কাতারে পা রেখেই উৎসবে মেতে উঠেছেন ব্রাজিল সমর্থকেরা। ছবি রয়টার্স।
বিশ্বকাপ শুধুমাত্র ফুটবলেই আবদ্ধ থাকে না। এ এক উৎসব। ১৯৭৮ সালে ইরানের বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পেয়েছিলাম। কোচ বলেছিলেন এই দেশে এক লক্ষ ফুটবলারের মধ্যে একজন এমন অমূল্য সুযোগ পায়। বিশ্বের সব চেয়ে বড় প্রতিযোগিতার অন্যতম ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন ছোটবেলা থেকেই দেখেছি। কিন্তু সেই স্বপ্ন যে এত দ্রুত বাস্তবায়িত করতে পারব, আশা করিনি।
আর্জেন্টিনায় পা না রাখলে জানতামও না, ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা কোন পর্যায়ে যেতে পারে। সে দেশের প্রত্যেকের মধ্যে এই আবেগ লুকিয়ে আছে। আমরা যে বাসে যাত্রা করতাম, তার চালক একদিন আমাদের অনুশীলন দেখছিলেন। মহড়ার মধ্যে ওর পায়ের কাছে বল চলে গিয়েছিল। যে ভঙ্গিতে বল পায়ে নিয়ে জাগলিং শুরু করলেন সেই চালক, তা সাধারণ কারও পক্ষে কখনও সম্ভব নয়। তখনই অনুভভ করেছিলাম, আর্জেন্টিনায় ফুটবল নিছক একটা খেলা নয়। এ হল এক চিরন্তন অভ্যাস, যা দেশের প্রত্যেক মানুষের রক্তে মিশে গিয়েছে।
’৭৮ বিশ্বকাপ ফাইনালে নেদারল্যান্ডসকে ৩-১ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আর্জেন্টিনাই। মারিয়ো কেম্পেস জোড়া গোল করেছিলেন। তার পরে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে আবির্ভাব ঘটে এক বিস্ময় তরুণের। বাঁ-পায়ের জাদুতে একাই বিশ্বকাপ জিতিয়ে দেশে ফিরেছিলেন দিয়েগো মারাদোনা। কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন কেম্পেসের দেশে। সেই আর্জেন্টিনা থেকেই উঠে এল আরও এক বাঁ-পায়ের জাদুকর। লিয়োনেল মেসি। ওর খেলা দেখে মনে হয় না জোর করে কিছু করছে। ডান-প্রান্ত থেকে কাট করে ভিতরে ঢোকা থেকে মাঝমাঠ থেকে সতীর্থের জন্য গোলের ঠিকানা লেখা পাস, সবই ওর নখদর্পণে। ২০১৪ সালে মেসির খেলা দেখে মনে হয়েছিল বিশ্বকাপ এ বার আর্জেন্টিনাতেই যাচ্ছে। কিন্তু কে ভেবেছিল গন্সালো হিগুয়াইন গোলের সামনে থেকে বল বাইরে মারবে? জার্মানির মারিয়ো গোৎজ়ে সেই ভুল করেনি। একটাই সুযোগ পেয়ে জালে বল জড়িয়ে দেয়। মেসির সেই অশ্রু ভরা চোখ যে কোনও ফুটবলপ্রেমীকে কাঁদিয়ে দিতে পারে। ওর সামনে এ বার শেষ সুযোগ।
দল হিসেবে আর্জেন্টিনা সব চেয়ে শক্তিশালী। রক্ষণ ভাগ নিয়েই এত দিন মূল চিন্তা ছিল আর্জেন্টিনার। লিসান্দ্রো মার্তিনেস, ক্রিশ্চিয়ান রোমেরা, নিকোলাস ওতামেন্দির মতো ফুটবলার থাকায় সেই চিন্তা অনেকটাই কেটে গিয়েছে। মাঝ মাঠে রদ্রিগো দে পল ও লিয়ান্দ্রো পারেদেসের খেলার উপরে অনেকটা নির্ভর করছে দলের আক্রমণ ভাগের নড়াচড়া। আর্জেন্টিনা এখন আর আগের মতো বল পায়ে রাখে না। পজেশন ফুটবলের চেয়েও বেশি প্রতিআক্রমণাত্মক ফুটবল খেলে। রদ্রিগোর গতি ও লম্বা পাসের উপরেই নির্ভর করে ওদের প্রতিআক্রমণ। মেসি অ্যাটাকিং মিডিয়োর কাজটি করে। ও হচ্ছে স্ট্রাইকিং লাইন ও মাঝ মাঠের সেতু। বিপক্ষের রক্ষণের ফুটবলারদের বিভ্রান্ত করার কাজ ফুটবল সম্রাটের।
মেসি ও অ্যাঙ্খেল দি মারিয়া জুটির পাসিং ফুটবল যে কোনও দলের রক্ষণ ভাগকে কাবু করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। লাওতারো মার্তিনেস অথবা ইউলিয়ান আলভারেজ়ের উপরে গোল করার দায়িত্ব। অবশ্যই মেসি ও দি মারিয়াও সেই দায়িত্ব নেবে। কিন্তু দলের স্ট্রাইকিং লাইনকে নিশ্চিত করতে হবে, তারা যেন হিগুয়াইনের মতো সহজ সুযোগ নষ্ট না করে। আর্জেন্টিনার গ্রুপে রয়েছে সৌদি আরব, মেক্সিকো, পোলান্ডের মতো দল। সৌদি আরব বিশ্বকাপে খুব একটা কিছু করতে না পারলেও এশিয়ার দল হিসেবে শক্তিশালী। মেক্সিকো বরাবরই কঠিন প্রতিপক্ষ। পোলান্ড নির্ভরশীল রবার্ট লেয়নডস্কির উপরে। আর্জেন্টিনা দল ভাল হলেও গ্রুপ পর্বে তাদের পরীক্ষা খুব একটা সহজ নয়।
কলকাতায় যত দিন ছিলাম, দেখেছি এই শহরে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সমর্থকই বেশি। ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান যেমন দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে যায়, তেমনই বিশ্বকাপ এলে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মধ্যে রেষারেষি দেখা যেত। পাড়ায় পাড়ায় পতাকা টাঙিয়ে রাখা হত। বহু পাড়ায় বিশ্বকাপ ফুটবলের আগে ভাল অনুষ্ঠান হত। অনেক বার অতিথি হয়ে গিয়েছি। উপভোগও করেছি। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে কলকাতায় যাওয়ার পরে শুনলাম এখন জার্মানি, স্পেন, এমনকি ইংল্যান্ডের সমর্থকও তৈরি হয়েছে।
ব্রাজিলও এ বারের অন্যতম দাবিদার। নেমার দা সিলভা স্যান্টোস জুনিয়রের উপরে খুব একটা নির্ভরশীল নয় তারা। ভিনিসিয়াস জুনিয়র, রাফিনহা অথবা অ্যান্টনির মতো উইঙ্গার দলে থাকলে আর চিন্তা কীসের? স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতে পারে রিচার্লিসন। নেমার সে ক্ষেত্রে অ্যাটাকিং মিডিয়ো হিসেবে খেলবে। ব্রাজিলের স্ট্রাইকিং লাইনের গতির সঙ্গে আর কোনও দল মানিয়ে নিতে পারবে কি না জানা নেই। মাঝ মাঠে খেলবে ফ্রেড, কাসেমিরো ও লুকাস পাকেতা। শুধুমাত্র দু’টি সাইড-ব্যাক নিয়ে ব্রাজিলকে ভাবতে হতে পারে। দানি আলভেসের ৩৯ বছর বয়স। ওর উপরে কি ব্রাজিল এখনও নির্ভর করবে?
মেসির মতোই ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোরও এটা শেষ বিশ্বকাপ। কিন্তু পর্তুগালকে নিয়ে আমার আর কোনও আশা নেই। রোনাল্ডো বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে। খুব একটা ছন্দেও নেই। ব্রুনো ফের্নান্দেজ ও বের্নার্দো সিলভার উপরে নির্ভর করছে দলের খেলা। ওরা যে দিন ব্যর্থ হবে, পর্তুগালের সূর্যও ডুবে যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy