রফিকের শরীরী ভাষাই এখন টিম ইস্টবেঙ্গল। ছবি: উৎপল সরকার।
ইস্টবেঙ্গল-৪ (রফিক, খাবরা, ডং, বিকাশ)
পুলিশ এসি-১ (বিদেমি)
ময়দানের জায়ান্ট কিলার কোচ রঘু নন্দীর দলকেই এক গণ্ডা গোল মেরে ইস্টবেঙ্গল জেতা মাত্র বারাসত স্টেডিয়ামে শুরু হয়ে গেল বিজয়োৎসব।
না, পুলিশ এসি-কে হারানোর বিজয়োৎসব নয়। সাতের দশকের সেই ‘হেক্সা’ লিগ জয়ের সোনালি স্বপ্ন ছুঁতে চলার আগাম সেলিব্রেশন।
গ্যালারিতে দাউদাউ আগুন লাগল কাগজের মশালে। উড়তে থাকল দেদার আবির। উঠল ব্যান্ডের ঝনঝনানি। কে তখন আর মনে রাখে, ডংদের আরও চারটে ম্যাচ বাকি। এখনও বাকি মহাডার্বি। দেখেশুনে মনে হচ্ছিল, পিকে-বাহিনীকে ছুঁয়েই ফেলেছে বিশু-ব্রিগেড!
বৃহস্পতিবার দুপুরে মধ্য কলকাতা আর হাওড়ায় পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা হয়েছিল। আর তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বারাসতে কিন্তু পুলিশের ব্যারিকে়ড দুমড়ে-মুচড়ে গেল। আর সেটা যারা করল সেই লাল-হলুদের এর পর কলকাতা লিগ জয়ের অশ্বমেধের ঘোড়াকে কি আর রোখা সম্ভব?
চল্লিশ বছর আগে প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোচিংয়ে প্রথম বার টানা ছয় বার লিগ জেতানোর গৌরব যাঁরা এনে দিয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে, তাঁদের দু’জনের কাছে রাখা হয়েছিল প্রশ্নটা।
• সমরেশ চৌধুরী: এখন লিগের যা অবস্থা আর ইস্টবেঙ্গল যে রকম খেলছে তাতে বলা যায় ৯৫ শতাংশ লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েই গিয়েছে বিশ্বজিতের ছেলেরা।
• সুভাষ ভৌমিক: এর পরে ইস্টবেঙ্গল লিগ না পেলে সেটা অঘটন হবে। আমি তো দেখতে পাচ্ছি আমাদের তৈরি ইতিহাসকে স্পর্শ করছে বর্তমান টিম।
দুই ‘এস-এর সঙ্গে একমত তাঁদের সেই সময়ের প্রতিপক্ষ বাগানের ‘এস’-ও। সুব্রত ভট্টাচার্য বলে দিলেন, ইস্টবেঙ্গল কার্যত লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েই গিয়েছে। এই অবস্থা থেকে লিগ না পেলে বলতে হবে সেটা ওদের চরম ব্যর্থতা।’’
বাংলা ফুটবলের তিন সফলতম প্রাক্তনের ধারণাকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না দু’টো কারণে। এক) পোড়খাওয়া রঘু নন্দীর মগজাস্ত্রকেও যে ভাবে ভোঁতা করে দিলেন লাল-হলুদ ফুটবলাররা তাতে মনে হচ্ছে তাঁদের আর রোখা কঠিন। দুই) বেলো-বিকাশদের আর যে চারটে ম্যাচ খেলতে হবে তার মধ্যে মোহনবাগান ছাড়া বাকি দলগুলো দুর্বল। অন্তত চলতি লিগের নিরিখে।
ডংকে আটকে দিলে ইস্টবেঙ্গলকে কোণঠাসা করা যাবে ধরে নিয়েছিলেন ময়দানের বহু অঘটন ঘটানো কোচ রঘু। কিন্তু ‘ঘুঘু কোচকে’ ফাঁদে ফেলার জন্য বিশ্বজিৎ যে অন্য ফাঁদ পাতবেন তা টের পাননি পুলিশ কোচ। ফলে রফিক, খাবরা, বিকাশ জাইরুদের নিয়ে তৈরি প্ল্যান বি-র সামনে পুলিশ আছাড় খেল। বিশ্বজিতের টিম দেখাল, তারা কেবল ডং নির্ভরশীল নয়।
প্রথমার্ধে এক মিনিটের ব্যবধানে দু’টো গোল। রফিকের চোখধাঁধানো গোলের রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই খাবরার ‘উড়ন্ত হেড’। ডংয়ের শট বারে লেগে ফিরছিল। পাখির মতো উড়ে গিয়ে খাবরা তাতে মাথা ছোঁয়ান। ০-২ পিছিয়ে পড়ার পরেও অবশ্য হাল ছাড়েনি পুলিশ। আক্রমণের ঝড় তুলে একটা কামড়ও বসিয়ে দেন তাদের বিদেশি বিদেমি। কিপার ব্যারেটোর হাত ফস্কে বল বেরিয়ে আসতেই ম্যাচটা হাফটাইমের ঠিক আগে ১-২ হয়ে যায়। পুরো ম্যাচে সেই একবারই মনে হচ্ছিল, মার খেয়ে পাল্টা মারার যে স্ট্র্যাটেজি রঘু নিয়েছেন সেটা না কাজে লেগে যায়।
কিন্তু কোথায় কী! প্রহ্লাদের পরিবর্তে তুলুঙ্গা আর সামাদের জায়গায় অবিনাশ— দু’টো পরিবর্তনের পরেই আবার লাল-হলুদ বিস্ফোরণ শুরু হয়ে যায়। ইস্টবেঙ্গলের নতুন হার্টথ্রব ডংয়ের ছয় ম্যাচে আট গোল হয়ে গেল। কোরিয়ান মিডিওর ভারতীয় ক্লাব ফুটবলে সাফল্য এই মুহূর্তে একশো শতাংশেরও বেশি। ৩-১-কে ৪-১ নিয়ে যান বিকাশ জাইরু।
এর ফাঁকে অবশ্য একটা তাৎপর্যের ঘটনা আছে। বিরতির আগে পুলিশ ব্যবধান কমানোর পরেই ইস্টবেঙ্গলের উদ্দেশ্যে অভব্য ইঙ্গিত করেছিলেন রঘু। লাল-হলুদের তরফে যার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করেন টিম ম্যানেজার হিসেবে বেঞ্চে বসা দেবজিৎ ঘোষ। এই ঘটনাই হয়তো আরও তাতিয়ে দিয়েছিল লাল-হলুদ ব্রিগেডকে। যা ঝড় হয়ে আছড়ে পড়েছিল পরের অর্ধে।
ইস্টবেঙ্গলের সাফল্যের রসায়ন কী? এককথায় টিম গেম। র্যান্টি, অর্ণবের মতো অপরিহার্য ফরোয়ার্ড বা ডিফেন্ডার না খেলা সত্ত্বেও দল দৌড়চ্ছে। নতুন আসা ফুটবলাররা বড় দলের জার্সিতে শুধু মানিয়েই নেননি, নিয়মিত সফলও হচ্ছেন।
লিগ প্রায় হাতের মুঠোয়। তবু রফিকরা ডার্বি জিততে মরিয়া। জানেন, ডার্বি না জিতলে লিগ খেতাবের মূল্য কমে যায়। এ দিনের ম্যাচের সেরা রফিক বললেন, ‘‘লিগ জয়ের রাস্তা অনেকটাই পরিষ্কার এখন। তবে মোহনবাগানকে হারাতে না পারলে কোনও লাভ নেই।’’ ডং আবার তাঁর প্রথম কলকাতা ডার্বি নিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘ওই ম্যাচটায় গোল করার জন্য আমি তৈরি হচ্ছি।’’
তবে কোচ বিশ্বজিৎ কিছুতেই চান না, এখনই তাঁর ফুটবলারদের মধ্যে লিগ জয়ের স্বাদ ঢুকে যাক। তিনি একটু বেশিই সতর্ক। ‘‘টিমের আত্মতুষ্টিটাকেই ভয় পাচ্ছি। সবাইকে সে ভাবেই বোঝাচ্ছি।’’ ময়দানে বহু দিন কোচিং করানো বিশু ভাল মতোই জানেন, পচা শামুকে বহু লিগ জয় প্রত্যাশীর পা কেটেছে!
ইস্টবেঙ্গল: ব্যারেটো, সামাদ (অবিনাশ), দীপক, বেলো, সৌমিক, প্রহ্লাদ (তুলুঙ্গা), খাবরা, মেহতাব (রাহুল), বিকাশ, রফিক, ডং।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy