দুই কিংবদন্তির ক্লাস। শুক্রবার চেন্নাইয়ে। —নিজস্ব চিত্র।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মাঠে তাঁদের শেষ দেখা ন’বছর আগে। মোহালিতে। ন’বছর পর সেই বিধ্বংসী অস্ট্রেলীয় পেসার গ্লেন ম্যাকগ্রাকে ফের স্পোর্টস গিয়ারে দেখে প্রায় চমকেই গেলেন সচিন তেন্ডুলকর। বললেন, ‘‘আরে চেহারাটা একেবারে মাস্টারমশাই, মাস্টারমশাই করে ফেলেছ হে! দেখে বোঝা যাচ্ছে, তুমি এখন কোচ!’’
ক্রিকেট মাঠে তিনি বাউন্সার দিতেন, সচিন সামলাতেন। এ বার সচিনের বাউন্সার। তবে তা সামলাতে ম্যাকগ্রা যে খুব একটা বেগ পেলেন বলে তো মনে হল না। জবাব যেন ঠোঁটেই ছিল, ‘‘আর তুমি তো দিন দিন ছাত্র ছাত্র দেখতে হয়ে যাচ্ছ! আসবে না কি এমআরএফ ক্যাম্পে? আমার কাছে পেস বোলিং শিখতে?’’
শুনে প্রায় আঁতকে উঠলেন সচিন, ‘‘আবার! পেস বোলিংটা যে কী ঝক্কির, তা ২৮ বছর আগে এখানে এসেই বুঝেছিলাম। সে দিন (ডেনিস) লিলি স্যর আমাকে রিজেক্ট করে দিয়ে বলেছিলেন, শোনো বাছা। ব্যাটিংটাই মন দিয়ে করো। পেস বোলিং-টোলিং তোমার দ্বারা হবে না।’’ ১৯৮৭-তে এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনে সচিনের ট্রায়ালে আসার গল্প শুনে হাসতে শুরু করলেন ম্যাকগ্রা। বললেন, ‘‘যাক এত দিন পরে যে আবার এসেছ, আমাদেরই ভাগ্য ভাল। ছেলেদের একটু উৎসাহ দিয়ে যাও।’’
ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা পেস বোলার তৈরির কারখানায় শুক্রবার সচিন তেন্ডুলকর হাজির হয়েছিলেন ক্রিকেট-ছাত্রদের তাতাতে। ম্যাকগ্রা এখন ভারতে পেসার তৈরির কারিগর। এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনের কোচিং ডিরেক্টর। এবং তাঁর আমন্ত্রণেই সচিন এ দিন এসেছিলেন চেন্নাইয়ের ক্রিশ্চিয়ান কলেজ ক্যাম্পাসে ম্যাকগ্রার ছাত্রদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে। বোলারদের ব্যাটসম্যানরা কী চোখে দেখে, তা বোঝাতে। যেখানে সচিন বলে গেলেন, ‘‘ম্যাকগ্রার চেয়ে কঠিন বোলার খুব কমই সামলেছি। ও ভারতে পেসার তৈরির দায়িত্ব নিয়েছে আর আমি ওর সেই কর্মযজ্ঞ দেখতে আসব না?’’ আর ম্যাকগ্রা বললেন, ‘‘সচিনের মতো বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যানই ছেলেদের এই ব্যাপারটা ভাল করে বোঝাতে পারে।’’
সে ভাবে বোঝালেনও সচিন। শিক্ষকের মতো নয়, স্নেহশীল পিতার মতো। বললেন, ‘‘নিজেদের ভুল নিয়ে ভাববে, কিন্তু এত বেশি ভাববে না, যাতে তুমি হারিয়ে যাও।’’ আরও বললেন, ‘‘সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজের চারপাশের ভালগুলো নিয়ে ভাববে, দেখবে পারফরম্যান্সেও তার প্রভাব পড়ছে।’’ বললেন আরও অনেক কিছু, যা অপার বিস্ময়ে শুনলেন উঠতি পেসার সন্দীপ শর্মা থেকে শুরু করে বাংলার বীরপ্রতাপ সিংহ, সবাই। বিমুগ্ধ সন্দীপ পরে বললেন, ‘‘এমন একজন কিংবদন্তি সামনে এসে যদি ভাবে বুঝিয়ে যান, তা হলে সেটা বেদবাক্য।’’
ম্যাকগ্রা-সচিনের এই হৃদ্যতা দেখে কেউ কেউ অবাক। সাংবাদিক সম্মেলনে সচিনকে জিজ্ঞেসই করে ফেলা হল যে, ম্যাকগ্রার হাত থেকে কী কী সব মারাত্মক অগ্নিগোলক তাঁর দিকে এককালে ছুটে গিয়েছে, সে সব ভুলে গিয়েছেন কি না। সচিন বললেন, ভোলেননি। ভোলেননি ক্রিকেট ক্লাসিকে ঢুকে পড়া তাঁদের চিরবিস্মরণীয় ডুয়েল। ম্যাকগ্রার নিখুঁত পেস বোলিংয়ের সামনে যদি লিটল মাস্টার চারটে সেঞ্চুরি আর ন’টা হাফসেঞ্চুরি তুলে থাকেন, তেমন বত্রিশ বারের সম্মুখসমরে শূন্য রানে বিদায় নিতে হয়েছে তিন বার। ম্যাকগ্রার সামনে সর্বমোট আউট সংখ্যা তেরো।
‘‘গ্লেনের ফোকাস, আগ্রাসন আর শৃঙ্খলা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যেতাম। কী ধৈর্য! ওকে সামলাতে আমার নাভিশ্বাস উঠত। ১৯৯৯-এ অ্যাডিলেডে আমার বিরুদ্ধে ছ’ছটা ওভার ও মেডেন করেছিল। ও অফ স্টাম্পে বল করে যাচ্ছে, আমিও প্রতিটা বল ছেড়ে যাচ্ছি। দু’জনকেই অসীম ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়েছিল সে দিন,’’ বলতে বলতে অতীতের সরণি ধরে হাঁটতে হাঁটতে যেন বাইশ গজে পৌঁছে যান সচিন। অ্যাডিলেড, ১৯৯৯ প্রসঙ্গের সঙ্গে কুখ্যাত এলবিডব্লিউয়ের ব্যাপারটাও উঠল। যেখানে ম্যাকগ্রার বল ডাক করতে গিয়ে সচিনের কাঁধে লাগে আর আম্পায়ার ডারেল হার্পার আঙুল তুলে দেন। ম্যাকগ্রা আজও মনে করেন, বলটা স্টাম্পে ছিল। বললেন, ‘‘আসলে ও বেঁটে বলে মনে হয়েছে বলটা স্টাম্পের উপর দিয়ে যাবে।’’ যিনি এটাও বিশ্বাস করেন যে ভারতবাসী কোনও দিন তাঁকে ’০৩ বিশ্বকাপ ফাইনালের কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষমা করবে না। ‘‘প্রথমেই সচিন বাউন্ডারি মারল। ভাবলাম, দিই একটা শর্ট। ভাবিনি যে সচিনকে পেয়ে যাব। আর এটাও জানি ওই আউটটার জন্য ভারতবাসী কখনও আমাকে ক্ষমা করবেন না।’’
তবু সেই ভারতেই ম্যাকগ্রা আজ পেসার আবিষ্কারের নেশায় ডুবে। সচিনের আগমনে যে নেশাটা বোধহয় আর একটু গাঢ় হয়। যিনি জানেন আবহাওয়া, জিন, পরিবেশগত কারণে ভারত থেকে ভাল পেসার তোলা সহজ নয়। কিন্তু এটাও বিশ্বাস করেন, কঠোর সাধনায় সব হয়।
সচিন রমেশ তেন্ডুলকরের উইকেট যদি সে সাধনায় আসে, একটা জাহির খান বার করা তো খুব দুঃসাধ্য নয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy