প্র্যাকটিসে দীপা। — নিজস্ব চিত্র
যে কোনও বড় মঞ্চে দীপা কর্মকারের ‘ইউএসপি’ কী?
জীবন বাজি রাখা ‘প্রোদুনোভা ভল্ট’?
একেবারেই না। ওটা তো বিপক্ষকে পেড়ে ফেলার মারণাস্ত্র। ইতিহাস গড়া ত্রিপুরা কন্যার সাফল্যের রসায়ন খুঁজতে গেলে পাওয়া যাবে আপাত সাদামাটা, ঘরোয়া দু’টো উপকরণ— ১) ছটফটানি। ২) শেষ পর্যন্ত লড়ে যাওয়া একটা মন।
‘‘দেখুন, আমি কোচের কাছে যা শিখেছি, সেটা ঠিকঠাক করতে পারলেই পদক পাব। সেই বিশ্বাস আমার আছে। এত দূর এসেছি, পদক না নিয়ে ফিরতে চাই না। পাব কি না জানি না। তবে সেরাটা দেব।’’ বেশ কয়েক মাস ধরেই সাংবাদিকের নজরে রয়েছেন তিনি। গত লক্ষ্মীপুজোর দিন যখন রিও অলিম্পিক্সের টিকিট হাতে পেলেন, কিংবা তার আগে-পরে যখনই অলিম্পিক্স পদক নিয়ে কথা হয়েছে দীপার সঙ্গে, ভাঙা রেকর্ডের মতো বেজেছে ওপরের লাইনগুলোই।
রিওয় চূড়ান্ত যুদ্ধে নামার এক দিন আগে সেই দীপাকে দেখে মনে হচ্ছিল, পারলে এখনই নেমে পড়েন টুর্নামেন্টে। বলছিলেন, ‘‘প্র্যাকটিস থেকে উঠতেই ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে, পয়েন্টটা আরও একটু বাড়াতে পারলেই তো পদক!’’ পাশে দাঁড়িয়ে কোচ বিশ্বেশ্বর নন্দীর মন্তব্য, ‘‘আহা, সবারই তো একটা শিডিউল থাকে। সেটা মেনে না এগোলে তো শারীরিক সমস্যায় পড়বে। কিন্তু ওকে কে বোঝাবে! ঘুম ভেঙেই প্র্যাকটিসের জন্য তৈরি।’’
প্রথমে সুকাহারা ভল্ট, তার পর প্রোদুনোভা। ফাইনালে দীপার নতুন স্ট্র্যাটেজি। ১২৫ কোটি দেশবাসীর প্রত্যাশার চাপ এবং দু’টো ভল্টের ওপর এখন দাঁড়িয়ে সব কিছু! এত ফোন আসছে যে, মোবাইল বন্ধ রাখতে হচ্ছে বিশ্বেশ্বরকে। দীপার ফোন তো সেই কবে থেকেই কোচের কাছে জমা রাখা। তবু আজ সকালে বিশ্বেশ্বর যখন কয়েক মিনিটের জন্য ফোনটা খুলেছিলেন, সেই সময়েও দিল্লি থেকে এল সাই-কর্তার শুভেচ্ছাবার্তা।
এর পরেও বলবেন চাপ নেই?
দীপা হেসে বলছেন, ‘‘সত্যিই আমার কোনও চাপ নেই। একটাই জিনিস মাথায় রাখছি, আমার তো হারানোর কিছু নেই। যা করব সেটাই লাভ।’’ আর কোচ বলছেন, ‘‘ও ওই রকমই। আমি কখনও আমার মেয়েকে চাপ নিতে দিই না। আমার মন কিন্তু বলছে, স্ট্র্যাটেজি বদলানোর সুবিধেটা আমরা পাব।’’
এত অ্যাথলিটকে দেখছি এখানে। দেশ-বিদেশের তাবড় ক্রীড়াবিদ, অনেকেরই একাধিক অলিম্পিক্স পদক। অথচ নিজেদের ইভেন্টে নামার আগে তাঁদের চোখমুখ ইস্পাতকঠিন। দেখেই মনে হবে, জীবনযুদ্ধে নামছেন। উসেইন বোল্ট ব্যতিক্রম। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে, বুক চাপড়ে শেষ করেন দৌড়। কিন্তু তাঁর মতো ক’জন হয়? দীপাদের আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিক্সের সময়েই একাধিক প্রতিযোগীকে দেখে মনে হচ্ছিল, টেনশনে প্রায় কাঁপছেন।
আর দীপাকে দেখুন। ভল্টে ছ’নম্বর হয়ে তাঁর মুখচোখের যা প্রতিক্রিয়া, ফ্লোর ইভেন্টে পা পিছলে যাওয়ার পরেও তা-ই। সে দিন প্রোদুনোভা সফল হলেও ল্যান্ডিং ঠিক হয়নি। কিন্তু তাতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে, কে বলল! ইনিই দীপা। মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে কোচের পরামর্শ শোনা বিনম্র, বাধ্য, এক বাঙালি মেয়ে। যিনি অকুতোভয়। এটাই তাঁর সব-সেরা প্লাস পয়েন্ট নয়তো কী!
আজ বিকেলে প্র্যাকটিসে ছুটি দিয়েছিলেন বিশ্বেশ্বর। সেই সময়টায় চলল ইউটিউবে ফাইনালের সাত প্রতিদ্বন্দ্বীকে আরও এক বার খুঁটিয়ে দেখে নেওয়া। তাঁরা কারা?
১) সিমোন বাইলস (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র): বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে দশটি সোনাজয়ী, রিওয় ইতিমধ্যেই দু’টি সোনা, ২) হং উন জং (উত্তর কোরিয়া): বেজিং অলিম্পিক্সের সোনাজয়ী, ৩) জিউলিয়া স্টেইনগ্রুবার (সুইৎজারল্যান্ড): ২০১৫ ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অল রাউন্ড
চ্যাম্পিয়ন, ৪) মারিয়া পাসেকা (রাশিয়া): সম্প্রতি হারিয়েছিলেন বিশ্বজয়ী বাইলসকে, ৫) ওকসানা চুসোভিতিনা (উজবেকিস্তান): বয়স ৪১। অভিজ্ঞতম। এটি সপ্তম অলিম্পিক্স, ৬) শ্যালন ওলসেন (কানাডা): জুনিয়র পর্যায়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা, ৭) ওয়াং ইয়ান (চিন): শেষ হিরোশিমা চ্যাম্পিয়নশিপে জোড়া সোনাজয়ী।
নামগুলো খটোমটো লাগছে? কিন্তু দীপাকে জিজ্ঞাসা করুন। তিনি বলে দেবেন, কার সঙ্গে কোন ইভেন্টে নেমেছেন। কার শক্তি কোনটা, দুর্বলতাই বা কোনটা।
সব জানেন ‘ধন্যি মেয়ে’। পদক জয় পাখির চোখ করলে যা হয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy