Advertisement
১৬ জুন ২০২৪

বাবার মগজ, ছেলের গোলে কলকাতা বধ

যেন সিজার মালদিনি আর পাওলো মালদিনির স্মৃতি ফেরাল যুবভারতী! বাবা আর ছেলে একইসঙ্গে খেলেছিলেন এসি মিলানে। বাবার কোচিংয়ে ১৯৯৮ বিশ্বকাপে ইতালি দলের অধিনায়ক ছিলেন পাওলো মালদিনি। ফের এক ইতালিয়ান বাবা-ছেলে জুটি একইসঙ্গে ‘খেললেন’! এফসি পুণে সিটি-র কোচ আর ফুটবলারের ভূমিকায়। বাবা ফ্রাঙ্কো কলোম্বা নির্বাসিত থাকায় বেঞ্চে ছিলেন না। তবে যুবভারতীর কাঁচের বক্সে বসে ছেলে ডেভিড কলোম্বার দুর্দান্ত সেন্টারে ডুডুর গোল দেখার পর না কি চিত্‌কার করে উঠছিলেন ফ্রাঙ্কো। “ইয়েস, মাই সান। গুড পাস। গুড গোল।”

ম্যাচ শেষে ফিকরুকে সান্ত্বনা। শুক্রবার। ছবি: উত্‌পল সরকার

ম্যাচ শেষে ফিকরুকে সান্ত্বনা। শুক্রবার। ছবি: উত্‌পল সরকার

রতন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:৩৬
Share: Save:

এফসি পুণে সিটি-৩ (ডুডু, কোস্তাস, কলোম্বা)

আটলেটিকো দে কলকাতা-১ (ফিকরু-পেনাল্টি)

যেন সিজার মালদিনি আর পাওলো মালদিনির স্মৃতি ফেরাল যুবভারতী!

বাবা আর ছেলে একইসঙ্গে খেলেছিলেন এসি মিলানে। বাবার কোচিংয়ে ১৯৯৮ বিশ্বকাপে ইতালি দলের অধিনায়ক ছিলেন পাওলো মালদিনি।

ফের এক ইতালিয়ান বাবা-ছেলে জুটি একইসঙ্গে ‘খেললেন’! এফসি পুণে সিটি-র কোচ আর ফুটবলারের ভূমিকায়।

বাবা ফ্রাঙ্কো কলোম্বা নির্বাসিত থাকায় বেঞ্চে ছিলেন না। তবে যুবভারতীর কাঁচের বক্সে বসে ছেলে ডেভিড কলোম্বার দুর্দান্ত সেন্টারে ডুডুর গোল দেখার পর না কি চিত্‌কার করে উঠছিলেন ফ্রাঙ্কো। “ইয়েস, মাই সান। গুড পাস। গুড গোল।”

পরে নিজেই ফ্রি কিকে গোল করার পর ছেলে তো স্বয়ং চলে এলেন গ্যালারির কাছে কোচ কাম বাবাকে অভিবাদন জানাতে।

ডেভিড উচ্ছ্বসিত বাবাকে পেলেন, কিন্তু ডুডু ওমাগবেমি তো কাউকেই পেলেন না। গোল করার পর গ্যালারির দিকে ছুটে এসেছিলেন তিনিও। খুঁজছিলেন তাঁর সমর্থকদের। দু’মাস আগে প্রায় ওই জায়গা থেকেই গোল করে ছুটে এসে দেখেছিলেন ফেন্সিংয়ের সামনে। তাঁকে ছোঁয়ার জন্য তখন সেখানে হাজির উল্লসিত অসংখ্য লাল-হলুদ সমর্থক। শুক্র-সন্ধের যুবভারতীতে ডুডুর গোলের পর উল্লাসের জায়গায় বরং অমাবস্যা! আইএসএলে কলকাতা ডুডুর গোলে পিছিয়ে পড়ার পর তাঁর আসল দল ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা বরং আফশোস করছেন, ইস, সেই ডুডুটা...! আর ম্যাচ শেষের পর নাইজিরিয়ান স্ট্রাইকারের গলায় তাই আফশোস, “এমন পরিবর্তনও হয়।”

কোনও এক অত্যুত্‌সাহী ডিজে প্রতি দশ মিনিট অন্তর চিত্‌কার করে যাচ্ছিলেন, “জিতবে কে? এটিকে, এটিকে।” কিন্তু তাতে একবারও শোনা গেল না সেই শব্দব্রহ্ম। যা ঘরের মাঠের এতদিন সব ম্যাচে সঙ্গী ছিল ফিকরুদের। সাড়া দেবেনই বা কে? আইএসএলের একমাত্র ব্রাজিল বিশ্বকাপ খেলা ফুটবলার কোস্তাসের বক্সের বাইরে থেকে করা অসাধারণ গোলের পরেও শোনা গেল সেই ‘জিতবে কে...!’ যা শুনে টুর্নামেন্টে প্রথম হারের কষ্টের মধ্যেও হেসে গড়িয়ে পড়লেন গ্যালারির হাজার বাইশেক আটলেটিকো কলকাতার সমর্থক। পুণের তিন নম্বর গোলটার পর অবশ্য রণে ভঙ্গ দিলেন ওই ডিজে।

এটিকে এ দিন যা খেলল তাতে কখনও মনে হয়নি, ‘জিতবে কে এটিকে’ স্লোগানের সঙ্গী হওয়া যায়। সাত নম্বর ম্যাচে এসে প্রথম হারের স্বাদ পেল আন্তোনিও হাবাসের দল— ম্যারাথন লিগে যা হতেই পারে। এবং অঘটন বলেই যা এখনও ধরা উচিত। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে অন্য জায়গায়। যে টিমটা প্রায় সেমিফাইনালের দোড়গোড়ায়, লিগ টেবলে সবার শীর্ষে, তাদের কেন এমন হ য ব র ল ফুটবল? ফ্র্যাঞ্চাইজি টিমের কেন এত অপেশাদার মানসিকতা।

ডুডু যখন গোলটা করলেন, সেই মুহূর্তে আটলেটিকো দশ জনে খেলছে! স্টপার হোসেমি মাঠের বাইরে। তাঁর দাঁত ও ঠোট দিয়ে রক্ত পড়ছিল। তা বলে পাঁচ মিনিট শুশ্রূষার জন্য মাঠের বাইরে! মিডিও নাতোকে ওই সময় নিচে নেমে এসে ডিফেন্সে অর্ণবের সঙ্গে জুটি বাঁধতে বলেছিলেন হাবাস। সেই নাতোর মাথার উপর দিয়েই গোল করে গেলেন ডুডু। নিরুপদ্রবে। কেউ তাঁকে বাধা দিল না লাফিয়ে উঠে।

পুণে সিটির মহাতারকা ত্রেজেগুয়ে না আসায় গত দু’দিন মহানন্দে ভাসছিল কলকাতা শিবির। বাস্তবে দেখা গেল, সেটা শাপে বর হয়েছে ডুডু-প্রীতমদের। ত্রেজেগুয়ের জায়গায় নেদারল্যান্ডসের জন গুসেনস নেমে ডুডু নামক স্ফূলিঙ্গকে যেন আরও বারুদ সরবরাহ করলেন। নিখুঁত অঙ্ক কষে কলকাতাকে আকাশ থেকে মাটিতে আছড়ে ফেলল পুণে। এবং সেটা মাছের তেলে মাছ ভাজার মতোই হাবাসের রাস্তাতেই!

চার ডিফেন্ডারের সামনে দু’জন ডিফেন্সিভ স্ক্রিন। এ তো কলকাতা কোচেরই স্ট্র্যাটেজি ছিল এতদিন। বিশ্বকাপার কোস্তাস আর ভারতের এক নম্বর মিডিও লেনি রডরিগেস। এক জন বিপক্ষের মাঝমাঠ ঘেঁটে দিলেন। অন্য জন সেই সুযোগে নিজের দলে ফুল ফোটালেন। ব্রাজিল বিশ্বকাপে গ্রিস টিমে নিয়মিত স্টপার খেলতেন কোস্তাস। তাঁকে আইএসএলে মাঝমাঠে খেলাচ্ছে পুণে। তাদের প্রাক্তন পারমা কোচের সিদ্ধান্ত যে কতটা নির্ভুল বোঝা গেল, কোস্তাসের ফুলঝুরির মত নিখুঁত পাস বাড়ানো দেখে। বয়স ছত্রিশ হলে কি হবে টাটকা বিশ্বকাপার তো! কোস্তাসের দৌরাত্ম্য আর নির্বাসনে থাকা কোচ ফ্রাঙ্কোর আগাম প্রেসক্রিপশনেই সাফল্য পেল পুণে।

বিপক্ষের চক্রব্যূহে পড়ে কলকাতার সেরা ফরোয়ার্ড ফিকরুরও কী হাল! শুরুতে একটা ভাল শটের পরে ইথিওপিয়ান তারকা উধাও হয়ে গেলেন! মার্কি ফুটবলার লুই গার্সিয়ারও কী হাল! যাঁর উপর মাঝমাঠ সংগঠনের দায়িত্ব ছিল, শেষ পর্যন্ত টিমের সেই মার্কি ফুটবলারকেও তুলে নিতে বাধ্য হলেন কলকাতার কোচ। তাতে এত রাগ হল স্প্যানিশ বিশ্বকাপারের যে, ড্রেসিংরুমে ফিরে সবার আগে নিজের কিট নিয়ে সটান উঠে বসলেন টিম বাসে। গোমড়া মুখ। কোথাকার কে এক গোয়ান ছেলে লেনি রডরিগেস তাঁকে বোতলবন্দি করে ফেলবেন হয়তো ভাবেননি এক বারও। সে জন্য বোঝা গেল রাগটা কার উপর? তাঁকে বসিয়ে দেওয়া নিজের দলের কোচ, না বিপক্ষের পাহারাদের লেনি।

কেন এমন হাল কলকাতার? চৌম্বকে তিনটি কারণ উঠে আসছে। এক) লিগ টেবিলে নীচের দিকে থাকা এফ সি পুণে সিটিকে নিয়ে আত্মতুষ্টি। দুই) পরপর হোম-অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলার ক্লান্তির চাপ নিতে না পারা। তিন) বিপক্ষের স্ট্র্যাটেজি সম্পর্কে টিম ম্যানেজমেন্টের অজ্ঞতা।

‘চতুষ্কোণ’ সিনেমার কুশীলবরা এসেছিলেন এ দিন আটলেটিকো দে কলকাতার অন্যতম মালিক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের টিমকে সমর্থন করতে। ত্রিকোণ বা চতুষ্কোণ দূরে থাক, টানা চারটে সঠিক পাসও যে গোটা ম্যাচে এক বারও খেলতে পারলেন না লুই গার্সিয়া-বলজিত্‌রা। উইং প্লে নেই, ডাউন দ্য মিডল দৌড় নেই, সেট পিসে চুড়ান্ত ব্যর্থতা। তিনটে গোল খেলেও একমাত্র কিপার শুভাশিস রায় চৌধুরী ছাড়া কাউকে ভাল নম্বর তাই দেওয়া যাচ্ছে না। দু’টো নিশ্চিত গোল বাঁচালেন তিনি। বোরহা জঘন্য, আগের একটি ম্যাচের জোড়া গোলের নায়ক লোবো ফ্যাকাশে, অর্ণব থেকেও নেই, নাতো আর পরে নামা পদানি বিশ্রী পারফরম্যান্সে বিচারে মুদ্রার এ পিঠ-ও পিঠ। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। টুর্নামেন্টের অর্ধেক ম্যাচ শেষে অঙ্কের বিচারে শীর্ষে থাকলেও কলকাতার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে চেন্নাইয়ান।

ম্যাচ শেষে ডুডু-কোস্তাস-কলোম্বারা যখন সেরার পুরস্কার নিচ্ছেন তখন স্টেডিয়াম ফাঁকা। শুনশান। মিনিট দশেকের মধ্যেই যেন শশ্মান। আটচল্লিশ ঘণ্টা আগেই যাদবপুরের রাস্তায় প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া নিয়ে তীব্র বিতর্কের ঢেউ উঠেছে সর্বত্র। বরাবর যে শহরের মানুষ সাহসী বিজয়ীকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তারা হঠাত্‌ কেন উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করল তা নিয়েও শুরু হতে পারে তীব্র বিতর্ক। চুমুর ব্যাপারে সাবালক হওয়ার চেষ্টা করলেও, সাফল্যকে সাবাস জানানোর ব্যাপারে কেন এখনও মন্ধতার আমলে পড়ে থাকবে শহর? কেন নিজের টিমের জয়-হার নিয়েই মেতে থাকবে? টিম বাসে ওঠার সময় পুণে কোচ ফ্রাঙ্কো কলোম্বা সেজন্যই হয়তো বলে গেলেন, “আসার আগে শুনেছিলাম কলকাতা স্পোর্টিং সিটি। এখানে এসে বুঝলাম, ভুল শুনেছিলাম।”

আটলেটিকো দে কলকাতা: শুভাশিস, কিংশুক, অর্ণব, মিগুয়েল, বিশ্বজিত্‌, বলজিত্‌ (লেস্টার), লোবো, নাতো (রফি), গার্সিয়া (পদানি), বোরহা, ফিকরু।

‘বিশ্বকাপে তো জার্মানিও সব ম্যাচ জেতেনি’

নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা

পুণে সিটির বিরুদ্ধে দলের হতশ্রী পারফরম্যান্সে হতাশ। তবে টুর্নামেন্টে টিমের প্রথম হারে পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ল, মানতে নারাজ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। আইএসএলে কলকাতার চ্যালেঞ্জারদের অন্যতম মালিক বরং বলছেন, “আজকের ম্যাচে সব বিভাগেই ফ্লপ করেছে আমাদের টিম। তবে হার-জিত ম্যাচেরই অঙ্গ। বিশ্বকাপে জার্মানিও কিন্তু সব ম্যাচ জেতেনি।” এ দিন খেলা শুরুর দু’মিনিটের মাথায় মাঠে আসেন সৌরভ। এসেই আটলেটিকোর লাল-সাদা জার্সি গায়ে দিয়ে বসে পড়েন ম্যাচ দেখতে। বিরতিতে এক গোলে পিছিয়ে থাকা আটলেটিকো কলকাতা দ্বিতীয়ার্ধে দ্বিতীয় গোল খাওয়ার পর টিভি ক্যামেরায় গম্ভীর মুখ ধরা পড়ে সৌরভের। এর পর ফিকরু পেনাল্টি থেকে ব্যবধান কমালে নিজের আসন ছেড়ে উপরের সারিতে এসে বসতে দেখা যায় সৌরভকে।

ময়দানি তুকতাক? সৌরভ অবশ্য তা মানছেন না। বরং ত্রেজেগুয়েহীন বিপক্ষের কাছেও ১-৩ হেরে স্টেডিয়াম ছাড়ার সময় বলে যান, “আমরা ভাল খেলতে পারিনি। দেখতে হবে কোথায় তাল কাটল আমাদের।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE