মুখ নিয়েই নতুন ছন্দে কবিতা
বাল্যবিবাহ দেশে বেআইনি হলেও এখনও গ্রামীণ ভারতে দারিদ্রসীমার নীচে থাকা বহু পরিবারে আর্থিক বোঝা কমাতে বিয়ে দেওয়া হয় বালিকা-কিশোরীদের। নিজেদের নিরাপত্তার খাতিরে সেই বিয়ে মেনে নেওয়া ও সারা জীবন বয়ে চলা মেয়েদের খুব কমই রূপা হয়ে ওঠার সাহস দেখাতে পারেন। স্বপ্ন দেখলেও রূপার শ্বশুরবাড়ির মতো উড়ানের অভাবে তাদের মতো বাল্য বয়সেই হারিয়ে যায় সেই স্বপ্নগুলো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy