ঘরে-ফেরা: বিমানবন্দরে রমেশ ও রুদ্রপ্রসাদ। সোমবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
গত সাত দিনে সাফল্য ও ব্যর্থতা দু’টোই সামনে থেকে দেখেছেন তাঁরা। পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম ও অন্যতম দুর্গম শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযান সফল হলেও প্রিয় দুই বন্ধুকে চোখের সামনে হারিয়েছেন সোনারপুরের রুদ্রপ্রসাদ হালদার ও হৃদয়পুরের রমেশ রায়। এই দুই বঙ্গসন্তানই কাছ থেকে দেখেছেন মৃত্যুকেও। বেঁচে ফিরলেও তাই বন্ধুদের হারানোর শোক কাটছে না তাঁদের। তবে তা সত্ত্বেও রমেশ ও রুদ্রপ্রসাদ দু’জনেই বলছেন, ‘‘ফের যাব অভিযানে। ওটাই তো আমাদের মনের রসদ।’’
কাঠমান্ডু থেকে সোমবার বিকেলেই কলকাতা ফিরেছেন রমেশ ও রুদ্রপ্রসাদ। সন্ধে সোয়া ছ’টা নাগাদ বিমানবন্দর থেকে বেরিয়েই উপস্থিত সংবাদমাধ্যমকে রমেশবাবুর প্রথম প্রতিক্রিয়া, ‘‘বিপদ ছাড়া পর্বতাভিযান হয় নাকি?’’ আর পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের কর্মী রুদ্রপ্রসাদও সে ভাবেই বলে দেন, ‘‘মৃত্যু তো জীবনের একটা অঙ্গ! বিপদ বাদ দিলে অভিযানের মজাটাই থাকে না।’’ রুদ্র ও রমেশ যখন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে এ কথা বলছেন, তখন প্রিয়জন ঘরে ফেরার আনন্দে রমেশবাবুর স্ত্রী প্রজ্ঞাপারমিতার চোখে আনন্দাশ্রু। পুত্র রৌহিনের মুখে আলো করা হাসি। স্বস্তির ছাপ রুদ্রপ্রসাদের জামাইবাবু বিশ্বনাথ বাগের চোখেমুখেও। বিশ্বনাথবাবু বলেন, ‘‘১৪ মে পর্যন্ত যোগাযোগ ছিল। কিন্তু ১৫ মে রাত থেকে আর যোগাযোগ হচ্ছিল না। পরের দিন জানতে পারি, দুর্ঘটনা ঘটেছে। তবে সুস্থ আছে ওরা। আজ চোখে দেখতে পেয়ে দারুণ আনন্দ হচ্ছে।’’
সফল অভিযান সেরে ঘরে ফেরা দুই অভিযাত্রীই মানছেন, এ পর্যন্ত করা তাঁদের অন্য অভিযানের চেয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা অনেক বেশি দুর্গম। রমেশবাবু বলেন, ‘‘অনেকটা রক ক্লাইম্বিং করতে হয়। অক্সিজেন সিলিন্ডার ও জিনিসপত্র নিয়ে চলাচল কষ্টকর। যা জানতাম, তার চেয়েও বেশি দুর্গম পথ।’’ আর রুদ্রপ্রসাদ বলেন, ‘‘সামিট ক্যাম্প থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা শৃঙ্গ অনেকটা পথ!’’
নিজেরা বেঁচে ফিরলেও, কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযান সেরে ফেরার পথে প্রয়াত দুই বাঙালি অভিযাত্রী কুন্তল কাঁড়ার ও বিপ্লব বৈদ্য নিয়ে কথা উঠলেই শোক গ্রাস করছে রুদ্র ও রমেশকে। দু’জনেই এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করছেন শেরপাদের। রমেশ বলছেন, ‘‘শেরপাদের জন্যই এই সমস্যা। আমাদের চার জনের শৃঙ্গে ওটার কথা ছিল। শেরপারা মাঝ রাতে সিলিন্ডার পাল্টে দিয়েই চলে যায়। এই কারণেই দুর্ঘটনা।’’ রুদ্রপ্রসাদের অভিমত, ‘‘শৃঙ্গজয়ের ব্যাপারটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার খেলা। কোথায় থামতে হবে সেটা জানতে হয়। এটা ফুটবল ম্যাচ নয় যে, লাল কার্ড দেখার পরে এক ম্যাচ বসে পরের ম্যাচে নামতে পারব। এখানে লাল কার্ড দেখলে জীবন শেষ। কুন্তলকে ওর সহযাত্রীরা অনেকে বুঝিয়েছিলেন, আর না এগোতে। সেটা উপেক্ষা করেই এগোতে গিয়ে চরম বিপদ ডেকে আনে কুন্তল।’’
এ দিন বিমানবন্দরে ভয়াবহ সেই অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন রুদ্রপ্রসাদ। তাঁর কথায়, ‘‘রমেশদার সিলিন্ডার ছিল না। তাই আমার সিলিন্ডার দিয়েছিলাম। শৃঙ্গ থেকে আড়াইশো মিটার অক্সিজেন ছাড়া নেমেছি। ৮,২০০ মিটারের কাছাকাছি নেমে অক্সিজেন পাই। তখনই আমি এবং আমার শেরপা আবিষ্কার করি কুন্তলকে।’’ যোগ করেন, ‘‘কুন্তলের তখন অক্সিজেন মাস্ক ছিল না। ওর শেরপাও চলে গিয়েছে। ক্লান্ত অবস্থায় উবু হয়ে বসেছিল। ওই অবস্থাতেই আমি ও আমার শেরপা ওকে ২০০ মিটার নামাই। সামিট ক্যাম্প তখনও সাত-আটশো মিটার। আমার শেরপা বারবার বলছিল, কুন্তলকে ফেলে আসতে। না হলে আমরা তিন জনেই মরব। এক সময় সে আমাদের ছেড়ে চলেই যায়।’’ রুদ্র বলে চলেন, ‘‘তার পরেও আমি কুন্তলকে একশো মিটার নামিয়ে বুঝতে পারি আর পারব না। অক্সিজেন কমে আসছে। তখন স্যাটেলাইট ফোনে কাঠমান্ডু ও কলকাতাকে এসওএস পাঠিয়ে নামতে শুরু করি। শেষ বেলায় কুন্তল বলল, আমাকে শুইয়ে দিয়ে তুই নেমে যা। এর পরেই ফের বিপদ সঙ্কেত পাঠিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে
নেমে আসি।’’
রুদ্র ও রমেশ ফিরলেও এ দিনও ময়নাতদন্ত হয়নি প্রয়াত কুন্তল আর বিপ্লবের। কাঠমান্ডু থেকে রাজ্য ক্রীড়া পর্ষদের পর্বতারোহণ দফতরের উপদেষ্টা দেবদাস নন্দী জানিয়েছেন, ‘‘ময়নাতদন্ত সারতে সময় লাগবে। ফিরতে শনিবার হতে পারে।’’ এ দিকে, মাকালু শৃঙ্গ জয় করে ফেরার পথে নিখোঁজ দীপঙ্কর ঘোষের এখনও কোনও সন্ধান মেলেনি। এ দিনও হেলিকপ্টার নিয়ে তল্লাশি হয়েছে। আগামীকাল শেষ তল্লাশি হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy