পর্তুগালের ম্যাচগুলো দেখে আমি খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। প্রতিদিনই ভাবতাম আজ নিশ্চয়ই ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর দাপুটে একটা পারফরম্যান্স দেখব। রোনাল্ডোর মতো প্রতিভা যখন মাঠে নামে তখন এই আশাটা আমার মতো লক্ষ লক্ষ ফুটবলপ্রেমীরাও করে। কিন্তু প্রত্যাশার চাপে হোক বা লম্বা ক্লাব মরসুমের ধকলে, রোনাল্ডো-ম্যাজিকটাই চোখে পড়ছিল না। কিন্তু কথা আছে না, ফর্মটা সাময়িক হলেও ক্লাস চিরকালের। বুধবার রাতে সেটারই প্রমাণ পেলাম।
রোনাল্ডো বলতে তো আমি একেই চিনি। অতিমানবীয় হেড। চোখ ধাঁধানো কিছু ড্রিবল। অবিশ্বাস্য গতিতে দৌড়। পেরিফেরাল ভিশনে পাস। নির্যাসে, দুরন্ত একটা পারফরম্যান্স। দিনের শেষে যা দলকে জয় এনে দেবে। ওয়েলসের বিরুদ্ধে পর্তুগালের ২-০ জয়ে বিশ্বফুটবলের সেই কমপ্লিট ফুটবলারের খেলাই দেখতে পেলাম।
ম্যাচের শুরুর থেকেই রোনাল্ডোর মধ্যে একটা বাড়তি তাগিদ ছিল। দলের চাপটা পুরো নিজের ঘাড়েই নিয়েছিল। মুভমেন্টের মধ্যে তীক্ষ্ণতা ছিল। বলটাকে তাড়া করছিল। কখনও একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেনি। ওর বডি ল্যাঙ্গোয়েজেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল, অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী মেজাজে নেমেছে খেলতে।
প্রথম কয়েক ম্যাচে রোনাল্ডো মুভমেন্ট খুব কম করছিল। একটা জায়গায় বেশি দাঁড়িয়ে থাকছিল। তাই বলে টাচ বেশি হচ্ছিল না। ওয়েলসের বিরুদ্ধে বারবার পজিশন পাল্টায়। কোনও সময় উইংয়ে। কখনও হাফে। কোনও সময় আবার ইনসাইড স্ট্রাইকার। যার ফলে ওকে মার্ক করা যায়নি। রোনাল্ডো জানত, ওকে আটকানোর জন্য সব সময় মার্কার থাকবেই। প্রথমার্ধেই তো জেমস কলিন্স সেই ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করে রোনাল্ডোকে। কিন্তু হাফটাইমের পর এত বেশি পজিশন বদলাতে থাকে যে ওর সঙ্গে গতিতে পেরে ওঠেনি ওয়েলস।
আগেও বলেছি রোনাল্ডোকে বাকিদের থেকে আলাদা করে দেয় ওর অবিশ্বাস্য হেডিং দক্ষতা। বালাক, ক্লোজে, বহু হেড-মাস্টারের খেলা দেখেছি। কিন্তু রোনাল্ডোর জাম্পটাই অন্য মাত্রার। এত বেশি উঁচুতে উঠে সঠিক পজিশনে হেড থেকে বলটা জালে পাঠানো মোটেও সহজ নয়। এর জন্য কোমরের জোর লাগে। সঠিক টাইমিংয়ে লাফাতে হয়। গতি আর পাওয়ারের কম্বিনেশনে গোলকিপারকে হারাতে হয়। রোনাল্ডোর হেডে সব আছে। অ্যাথলিটদের মতো ওর শারীরিক গঠন। ফিটনেসটাও দুর্দান্ত। তাই এ সমস্ত পজিশন থেকে হেড দিতে পারে।
সাপোর্টিং প্লে-তেও রোনাল্ডোকে দশে দশ। ওর বিরুদ্ধে বরাবরের অভিযোগ, রোনাল্ডো নাকি স্বার্থপর। এটা ঠিক যে, মেসির স্টাইল টিমগেমকে বেশি মানায়। রোনাল্ডো আবার একাই সব করতে চায়। কিন্তু ওয়েলসের বিরুদ্ধে সেই রোনাল্ডোই ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের কথা না ভেবে টিমম্যানের মতোই খেলল। সাপোর্টিং প্লে-তে দলকে সাহায্য করছিল। রেনাতো স্যাঞ্চেজ, নানির মতো ফুটবলারের সঙ্গে ওয়াল পাস খেলছিল। উইংয়ে খেলা ছড়াচ্ছিল। নীচে নেমে রক্ষণকেও সাহায্য করছিল। এক দু’বার বল স্ন্যাচ করে ওয়েলসের প্রতিআক্রমণও থামালো। নানির গোলটা তো রোনাল্ডোর শট থেকেই হল। এর পরেও কি বলা যায় রোনাল্ডো স্বার্থপর?
এই তো গেল সাপোর্টিং প্লে। গোল খিদেটাও ফিরে এসেছিল রোনাল্ডোর মধ্যে। বল পেলেই বারবার গোলে মারার চেষ্টা করছিল। স্ট্রাইকার্স ইনস্টিঙ্কট বলতে যা বোঝায়। একটা সুন্দর ড্রিবল করেছিল গোলকিপারকে। শুধু অ্যাঙ্গলটা কঠিন হয়ে যাওয়ায় গোলটা করতে পারল না। ফ্রি-কিকটাও গোলের সামান্য উপর দিয়ে চলে গেল।
বিপক্ষে বেলের মতো দুর্দান্ত ফুটবলার থাকতে পারে কিন্তু রোনাল্ডো তো বেলের অনেক অনেক বেশি উন্নত সংস্করণ। বেল যে সব বিভাগে ‘বেটার’, রোনাল্ডো সেখানে ‘বেস্ট’। ফ্রি-কোক হোক বা ড্রিবল, রোনাল্ডো পাঁচ গুণ বেশি তীক্ষ্ম। সেমিফাইনালে রোনাল্ডো যা খেলল, তাতে ওর পারফরম্যান্স নিশ্চয়ই চিন্তায় ফেলবে জার্মানি বা ফ্রান্সকে।
রোনাল্ডো পর্তুগাল দলটার কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেও, দলের সাপোর্টিং কাস্টেও প্রতিভাবান ফুটবলারে ভর্তি। রেনাতো স্যাঞ্চেজের কথাই ধরা যাক। ছেলেটার বল কন্ট্রোল কী সু্ন্দর। জোয়াও মারিও। ফিনিশ খারাপ কিন্তু গতি আছে। সবশেষে নানি। রোনাল্ডোর যোগ্য ডেপুটি। গোলের মধ্যেও আছে।
গোটা টুর্নামেন্টে ধারাবাহিক খেলতে না পারলেও, রোনাল্ডো কিন্তু ঠিক সময় পিক করছে। আর এই ভয়ঙ্কর রোনাল্ডো যে কোনও বিপক্ষের জন্যই বড় চ্যালেঞ্জ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy