Advertisement
০২ মে ২০২৪

আশা তৈরি করেও শেষবেলায় হতাশা

প্রথম দিনের হিসেবে ডুপ্লেসি-ই এগিয়ে থাকলেন। প্রবল চাপের মধ্যে  পড়া দলকে উদ্ধার করে তিনি ম্যাচে ফিরিয়ে আনলেন এ বি ডিভিলিয়ার্সের সঙ্গে জুটি বেঁধে।

উল্লাস: কেপ টাউনে প্রথম দিনে বিরাট কোহালিকে ফিরিয়ে দিয়ে মর্নি মর্কেলের হুঙ্কার। দিনের শেষে তিন উইকেট হারিয়ে চাপে ভারত। ছবি: এপি।

উল্লাস: কেপ টাউনে প্রথম দিনে বিরাট কোহালিকে ফিরিয়ে দিয়ে মর্নি মর্কেলের হুঙ্কার। দিনের শেষে তিন উইকেট হারিয়ে চাপে ভারত। ছবি: এপি।

সুমিত ঘোষ
কেপ টাউন শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৮ ০৪:৩৫
Share: Save:

স্টিভ স্মিথের পর ফ্যাফ ডুপ্লেসি। ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহালি তাঁর নতুন ‘শত্রু’ বানিয়ে ফেললেন। কেপ টাউনের মাঠে মহারণের প্রথম দিনেই যে রকম ঝলক দেখা গেল, গোটা টেস্ট সিরিজ জুড়ে দু’জনের ঠোকাঠুকিতে আগুন জ্বললে অবাক হওয়ার থাকবে না।

প্রথম দিনের হিসেবে ডুপ্লেসি-ই এগিয়ে থাকলেন। প্রবল চাপের মধ্যে পড়া দলকে উদ্ধার করে তিনি ম্যাচে ফিরিয়ে আনলেন এ বি ডিভিলিয়ার্সের সঙ্গে জুটি বেঁধে। কোহালি সেটা পারলেন না। দুই উইকেট পড়ে যাওয়ার পরে ব্যাট করতে নেমে পাঁচ রানের মাথায় খোঁচা দিয়ে আউট হলেন মর্নি মর্কেলের বলে। সেই অফস্টাম্পের বাইরের বল, সেই ব্যাট সরাতে না পারা। ইংল্যান্ডে ডায়গনসিস হওয়া পুরনো রোগ হৃদয়ভঙ্গ করে দিল নিউল্যান্ডসেও।

বৃহস্পতিবার প্রাক-ম্যাচ সাংবাদিক বৈঠকে এসে ডুপ্লেসি বলেছিলেন, ভারতের সঙ্গে তাঁর হিসেব চোকানোর আছে। পরিষ্কার ইঙ্গিত ছিল, দু’ বছর আগে তাঁদের ভারত সফরের দিকে। যখন বিরাট ব্রিগেড ঘূর্ণি বানিয়ে তাঁদের ৩-০ দুরমুশ করেছিল। ডুপ্লেসি যেন হুঁশিয়ারি দিয়ে দিলেন যে, তোমাদের পাড়ায় ক্রিকেটীয় স্পিরিটের তোয়াক্কা না করে আমাদের হারিয়েছিলে। এ বার আমাদের পাড়ায় কোনও আতিথেয়তা আশা করো না।

কোহালি চরিত্রটাই এমন ডাকাবুকো যে, চুপচাপ কারও হুঁশিয়ারি শোনার বান্দা তিনি নন। গত কাল প্রেস কনফারেন্সে আসেননি বলে তাঁর জবাবটা পাওয়া যায়নি। মনে হচ্ছিল, টসের সময় এসে জবাব দিতে পারেন। কয়েক দিন আগেই এমন করেছেন। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে দেশের মাঠে শেষ সিরিজের সময় প্রতিপক্ষ শিবিরের তির্যক মন্তব্যের উত্তর দিয়েছিলেন টস করতে এসে।

এ দিন ঠিক সেটাই করলেন। পাল্টা শুনিয়ে দিলেন, ‘‘ওরা ব্যাটসম্যান কম নিয়ে খেলবে, আমরা জানতাম। নতুন বল দিয়ে ওদের আক্রমণ করব।’’ আজ পর্যন্ত কোনও ভারত অধিনায়কের মুখ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে টস করার সময় এমন দুঃসাহসিক মন্তব্য শোনা যায়নি! বরাবর দক্ষিণ আফ্রিকা মানেই যে ভারতের জন্য ভয়ের, হাড় হিম করা সব অভিজ্ঞতা হাজির থেকেছে।

ও দিকে, ম্যাচ শুরুর লগ্নেই প্রবল নাটক এবং তর্ক-বিতর্ক। টস জিতেও ফ্যাফ ডুপ্লেসি ব্যাটিং নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকান সংবাদমাধ্যমেও দেখলাম, বিরাট আলোড়ন পড়ে গিয়েছে। তাঁরাও বলতে থাকলেন, এই তো ক্যাপ্টেন গত কালই প্রেস কনফারেন্সে বসে গেলেন, যে রকম উইকেট চেয়েছেন সে রকমই পাচ্ছেন। চার পেসারে প্রথম একাদশ গড়েছেন। ডেল স্টেন, মর্নি মর্কেল, কাগিসো রাবাডা, ভার্নন ফিল্যান্ডার। বিশ্বের সেরা পেস আক্রমণের আখ্যা পেতে পারে। তার পরেও টস জিতে ব্যাটিং কেন? কোথায় ভারতের উপর গতির বোমাবর্ষণ শুরু করব, তা না, নিজেরাই ব্যাট করতে নামছি ঘাস থাকা পিচে উন্নত ভারতীয় পেস
বোলিংয়ের সামনে!

বোঝা গেল, কিছু গড়বড় হলে নিজের দেশের সংবাদমাধ্যমেই আজ তুলোধনা হবেন দক্ষিণ আফ্রিকান অধিনায়ক। আর বলে না, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়। ভুবনেশ্বর কুমার শুরুতেই ঝটকা দিয়ে দিলেন দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটিংয়ে। প্রথম তিন ওভারে তুলে নিলেন তিন উইকেট। তার মধ্যে আবার রয়েছে হাসিম আমলার মূল্যবান উইকেট। ডুপ্লেসি যখন ব্যাট হাতে নামছেন, তখন কাউকে কাউকে বলতে শোনা গেল, ক্যাপ্টেন নিজে প্রমাণ করুক ব্যাটিং নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল। বোঝা গেল, চোট থেকে ফেরা ডুপ্লেসির জীবনের অন্যতম কঠিন পরীক্ষা হতে যাচ্ছে আজ। তা সে যতই তিনি নিজের দেশে, নিজের পছন্দের পিচে
খেলতে নামুন।

এ দিকে, ডুপ্লেসি-কে দেখে মনে হল কোহালির রক্ত চলাচল আরও বেড়ে গিয়েছে। শরীরী ভাষা আরও আক্রমণাত্মক হয়ে গেল তাঁর। নিশ্চয়ই ‘হিসেব চোকানোর আছে’ বাজনাটা বেজে চলছিল কানের মধ্যে। তিনি চক্রব্যূহ তৈরি করে দিলেন দক্ষিণ আফ্রিকান অধিনায়কের চারধারে। তিন স্লিপ, গালি, পয়েন্ট তো ছিলই। এ বার শর্ট লেগও নিয়ে এলেন। কার আক্রমণ করার কথা, কারা করছে, সব আবার কেমন গুলিয়ে গেল।

ডুপ্লেসি-ও কম ডাকাবুকো নন। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে মুখের মধ্যে থাকা জেলি লজেন্স লাগিয়ে বল পালিশ করে চকচকে করার ছবি টেলিভিশনে ধরা পড়েছিল তাঁর। বল-বিকৃতির দায়ে আইসিসি সাসপেন্ড করে। সেই সময় অস্ট্রেলীয় সংবাদমাধ্যম তাঁর পিছনে পড়ে গিয়েছিল। ডুপ্লেসি শুধু মাঠের বাইরে আক্রমণাত্মক অস্ট্রেলীয় মিডিয়াকেই সামলাননি, নির্বাসন থেকে ফিরে পরের টেস্টেই দুরন্ত সেঞ্চুরি করেন। এখানেও তাঁকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ দেখাতে থাকল। সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার বহু যুদ্ধের ঘোড়া এ বি ডিভিলিয়ার্স। যাঁর নির্বাচন নিয়েই সংশয় চলছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার টিম ম্যানেজমেন্ট এবং নির্বাচকেরা নিশ্চয়ই দিনের শেষে বুঝতে পারছেন, এ বি-কে বসানোর মতো মুর্খামি করলে প্রথম দিনে কী পরিণতি হতে পারত! সফরকারী দলের কাছে হেনস্থা হতে হতো তাদেরই।

ডিভিলিয়ার্স এবং ডুপ্লেসি দু’জনেই হাফ সেঞ্চুরি করে দলকে নিয়ে গেলেন ভদ্রস্থ জায়গায়। যখন মনে হচ্ছিল শুরুর চাপ কাটিয়ে টেস্ট ম্যাচের রংটাই তাঁরা বদলে দিতে চলেছেন, তখনই বুম বুম বুমরার কাটারে ছিটকে গেল এ বি-র অফস্টাম্প। বুমরা-কে টেস্টে খেলানোর পরিকল্পনা ঠিক হল কি না, সেই প্রশ্ন নিয়ে সকালে তুমুল আলোচনা চলছিল (কেপ টাউনে শুক্রবার যে বুমরা-র টেস্ট অভিষেক হবে, সেই খবর এ দিন শুধু আনন্দবাজারেই প্রকাশিত হয়)। কিন্তু সবচেয়ে দামী উইকেটটি তুলে নেওয়ার পরে আশাবাদী হওয়াই যায়। আর কোহালিকে দেখা গেল, ডুপ্লেসি আউট হতেই ‘সেন্ড অফ’ দিচ্ছেন। বাঘের গুহায় এসে বাঘকে হুঙ্কার দিয়ে বেরিয়ে যেতে বলা। আম্পায়ার তক্ষুনি ভারত অধিনায়ককে ডেকে কথা বলছেন। অর্থাৎ, আগুনের ফুল্কি বাড়তে দেওয়া যাবে না। কী দুর্ধর্ষ প্রতিযোগিতার আবহ তখন মাঠে! কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলছে না। যেখানে পঁচিশ বছর কোনও টেস্ট সিরিজ জেতেনি ভারত, সেখানে এসে প্রথম দিনেই হোম টিমকে চাপে ফেলে দিচ্ছে। সেই চাপ সামলে দক্ষিণ আফ্রিকার দুই সিনিয়র ব্যাটসম্যান প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন। তার পর আবার ম্যাচে ফিরে আসছে ভারত। তারিয়ে তারিয়ে উত্তেজক ক্রিকেট উপভোগ করছে হাউসফুল নিউল্যান্ডস স্টেডিয়াম। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, আইপিএল এবং টি-টোয়েন্টির রমরমার যুগে টেস্ট ক্রিকেটের জন্যই তো এটা সেরা বিজ্ঞাপন।

কোহালি প্রতিপক্ষ অধিনায়ককে ‘সেন্ড অফ’ দিলেন। কে জানত, সেটাই ফেরত আসবে শেষ বেলায়। ভারত অধিনায়কের উইকেটটা তুলতেই যে ভাবে উৎসবে মেতে উঠল গোটা দক্ষিণ আফ্রিকা দল, মনে হচ্ছিল টেস্ট ম্যাচের ভাগ্যই নির্ধারণ হয়ে গিয়েছে। জেনারেলকে মেরে ফেলতে পারলে তাঁর সেনাবাহিনীও কাত হয়ে পড়বে— যুদ্ধের চিরাচরিত সেই মন্ত্র। বিরাট-শিকারে তাই আবহটাই যেন বদলে গেল মাঠের।

মর্নি মর্কেল দক্ষিণ আফ্রিকার ভদ্রলোক ক্রিকেটারদের একজন। খুব একটা স্লেজিং করতে দেখা যায়নি কখনও। তিনিও এমন গর্জে উঠলেন এবং প্যাভিলিয়নের দিকে হাঁটতে থাকা কোহালির দিকে ফিরে চিৎকার করে উঠলেন যে, মনে হচ্ছিল প্রথম দিনেই না মাঠে অপ্রীতিকর কিছু ঘটে তিক্ততা ছড়িয়ে পড়ে! শেষ পর্যন্ত সেটা হল না কারণ আউট হওয়া ভারত অধিনায়ক মুখ নিচু করেই বেরিয়ে গেলেন। ক্রিকেট গর্বে আঘাত লাগা কোহালি দ্বিতীয় ইনিংসে কী ভাবে জবাব দেন, তার দিকে তাকিয়ে থাকবে গোটা ক্রিকেট দুনিয়া।

আপাতত যা পরিস্থিতি, দ্বিতীয় ইনিংস খুব দূরে না-ও থাকতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম ইনিংস ২৮৬ রানে গুটিয়ে দিয়েও দিনের শেষ ১১ ওভারে ভারত ২৮-৩ হয়ে গিয়েছে। এখনও ২৫৮ রানে পিছিয়ে তারা। সকালে যাদের অ্যাডভ্যান্টেজ ছিল, তারাই এখন পাল্টা চাপে।

দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে যেমন টস জিতে ব্যাটিং নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল, তেমনই ভারতের প্রথম একাদশ নিয়েও চর্চা চলছে। সফরের প্রথম টেস্টে সহ-অধিনায়ককে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এমন ঘটনা সচরাচর দেখা যায় না। এ দিন সেটাই করা হল। অজিঙ্ক রাহানে-কে বসিয়ে খেলানো হল রোহিত শর্মা-কে। তেমনই আনন্দবাজারে এ দিন প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, পাঁচ বোলারে খেলার কথা ভেবে হার্দিক পাণ্ড্য-কেও নামানো হল। বিশেষ করে রাহানে-কে বসানোর সিদ্ধান্ত মাইক্রোস্কোপের তলায় পড়তে বাধ্য। কারণ, বিদেশের মাঠে তাঁর ভাল রেকর্ড। টিম ম্যানেজমেন্ট আবার অতীতের স্কোরবোর্ড নয়, সাম্প্রতিক ফর্মের উপর গুরুত্ব দিতে চেয়েছে। তাই রাহানের জায়গায় রোহিত।

তবু সকালটা ভুবনেশ্বর কুমার দারুণ ভাবে শুরু করিয়ে দেওয়ার পরে মনে হচ্ছিল, বিদেশের মাঠে নতুন সূর্যোদয় ঘটতে চলেছে। সত্যিই তো এতটা ইতিবাচক, আক্রমণাত্মক শরীরী ভাষা খুব কমই কোনও ভারতীয় দলের কাছ থেকে বিদেশ সফরের প্রথম দিনে দেখা গিয়েছে। কে জানত, যেটা তাদের শক্তি সেই ব্যাটিংই ব্রেক ফেল করবে শেষ বেলায়। কে জানত, বোলারদের তৈরি করা উর্বর জমিতে শিখর ধবন-রা উল্টোপাল্টা ট্রাক্টর চালিয়ে এমন এবড়ো-খেবড়ো করে দিয়ে আসবেন! প্রথম দিনের খেলায় গব্বরের মতোই খলনায়ক ধবন। স্লিপে যে রকম সহজ ক্যাচ ফস্কালেন, তেমনই ডেল স্টেন-কে বাজে শটে উইকেট উপহার দিয়ে গেলেন। ওই ক্যাচটা ধরতে পারলে ভুবনেশ্বরের পাঁচ উইকেট হয়ে যায়।

কেপ টাউনে আকাশের রং বদলে যায় ক্ষণিকে। এই উজ্জ্বল টেবল মাউন্টেন তো পরক্ষণেই তা মেঘের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। কোহালিদের ভাগ্যও যেন তেমনই লুকোচুরি খেলল হাইভোল্টেজ সিরিজের প্রথম দিনে। উজ্জ্বল আকাশ তৈরি হয়েও আশার পর্বতচূড়ো মিলিয়ে গেল শেষ বেলার অন্ধকারে।

এখন তাকিয়ে থাকা নতুন সকালের দিকে। যদি ফের সূর্যোদয় ঘটে! অক্ষত যে এখনও চেতেশ্বর পূজারা। যাঁর আর এক নাম লড়াই!

ভারত

মুরলী বিজয় ক এলগার বো ফিল্যান্ডার ১

শিখর ধবন ক ও বো স্টেন ১৬

চেতেশ্বর পূজারা ব্যাটিং ৫

বিরাট কোহালি ক ডি’কক বো মর্কেল ৫

রোহিত শর্মা ব্যাটিং ০

অতিরিক্ত

মোট ২৮-৩

পতন: ১৬-১ (মুরলী, ৪.৪), ১৮-২ (ধবন, ৫.২), ২৭-৩ (কোহালি, ৮.১)।

বোলিং: ফিল্যান্ডার ৪-১-১৩-১, স্টেন ৪-১-১৩-১, মর্কেল ২-২-০-১, রাবাডা ১-০-১-০।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cricket India-South Africa Test Cape Town
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE