Advertisement
০৫ মে ২০২৪

আতঙ্কের নয়, ইংল্যান্ডে মন্ত্র এখন বীরত্বের

সোমবার লন্ডন পৌঁছে দেখা গেল, এখানেও লোকে ম্যাঞ্চেস্টারের অভিনব দৌড় নিয়ে আলোচনা করছে। এতটাই তা সাড়া ফেলেছে যে, ইংল্যান্ডের অন্যান্য শহরে এই একতার দৌড় ছড়িয়ে পড়লে অবাক হওয়ার থাকবে না।

খোশমেজাজে: সতীর্থদের সঙ্গে ডিনারে বিরাট কোহালি।

খোশমেজাজে: সতীর্থদের সঙ্গে ডিনারে বিরাট কোহালি।

সুমিত ঘোষ
লন্ডন শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৭ ০৪:৩১
Share: Save:

আতঙ্কের ইংল্যান্ড নয়, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলা হবে মনে হচ্ছে সাহসিকতার ইংল্যান্ডে।

দেখেশুনে, লোকজনের কথাবার্তা শুনে সে রকমই মনে হচ্ছে। কফি-শপে বসে ক্রিকেটভক্ত বলে দিচ্ছেন, ‘‘অবশ্যই মাঠে যাব। টিউবে চড়াও মোটেও বন্ধ করিনি। জঙ্গিরা উড়িয়ে দেবে বলে ভয়ে গুটিয়ে বাড়িতে বসে থাকব নাকি?’’ তাঁর সঙ্গিনী যোগ করছেন, ‘‘থিয়েটার বা কনসার্টে যাওয়াটাও বন্ধ হবে না। আমরা ঠিকই আবার যাব। এ ভাবে জনজীবনকে তো থামিয়ে দেওয়া যায় না।’’

শুনতে শুনতে মনে হবে, ক্রিকেটীয় লড়াই বা এমনকী, ভারত-পাক সর্বসেরা দ্বৈরথও এখন কোনও লড়াই-ই নয় ইংল্যান্ডের মাটিতে। অনেক বড় যুদ্ধ ডেভিড বেকহ্যামের দেশের মানুষ লড়ছে সন্ত্রাসবাদের তোয়াক্কা না করে সুস্থ জনজীবন ধরে রাখা নিয়ে। আর সেখানে মাঠের বাইরের এই ‘বলো বীর, চির উন্নত মম শির’ মনোভাবের থেকে ক্রিকেটও শিখতে পারে।

গত কাল ‘ম্যাঞ্চেস্টার রান’-কে কেন্দ্র করে যেমন গোটা শহর, গোটা দেশ এক হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। প্রত্যেক বারই হয় এই ম্যারাথন দৌড়। কিন্তু এ বারে বাড়তি আবেগ যোগ হয়ে গেল কারণ, ম্যারাথনের স্লোগানটাই করে দেওয়া হয়েছিল— সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এক হও। আর সেই ‘এক হওয়া’র মধ্যেও সেই একই সুর— ভয় না পেয়ে স্বাভাবিক জীবনকে এগিয়ে নিয়ে চলো। সেই মন্ত্র ছড়িয়ে দিতে এমনকী, সেলেব-রাও নেমে পড়েছিলেন রাস্তায়।

আরও পড়ুন: ধোনির বিস্ময় স্ট্যাম্পিংয়ে হতবাক ক্রিকেট মহল

সোমবার লন্ডন পৌঁছে দেখা গেল, এখানেও লোকে ম্যাঞ্চেস্টারের অভিনব দৌড় নিয়ে আলোচনা করছে। এতটাই তা সাড়া ফেলেছে যে, ইংল্যান্ডের অন্যান্য শহরে এই একতার দৌড় ছড়িয়ে পড়লে অবাক হওয়ার থাকবে না।

ভক্তদের আশ্বস্ত করছেন যুবরাজ। ছবি: টুইটার

এই আবহের সঙ্গে আশ্চর্যজনক ভাবে মিশে গিয়েছে ক্রিকেটও। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মতো এত বড় একটা টুর্নামেন্ট হচ্ছে। তার ক’দিন আগে আরিয়ানা গ্রান্দের কনসার্টে এত বড় একটা জঙ্গি হানা হয়ে গিয়েছে। তার পরেও অহেতুক উদ্বেগ ছড়িয়ে নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি নেই। আইসিসি থেকে জেনে নেওয়া গেল, ক্রিকেটারদের বাইরে বেরনোর অনুমতির ওপরও নিষেধাজ্ঞা নেই।

আইসিসি-র এক কর্তা সোমবার বলে দিলেন, ‘‘বিরাট কোহালি তো লন্ডনে পৌঁছেই হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। সেই ছবি পোস্টও করেন টুইটারে। নিষেধাজ্ঞা থাকলে কি আর বেরতে পারতেন?’’ কোহালি বরাবরই খোলামেলা আবহাওয়ায় বিশ্বাসী। অধিনায়ক হওয়ার পরে টিমকে নিয়ে বাইরে লাঞ্চ বা ডিনার করার অভ্যেস বাড়িয়েছেন। বিশেষ করে বিদেশ সফরে থাকলে ক্রিকেটারেরা যাতে ঘরে বসে একঘেয়েমিতে না ভোগে, তার জন্য বিরাট-টোটকা হচ্ছে, যত পারো খোলা হাওয়ায় বাইরে বেরোও। বরাবরের সেই মনোভাব সন্ত্রাসাহত ইংল্যান্ডেও পাল্টায়নি। তার মানে কী দাঁড়াল? ক্রিকেটেও সেই এক বার্তা— সাহসী থাকো। ভয় না পেয়ে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে চলো।

লন্ডনে পৌঁছনোর পরেই সব দলের ম্যানেজারদের নিয়ে আইসিসি নিরাপত্তা সংক্রান্ত একটি জরুরি বৈঠক করে। সেখানে আইসিসি গোয়েন্দারা বুঝিয়ে বলেন, কী ভাবে তাঁরা ক্রিকেটারদের জন্য সর্বোচ্চ পর্যায়ের বলয় তৈরি করে রেখেছেন। পাশাপাশি, সেই বৈঠকে এটাও বলে দেন অফিসাররা যে, অহেতুক উদ্বেগ ছড়িয়ে ক্রিকেটারদের চলাফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা তাঁরা চাপাতে চান না। তাঁরা শুধু আশ্বস্ত করতে চান যে, নিরাপত্তা নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। ক্রিকেটাররা সুরক্ষিতই থাকছেন।

এটা বলে দেওয়ার আর একটা কারণ হচ্ছে, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো কয়েকটি দেশ জঙ্গিহানার জেরে নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছিল। তাঁদের দলের ক্রিকেটারেরাও উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চেয়েছিল বোর্ডের কাছে যে, এই পরিস্থিতিতে ইংল্যান্ডে খেলতে যাওয়া ঠিক হবে কি না। আইসিসি গোয়েন্দারা আশ্বস্ত করেন, তাঁরা দায়িত্ব নিচ্ছেন। খেলা চলুক।

আট দেশের আট ক্যাপ্টেনের মধ্যে যিনি এমন উদ্বেগের পরিস্থিতির মধ্যেও খোলা হাওয়া রাখার বার্তা শুনে সব চেয়ে খুশি হয়েছেন, তাঁর নাম বিরাট কোহালি। শুনলাম, তিনি দলকে বলেই দিয়েছেন, সুযোগ পেলেই আমরা বাইরে বেরোব। একঘেয়েমি যেন না আসে। যার অর্থ, ২০০৩-০৪ মরসুমে সেই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যেমন পাকিস্তানের কড়া নিরাপত্তার কর্ডন উপেক্ষা করে বাইরে বেরিয়ে পড়ছিলেন, এখানেও তেমন ঘটনা বার বার দেখা যেতে পারে। কখনও ভারত অধিনায়ক একা-একা হাঁটতে বেরিয়ে পড়লেন, কখনও হয়তো হেয়ারকাট নিতে। কখনও আবার টিমের বড় একটা গ্রুপকে নিয়ে কোনও রেস্তোরাঁয় প্রিয় তাই বা জাপানিজ খাবারের খোঁজে চললেন।

আর সেটা হওয়া মানে সন্ত্রাস দমনে ইংল্যান্ডের মন্ত্রের সঙ্গেই এক হয়ে গেল কোহালি এবং তাঁর দল। তখন দ্বিতীয় ‘দিল জিত লো’ সফর হয়ে দাঁড়াতে পারে এটা। তা সে যতই ইংল্যান্ডে কোহালির অতীত ইতিহাস যন্ত্রণাদায়ক হোক। এ বারের সফরটা যে শুধু ক্রিকেট নয়। বাইশ গজে যেমন দেখা হবে কে কত রান করল, তেমনই মাপা হবে জীবনের পিচে কে কতটা বীরত্ব দেখাতে পারল! আর তার জন্য ন্যূনতম শর্ত হচ্ছে, হোটেলে হাত-পা গুটিয়ে বসে রুম সার্ভিস অর্ডার না দিয়ে বাইরের খোলা হাওয়ায় রেস্তোরাঁ অভিযানে বেরিয়ে পড়ো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE