মাঠে সুধীর কুমার।
সচিন তেন্ডুলকরের সবচেয়ে বড় ভক্ত হিসেবেই ক্রিকেট দুনিয়ায় পরিচিত তিনি। সচিনের খেলা দেখতে পড়াশুনা ছেড়েছেন, একাধিকবার কাজও ছেড়েছেন। বিয়ের প্রস্তাব পর্যন্ত নাকচ করে দিয়েছেন যাতে সারা দেশ ঘুরে তিনি সচিনের খেলা দেখতে পারেন। তিনি সুধীর কুমার চৌধুরি ওরফে সুধীর কুমার গৌতম। বিহারের মুজফ্ফরপুরের বাসিন্দা। ২০১৩-র নভেম্বরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন সচিন। তাহলে সুধীর কুমার কি এখন আর ক্রিকেট দেখেন না? তিনিও কি ২০১৩-র নভেম্বরের পর থেকে ক্রিকেট দেখা ছেড়ে দিয়েছেন? না, সচিনের সবচেয়ে বড় ভক্ত কখন যে ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ফ্যান হয়ে গিয়েছেন, তার হিসেব হয়তো রাখেননি খোদ সুধীর গৌতম।
১৯৮১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বিহারের মুজাফ্ফরপুরের দরিদ্র পরিবারে জন্ম হয় সুধীরের। যখন তাঁর মাত্র ছ’ বছর বয়স তখন থেকেই টিভিতে সচিনের খেলা শুরু হলেই নাওয়া খাওয়া ভুলে যেতেন তিনি। ক্রিকেট আর সচিনের খেলা দেখার নেশায় চোদ্দ বছর বয়সেই পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। অভাবের সংসারে বাড়ির ছেলে কাজ না করে বসে থাকবে তা তো হতে পারে না। তাই আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীদের চেষ্টায় ছোটখাট কাজও জুটে যায় সুধীরের। কিন্তু ভারতের খেলা থাকলেই মুশকিল! কাজ কামাই করেও খালা দেখা চাই। আর তা নিয়ে যদি কাজের জায়গায় খুব সমস্যা হয়, তা হলে সে কাজই ছেড়ে দিতেন তিনি। এমনটা অনেকবারই হয়েছে তাঁর জীবনে। একটা সময়ের পর সুধীরের পরিবারও তাঁর এই ক্রিকেট নিয়ে পাগলামী মেনে নিতে পারল না। ভারতের খেলা থাকলে সুধীর খেলা দেখবেনই আর তা নিয়ে তাঁর বাড়িতেও অশান্তি হবেই। কিন্তু এত কিছুর পরও বদলালেন না সুধীর।
১৯ জানুয়ারি ২০০১-এ কলকাতার ইডেন গার্ডেন্স। মাঠে গিয়ে জীবনের প্রথম ভারতের লাইভ ম্যাচ দেখেন সুধীর কুমার গৌতম। ব্যাস, তার পরই মাঠে গিয়ে খেলা দেখার নেশাটা চেপে বসে সুধীরের জীবনে। ২০০২-এ মুজফ্ফরপুর থেকে জামশেদপুরে ভারতের খেলা দেখার জন্য যাতায়াত মিলিয়ে প্রায় ১১০০ কিলোমিটার পথ সাইকেলে অতিক্রম করেন তিনি। ২০০৩-এ টানা ১৮ দিন সাইকেল চালিয়ে মুম্বই পৌঁছন ভারতের খেলা দেখার জন্য। পকেট প্রায় খালি, খাওয়ার পয়সাও প্রায় নেই। তাই দু’রাত ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম চত্বরেই কাটাতে হয় তাঁকে। ওই বছরই বেঙ্গালুরুতে ম্যাচ দেখতে যান সুধীর। তবে এ বার আর সাইকেলে নয়। তিন বার ট্রেন বদলে প্রায় ৬০ ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রা পেরিয়ে চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে পৌঁছন তিনি। দীর্ঘ এই ট্রেন সফর অবশ্য তিনি বিনা টিকিটেই করেছিলেন। কারণ, ট্রেনের টিকিট কাটলে ম্যাচের টিকিট আর খাওয়ার টাকা থাকত না। ২০০৬ সালে ভারতের পাকিস্তান সফরের সময় তিনি প্রায় ১৭০০ কিলোমিটার পথ সাইকেলে পেরিয়ে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন দেশের হয়ে গলা ফাটাতে। একই ভাবে ২০০৭, ২০১১ এবং ২০১২-এ প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার পথ সাইকেল চালিয়ে সুধীর বাংলাদেশে গিয়েছিলেন ভারতীয় দলকে সমর্থন করতে। দেশে বা দেশের বাইরে যেখানেই সুধীর যান, সেখানেই তাঁর সঙ্গে থাকে তাঁর বাড়িতে বানানো তিন মিটার লম্বা তেরঙ্গা। এই তেরঙ্গার মাঝের অশোক চক্রটি বানাতে তাঁকে অবশ্য কলকাতায় আসতে হয়েছিল। ভারতের প্রত্যেক ম্যাচের আগের রাত থেকেই প্রস্তুতি শুরু করে দেন সুধীর। ঠিক যেমন ভাবে আমরা তাঁকে মাঠে দেখতে অভ্যস্ত, তেমন করে সারা শরীরকে তেরঙ্গায় রাঙিয়ে সেজে ওঠেন তিনি। সুধীর বলেন, “আমার সারা শরীরে তেরঙ্গা আঁকার সময় থেকে ম্যাচ শেষ হওয়া পর্যন্ত আমি ঘুমোতে পর্যন্ত পারি না। সারা রাত বসেই কাটাতে হয়। কিছু খাওয়াও হয় না। কারণ, বেশির ভাগ সময় রং করাতেই সব টাকা শেষ হয়ে যেত।”
আরও পড়ুন: আইসিসি-ও বলছে, বিরাটরা আজ ফেভারিট
২০০৯-এ কানপুরে সচিনের সঙ্গে হাত মেলাতে গিয়ে পুলিশের ধমক আর ধাক্কা খেতে সুধিরকে। ভাগ্যিস সে দিন পুলিশ তাঁকে আটকেছিল! তাই সে দিন তাঁর ঈশ্বরের নজরে পড়ে যান সুধীর। সচিন ওই পুলিশ আধিকারিককে অনুরোধ করেন সুধীরকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। দেখা করে হাত মেলান তাঁর ভক্তর সঙ্গে। এই ঘটনার পর থেকে সুধীরকে ভারতের কোনও ম্যাচ দেখার জন্য আর টাকার জন্য ভাবতে হয়নি। বিসিসিআই তাঁর ম্যাচ দেখার সমস্ত খরচ যোগায়। কারণ, সুধীর কুমার গৌতম এখন ভারতীয় ক্রিকেটের একমাত্র ‘অফিসিয়াল ফ্যান’। সুধীর বলেন, “আমার ইচ্ছে, যত দিন আমি বেঁচে থাকব, ততদিন যেন আমি মাঠে ভারতের পতাকা ওড়াতে পারি।”
সচিন তেন্ডুলকরের সবচেয়ে বড় ভক্ত হিসেবেই ক্রিকেট দুনিয়ায় পরিচিত সুধীর।
ভারতীয় ক্রিকেটে সচিন-যুগ শেষ হয়েছে আগেই। এখন বিরাট কোহালি শাসন করছেন ক্রিকেট বিশ্ব। কালের নিয়মে একদিন বিরাট যুগেরও অবসান হবে। কিন্তু সুধীরের মতো ভক্তরা যুগের পর যুগ ধরে রয়েই যাবেন। সংসারে অভাবের আঁধার থাকলেও ক্রিকেটের আলো সব সময় পড়বে তাঁদের উপর। ক্যামেরাও ঘুরে যাবে তাঁদের দিকে। টিভিতে ধারাভাষ্যকার হয়তো তাঁকে নিয়ে বলে উঠবেন দু’ চার লাইন। সচিন কিন্তু এখনও সুধীরের ঈশ্বর। কারণ, তাঁর গোটা দুনিয়াটাই যে ক্রিকেটময়।
ছবি: ফেসবুক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy