Advertisement
২৪ মে ২০২৪

চিনা মডেল হটিয়ে রিওয় নতুন দাদা ব্রিটেন

তাঁর শারীরিক গঠনে ছিল পুরুষের কাঠিন্য। মস্কো অলিম্পিক্সে ৪০০ মিটার মেডলিতে সেই সোনাজয়ী সাঁতারু ভিকট্রি স্ট্যান্ড থেকে নেমে বলেছিলেন, রুপোজয়ীকে তিনি সোনার পদকটা এক কথায় দিয়ে দেবেন। বিনিময়ে চান প্রতিদ্বন্দ্বীর স্বাভাবিক নারীসুলভ গড়নটা। নিজের দেশ, সাবেক পূর্ব জার্মানিতে সেই সোনাজয়ী পেট্রা স্নেইডার ছিলেন সাড়া ফেলা নাম।

রতন চক্রবর্তী
রিও দে জেনেইরো শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৬ ০৩:৩৫
Share: Save:

তাঁর শারীরিক গঠনে ছিল পুরুষের কাঠিন্য। মস্কো অলিম্পিক্সে ৪০০ মিটার মেডলিতে সেই সোনাজয়ী সাঁতারু ভিকট্রি স্ট্যান্ড থেকে নেমে বলেছিলেন, রুপোজয়ীকে তিনি সোনার পদকটা এক কথায় দিয়ে দেবেন। বিনিময়ে চান প্রতিদ্বন্দ্বীর স্বাভাবিক নারীসুলভ গড়নটা। নিজের দেশ, সাবেক পূর্ব জার্মানিতে সেই সোনাজয়ী পেট্রা স্নেইডার ছিলেন সাড়া ফেলা নাম।

কয়েক দশক পর রিওয় মেয়েদের টেবল টেনিসে জোড়া সোনা় জিতে আলোড়ন ফেলেছেন চিনের ডিং নিং। বছর ছাব্বিশের বাঁ হাতির গঠনও ইস্পাত কঠিন। পেলব, কোমল শব্দগুলোর ওঁর জন্য নয়। পেট্রা আর ডিং নিংয়ের মধ্যে মিল বোধহয় একটা জায়গায়— দু’জনেই খেলোয়াড় তৈরির এক অদ্ভুত কারখানার ফসল।

অলিম্পিক্সে মেডেল খরা কাটাতে এবং অবশ্যই পশ্চিমকে টেক্কা দিতে আশির দশক থেকে চিন সরকার সাবেক সোভিয়েত এবং পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট মডেল বেছে নেয়। যার নাম, ‘ক্যাচ দেম ইয়াং’। সব স্কুলে নির্দেশ যায়, খেলোয়াড় হতে পারে এমন শারীরিক গঠন দেখলেই ক্রীড়া প্রশাসনকে খবর দাও। পাঠিয়ে দাও খেলোয়াড় তৈরির কারখানায়।

বাড়ি-ঘর, বাবা-মা সব ছেড়ে, শৈশবের আদর-আহ্লাদ ছেড়ে দিনভর প্রশিক্ষণ। ঘরের দেওয়ালে বড় বড় করে লেখা, ‘‘সোনা, সোনা, সোনা।’’ চার-পাঁচ-ছয়। বয়স কোনও বাধা নয়। কাঁদতে কাঁদতে দম বেরিয়ে যাবে, তবু রেহাই নেই। সকাল থেকে রাত— শুধু অনুশীলন। ছুটি বলতে যখন সুইমিং পুল বা ফ্লোর পরিষ্কার হয়, ওই সময়টাই।

ক’বছর আগে ব্যালেন্স বিম থেকে ঝুলে থাকা একদল শিশুর কান্নার ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল ইউটিউবে। চেন জিবলিন স্পোর্টস স্কুলের সেই ছবি দেখে শিউরে উঠেছিল বিশ্ব। এ রকম স্পোর্টস স্কুল চিনে প্রায় শ’খানেক। এদের সম্পর্কে কোনও খবর চিনের সাংবাদিকের কাছেও পাওয়া অসম্ভব। ওঁরা শুধু জানাবেন, ওখান থেকেই তো পদকজয়ীরা বেরোয়। প্রশংসা করতে হবে প্রশিক্ষকদের। যেখানে এখন ছাত্রী-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার।

অনেকে বলেন, এই স্কুল নামক ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের’ জোরেই ২০০০-এর সিডনিতে জার্মানিকে পিছনে ফেলে তৃতীয় হয় চিন। এবং চার বছর পর আথেন্সে যুক্তরাষ্ট্রের পরেই উঠে আসে দ্বিতীয় স্থানে। কিন্তু বিশ্বজুড়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনের মতোই কি চিনের এই মডেলে এ বার মরচে ধরতে শুরু করল? পদক জেতার কারখানার বদলে খেলাধুলার মধ্যে আনন্দ খুঁজে নেওয়ার মুক্তমনা মডেলই কি এখন পদক জয়ের রাস্তা?

রিও সম্ভবত সেই ইঙ্গিতই দিয়ে গেল। না হলে কী করে অলিম্পিক্সে চিনকে সরিয়ে দু’নম্বর জায়গাটা প্রথম বার দখল নেয় গ্রেট ব্রিটেন? আমেরিকার পর তো তাদেরই দাদাগিরি!

ব্রিটেনের চেয়ে মোট পদক বেশি থাকলেও সোনা কম পাওয়ায় জনসংখ্যায় বিশ্বের এক নম্বর দেশকে নেমে যেতে হয়েছে তিন নম্বরে। পদক তালিকায় আরও বড় যেটা চমক তা হল, ডোপের জন্য বহু অ্যাথলিটকে আটকে দিলেও চার নম্বর জায়গাটা কিন্তু পেয়েছে রাশিয়াই।

বিশ্বখ্যাত রুশ পোলভল্টার ইয়েলেনা ইসিনবায়েভা এসেছিলেন অলিম্পিক্স দেখতে। মারাকানায় সমাপ্তি অনুষ্ঠানে দেখলাম বিশ্বের অন্যতম সেরা অ্যাথলিট বসে গ্যালারিতে। চোখে জল। তিনি হয়তো ভাবছিলেন, ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে তাঁদের টিমকে নামতে দিলে রাশিয়া আরও বেশি সোনা পেতে পারত।

রিওয় যুক্তরাষ্ট্রের দাপট অবশ্য অন্যান্য বারকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। অলিম্পিক্সের ইতিহাসে এই প্রথম কোনও দেশ একাই ১২১টা পদক জিতল। ৪৬ সোনা ৩৭ রুপো এবং ৩৮ ব্রোঞ্জ। তবে স্কুলে স্কুলে ‘কান্নার জতুগ্রহ’ তৈরি করে নয়। বরং সঠিক পরিকল্পনা, ভাল অ্যাকাডেমি, উন্নত প্রশিক্ষণের জোরে যুক্তরাষ্ট্রের এই সাফল্য, বলছেন তাদের কর্তারা। গ্রেট ব্রিটেনের ক্ষেত্রেও কথাটা প্রযোজ্য। তবে ব্রিটিশ উত্থানের পাশে চিনা-মডেলের এই অধঃপতনও কিন্তু এ বারের অলিম্পিক্স থেকে পাওনা।

রিও অবশ্য মনে থাকবে দুই কিংবদন্তি অলিম্পিয়ানের জন্য। এক দিকে যুক্তরাষ্ট্রের অতিমানবীয় মাইকেল ফেল্পস। যিনি অবসর থেকে ফিরেও সমান অপ্রতিরোধ্য ছিলেন। পাঁচটা সোনা ও একটা রুপো জিতে মোট ২৮ পদক পেয়ে শেষ হল তাঁর জয়যাত্রা। অন্য দিকে ট্র্যাকের সম্রাট উসেইন বোল্ট। পরপর তিনটে অলিম্পিক্সে ন’টি সোনা জিতে ঐতিহাসিক ‘ট্রিপল ট্রিপল’ করলেন জামাইকান। যে ক’টা ইভেন্টে নামলেন সোনা জিতে শেষ করলেন। সারা বিশ্বকে বুঝিয়ে দিলেন বোল্টের জন্য বয়স একটা সংখ্যা মাত্র।

দুই কিংবদন্তি অলিম্পিয়ান রিওর সবচেয়ে বড় পাওনা হয়ে থাকলেও টোকিও অবশ্য হারাতে চলেছে তাঁদের। কারণ ফেল্পস ও বোল্ট দু’জনেই অবসরের তালিকায় নাম লিখিয়ে ফেলেছেন। যে তালিকায় রয়েছেন চিনের দু’বারের সোনাজয়ী ব্যাডমিন্টন তারকা লিন ড্যান, ইসিনবায়েভা-সহ অনেকেই।

ভারতের অভিনব বিন্দ্রাকেও আর দেখা যাবে না চার বছর পরে। সম্ভবত লিয়েন্ডার পেজকেও না। তবে আশার আলোও থাকছে। পিভি সিন্ধু সোনা জয়ের আশায় নামবেন টোকিওতে। দীপা কর্মকার-সাক্ষী মালিকরাও। লন্ডন অলিম্পিক্সের তুলনায় পদক টেবলে আরও নীচে নেমে যাওয়া সত্ত্বেও এই তিন মেয়েই তো মুখরক্ষা করল ভারতের।

অনেকটা জঘন্য সংগঠন সত্ত্বেও ব্রাজিলের শুধুমাত্র সেনাবাহিনী দিয়ে অলিম্পিক্স উতরে দেওয়ার মতো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rio Olympics China Britain
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE