Advertisement
২১ মে ২০২৪
বিদায় ফ্লাইং ডাচম্যান, বিদায় রাজপুত্র

যেন ফুটবলের পিথাগোরাস

মাইকেলেঞ্জেলোর মতো শিল্পী! নাকি ফুটবলের পিথাগোরাস! ফুটবল মাঠের পুরো জ্যামিতিটাই যেন থাকত জোহান ক্রুয়েফের মাথায়! এই পৃথিবীতে এসেছিলেন সুন্দর খেলাটাকে আরও সুন্দর করে তুলতে।

চুনী গোস্বামী
শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৬ ০৪:০৩
Share: Save:

জোহান ক্রুয়েফ

জন্ম: ২৫ এপ্রিল ১৯৪৭
মৃত্যু: ২৪ মার্চ ২০১৬

মাইকেলেঞ্জেলোর মতো শিল্পী! নাকি ফুটবলের পিথাগোরাস!

ফুটবল মাঠের পুরো জ্যামিতিটাই যেন থাকত জোহান ক্রুয়েফের মাথায়! এই পৃথিবীতে এসেছিলেন সুন্দর খেলাটাকে আরও সুন্দর করে তুলতে।

না হলে বার্সেলোনার জার্সি গায়ে ‘ফ্যানটম গোল’ বা চুয়াত্তরের বিশ্বকাপে ‘ক্রুয়েফ টার্ন’-এর মতো ফুটবলের মহাজাগতিক সব ব্যাপার-স্যাপারের পেটেন্ট জোহান ক্রুয়েফ কী ভাবে নিজের পকেটে নিয়ে ঘুরতেন তা আজও আমার কাছে বিস্ময়।

শুধু আমার কাছেই কেন? ফুটবল বিশ্বের একটু-আধটু খবর রাখার সুবাদে জানি, ফুটবল নিয়ে ব্রাজিলিয়ানদের আত্মবিশ্বাস এবং অহঙ্কার প্রবল। পেলের দেশের মানুষ মনে করে ফুটবলটা তারা যখন খেলে তখন এই গ্রহে তারাই সেরা। কার্লোস আলবার্তো পেলেদের সেই সত্তরের বিশ্বকাপ জয়ী টিমের ক্যাপ্টেন।

তিনি ক্রুয়েফ সম্পর্কে কী বলছেন তা এক বার শুনে নিন—‘‘আমরা যে ফুটবলটা খেলতাম তার সঙ্গে এখনকার ফুটবলের তফাৎ উনিশ-বিশ। কেবল আলাদা চুয়াত্তরে ক্রুয়েফদের নেদারল্যান্ডস টিমটা। কী অদ্ভুত সৌন্দর্য্য! ফুটবলের টেনশন কোথায় সেখানে? যেন মাঠের মধ্যে মেরি গো রাউন্ড চলছে। আর তার চালক ক্রুয়েফ।’’ আলবার্তোতেই শেষ নয়। শুনেছি, ব্রাজিলের সর্বকালের অন্যতম সেরা কোচ তেলে সান্তানারও নাকি খেদ ছিল ক্রুয়েফের মতো ফুটবলারকে এক বারও কোচিং করাতে না পারা।

এই দুই প্রবাদপ্রতিম ফুটবল ব্যক্তিত্বের সার্টিফিকেটই জানান দেয় জোহান ক্রুয়েফ কে এবং তিনি কী ছিলেন। সামনে থেকে কোনও দিন দেখিনি। কথাবার্তাও হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। দুভার্গ্য, চুয়াত্তরের বিশ্বকাপে ও যখন মধ্যগগনে তখনও কলকাতায় টিভি আসেনি। কিন্তু পরবর্তীকালে টিভিতে, ইন্টারনেটে ওর খেলা দু’চোখ ভরে দেখেছি। মন জুড়িয়ে গিয়েছে সেই খেলা দেখে। ওর ড্রিবল, বল কন্ট্রোল, ঈশ্বরপ্রদত্ত স্কিল দেখলে মনে হয় সবুজ মাঠে কেউ যেন তুলি দিয়ে মাইকেলেঞ্জেলোর মতো ছবি আঁকছে। কখনও কখনও মনে হয়, না না, এতো দেখছি ফুটবল খেলাটাকে পিথাগোরাসের মতোই নিখুঁত ভাবে মগজে জ্যামিতির মতো কষে রেখেছে। না হলে স্কোরার কাম স্কিমার কাম গেম মেকার বিশ্ব ফুটবলে অনেকেই এসেছেন। কিন্তু ক্রুয়েফ কোথাও যেন ওদের থেকে আলাদা। ওঁর স্কিল দেখে মনে প্রশ্ন জাগে নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব মাঠে কাজ করেছে কি?

আজ মেসিকে যা করতে দেখি বার্সেলোনার জার্সি গায়ে ক্রুয়েফ ওর ফুটবলার জীবনে ঠিক সেটাই আরও নিখুঁত ভাবে করে দেখিয়েছেন আগেই। ওঁর ১৮০ ডিগ্রি টার্নিং কিংবা অস্বাভাবিক সব ড্রিবলিং, নিমেষে ম্যাজিকের মতো ফাঁকা জায়গা তৈরি করা— দেখলে মনে হয়, ইনিও ভিনগ্রহ থেকেই আগত। যাঁর দর্শন, নব্বই মিনিটে তোমার পায়ে বল থাকবে সাকুল্যে তিন মিনিট। বাকি সাতাশি মিনিটে তুমি কী করছ, সেটাই বড় ব্যাপার। এই বাকি সাতাশি মিনিটে এক জন ফুটবলারকে কী করতে হবে তা ক্রুয়েফ ফুটবলবিশ্বকে দেখিয়ে গিয়েছেন একজন ‘ভিশনারি’-র মতো। দেখিনি অপ্রয়োজনীয় বা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ড্রিবল করতে। সেই অর্থে ক্রুয়েফ নিজেই ওঁর ফুটবল ঘরানার একটা সংজ্ঞা।

কোথায়, কতটা দৌড়তে হবে, পা কত ডিগ্রি ঘুরবে ড্রিবলের সময়, লেফট উইং বা রাইট উইংয়ে কোনাকুনি দৌড়ের সময় কী ভাবে ডিফেন্ডারদের চোখে সর্ষে ফুল দেখিয়ে দিতে হয় তা ক্রুয়েফ ওর ফুটবলার জীবনে যেন রিমোট কন্ট্রোলে নিয়ন্ত্রণ করতেন। না হলে কাউকে বলতে শুনেছেন, ‘‘টেকনিক মানে হাজার বার বল জাগলিং নয়। তা হলে তো সার্কাসেই কাজ করা যায়। টেকনিক মানে বলটাকে একটা টাচে সঠিক গতিতে নিখুঁত নিশানায় সতীর্থের কাছে পাঠানো।’’

শুধু ফুটবলার হিসেবেই নয়। খেলা ছাড়ার পর কোচ ক্রুয়েফের ঈষর্ণীয় সাফল্য চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এই যে আজ মেসি, জাভিদের তুলে বার্সেলোনার অ্যাকাডেমি ‘লা মাসিয়া’র রমরমা দুনিয়া জুড়ে, তা কিন্তু এই জোহান ক্রুয়েফেরই মানস-সন্তান। এ ব্যাপারে ক্রুয়েফের সঙ্গে একমাত্র তুলনা চলতে পারে বেকেনবাওয়ারের। যাঁরা ফুটবলার ও কোচ দু’ভাবেই সাফল্য পেয়েছেন।

আমার কাছে বিশ্বের সর্বকালের সেরা পাঁচ ফুটবলার হলেন— দি’ স্তেফানো, পেলে, ক্রুয়েফ, মারাদোনা, মেসি। যাঁদের মধ্যে তুলনা অর্থহীন। দি’স্তেফানো যদি হন রিয়ালের চিরকালীন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডর, ক্রুয়েফ তা হলে বার্সেলোনার সর্বকালের সেরা মুখ।

গত মাসেই খবরের কাগজে ওঁর কথা পড়েছিলাম। যেখানে ক্রুয়েফ বলেছিলেন, ক্যানসারের বিরুদ্ধে ম্যাচটা ২-০ এগিয়ে আছি। শেষটায় আমিই জিতব। ভাবুন মৃত্যুপথযাত্রী এক জন মানুষের মনের জোরটা!

এত যশ, ক্যারিশমা সত্ত্বেও ক্রুয়েফ কিন্তু আমার কাছে সারাজীবন চিহ্নিত হয়ে থাকবেন ফুটবল ইতিহাসের এক জন পরাজিত বীর হিসেবে। ঠিক যেমন রামায়ণের ইন্দ্রজিৎ, মহাভারতের কর্ণ। চুয়াত্তরে ওই দুর্ধর্ষ টিম নিয়েও ফাইনালে জার্মানির কাছে হার। তাও প্রথম মিনিটে গোল করে এগিয়ে গিয়েও। আর আটাত্তরে ফিট নেই বলে আর্জেন্তিনায় খেলতেই গেলেন না। গেলে হয়তো চ্যাম্পিয়ন হয়েই ফিরতেন।

জোহান ক্রুয়েফকে ফিরে দেখলে মনে পড়ে কর্ণ-কুন্তী সংবাদের সেই বিখ্যাত লাইনটা— জয়ী হোক, রাজা হোক পাণ্ডব সন্তান। আমি রব...।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

johan cruyff football legend football
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE