নয়া জমানা: জগমোহন ডালমিয়ার সেই চেয়ার খালি রেখে পাশেই বসলেন নতুন সিএবি প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।
বিশাল-বিশাল ফুলের মালাগুলো এগিয়ে আসছে একের পর এক। আর মিনিটে দু’বার ঘাড় নিচু করতে হচ্ছে তাঁকে। বড়-সেজো-মেজো-আধা কর্তাদের হাতে কারও পুষ্পস্তবক, কেউ হাজির সোজাসুজি মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে। ‘আর না প্লিজ’, ‘আরে, মালা-টালা পরা ছেড়ে দিয়েছি কত দিন’ এ জাতীয় কাকুতি-মিনতিতে লাভের লাভ শূন্য। কারণ কেউ শুনছেনই না। শোনার কোনও রকম ইচ্ছেও দেখাচ্ছেন না। ভিড়টা সময়ে পাতলা হল একটু, কিন্তু তাতে কী? উপস্থিত এ বার নতুন ভিড়, নতুন আবদার। মিডিয়ার ভিড়, আলোকচিত্রীদের আবদার। হুড়মুড় করে যা টেবলের উপর দিয়ে প্রায় ঘাড়ে উঠে আসতে চাইছে অদ্ভুত সব চাহিদা সমেত— ডালমিয়ার ফোনটা কানে নিয়ে একটা পোজ লাগবে... অভিষেকের সঙ্গে দাঁড়ান না একটু প্লিজ!
সন্ধে সওয়া পাঁচটা এখন। এটা, সিএবি-র দোতলার কোনাকুনি বিখ্যাত সেই ঘর। প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়ার ঘর। যেখানে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় দাঁড়িয়ে আছেন। ভুল। নতুন সিএবি প্রেসিডেন্ট দাঁড়িয়ে আছেন।
‘‘তেরো মাস আগে যদি যদি কেউ আমাকে বলত যে, তুমি তেরো মাস পর সিএবি প্রেসিডেন্ট হচ্ছ বিশ্বাস করতাম না। এটা তো অনেকটা এ রকম হয়ে গেল যে, লর্ডসে সেঞ্চুরির আগে কেউ আমাকে বলে গিয়েছে তুমি সেঞ্চুরি করছ!’’ শুনে হাসতে শুরু করেন সিএবি-র নতুন যুগ্ম-সচিব অভিষেক ডালমিয়া। সঙ্গে ডালমিয়া-পুত্র জুড়ে দেন, ‘‘জন্ম থেকে মহারাজদাকে দেখছি। যে কোনও সমস্যায় পাশে পেয়েছি। আমার কোনও আর চিন্তাই থাকল না।’’ এ বারও হাসির একটা হুল্লোড়। সমবেত মিডিয়ার।
সন্ধে ছ’টা এখন। এটা, সিএবির তিন তলার কনফারেন্স রুম। যেখানে লম্বা টেবলের সামনে দু’জন বসে। এক জন সংস্থার নতুন ক্যাপ্টেন। সৌরভ। দ্বিতীয় জন, তাঁর ভাইস ক্যাপ্টেন। তাঁরই অভিহিত ‘আমার নতুন রাহুল দ্রাবিড়!’
রীতিমতো রাজকীয় সংবর্ধনায়, বিপুল উৎসবের মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার বঙ্গ ক্রিকেট প্রশাসনে সূচনা হয়ে গেল সৌরভ-যুগের। প্রায় একশো সদস্যের উপস্থিতিতে ঠিক হয়ে গেল বাংলার ক্রিকেট প্রশাসনের তাজ কার মাথায় উঠতে যাচ্ছে। কোনও বিরুদ্ধ মনোনয়ন জমা পড়ল না, বিশেষ সাধারণ সভা শুরু হতে না হতে শেষ হয়ে গেল (ডালমিয়ার স্মৃতিতে নীরবতা পালন সমেত) এবং সিএবির প্রেসিডেন্ট ও যুগ্ম সচিব পদে সর্বসম্মত ভাবে নির্বাচিত হয়ে গেলেন সৌরভ ও অভিষেক।
মাত্র দশ মিনিটে।
এবং শুধু উৎসব নয়, সিএবি-র নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বঙ্গ ক্রিকেটের আগামী রূপরেখাও দিয়ে গেলেন। যেখানে নিজের তিন দর্শনের কথা বলে গেলেন খোলাখুলি। বুঝিয়ে গেলেন, তাঁর জমানায় বঙ্গ ক্রিকেট কোন দিকে হাঁটতে যাচ্ছে।
পরিকল্পনা ১— ইডেন গার্ডেন্স। মাঠ থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধে, সব কিছু নিয়ে দ্রুত বসা হবে। ইডেনের বর্তমান মডেল পাল্টে দেওয়া হবে তিন মাসে। এমন করে দেওয়া হবে যা পাল্লা দেবে বিশ্বের সেরা ক্রিকেট স্টেডিয়ামগুলোর সঙ্গে। যার নিগূঢ় অর্থ, এ সব হবে ইডেনে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে আগেই।
পরিকল্পনা ২— জুনিয়র ক্রিকেট। আট-ন’বছর বয়সি থেকে প্লেয়ার তোলার কাজ শুরু হবে। যারা পনেরোয় গিয়ে বিশ্বপর্যায়ে লড়ার ক্ষমতা রাখবে।
পরিকল্পনা ৩— আপসহীন সিএবি। সংস্থার স্বার্থবিরোধী কোনও কিছু বরদাস্ত করা হবে না। কোনও নামকেই সংস্থার উপরে গুরুত্ব দেওয়া হবে না। এমনকী স্বয়ং ‘গাঙ্গুলি’-কেও নয়। সঙ্গে চেষ্টা করা হবে প্রশাসনে যতটা সম্ভব স্বচ্ছতা রাখার।
শোনা গেল, শনিবারই বোর্ডের প্রধান কিউরেটর দলজিৎ সিংহের সঙ্গে বসতে চলেছেন সৌরভ। বিষয়— বৃষ্টিতে ইডেনকে কী করে দ্রুত ম্যাচ খেলার অবস্থায় আনা যায়, তা নিয়ে আলোচনা। দিন সাতেকও যায়নি ইডেনে ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা টি-টোয়েন্টি দুপুরের মাত্র আধ ঘণ্টার বৃষ্টিতে রাতে পণ্ড হয়ে গিয়েছে। সেই কলঙ্কের পুনরাবৃত্তি যাতে আবার না হয়, তাই এই তড়িঘড়ি ব্যবস্থা। সবচেয়ে বড় কথা, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আসছে। সেক্ষেত্রে তার আগে পুরো ইডেন আউটফিল্ডের চরিত্র বদলে ফেলা হতে পারে। দ্রুত ঠিক করে ফেলা হতে পারে কিউরেটরও। নতুন সিএবি প্রেসিডেন্ট বললেন, তিনি প্রবীর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলবেন। প্রবীরবাবু গররাজি হলে কারও কারও মনে হচ্ছে, প্রাক্তন যুগ্ম সচিব সুজন মুখোপাধ্যায়কে ইডেন মাঠের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।
এবং নতুন প্রেসিডেন্টের ইডেন নিয়ে উদ্যোগের মতো তাঁর ভাবী দর্শনও সিএবি-র গরিষ্ঠ অংশে সমাদৃত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, সৌরভ যা বলছেন ঠিকই বলছেন। প্রবীরবাবুর সঙ্গে ‘আপস’ না করলে ইডেন-কলঙ্ক ঘটত না। বলা হচ্ছে, গত এক-দেড় বছরে সত্যিই এমন পরিস্থিতি এসেছে যেখানে কাউকে কাউকে নাকি মনে হয়েছে সংস্থার উপরে। এ বার সে সব বন্ধ হবে। এঁরা এটাও মনে করেন যে, কর্নাটক ক্রিকেট সংস্থায় অনিল কুম্বলে-জাভাগল শ্রীনাথের মতো অবস্থা হওয়ার সম্ভাবনা নেই সৌরভের। কারণ প্রশাসনের সঙ্গে তাঁদের নানাবিধ অন্যান্য দায়িত্ব ছিল। যা সামলে প্রশাসনের উঁচু পদ সামলানো সম্ভব নয়। সৌরভের সেটা হবে না। কারণ অন্য সব দায়িত্ব তিনি ইতিমধ্যেই ছেড়ে দিয়েছেন।
ঘটনা। সিএবি প্রেসিডেন্ট শোনা গেল, বেশ টেনশনে যে সচিন তেন্ডুলকরকে কী উত্তর দেবেন। বলছিলেন, ‘‘ভেটারেন্স লিগে সই করে দিয়েছিলাম। সচিনকে তো ফোন করে কিছু একটা এ বার বলতে হবে।’’ তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, কোনটা বেশি কঠিন মনে হচ্ছে? ভারতকে নেতৃত্ব দেওয়া নাকি সিএবির ক্যাপ্টেন্সি করা? এ বার উত্তর এল, ‘‘ব্যাপারটা হল লোক সংখ্যা। ইন্ডিয়া টিমে আমাকে পনেরো জন সামলাতে হত। এখানে সেটা ১২১ (সিএবি-র অনুমোদিত সদস্য সংখ্যা।)। আমি নিশ্চিত, এখানেও অনেক ভাল লোক আছেন। আর এটা তো শুধু গাঙ্গুলি বা অভিষেক ডালমিয়ার ব্যাপার নয়। এটা ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল। যা-ই হবে সিএবি-র হবে। ভাল হলেও তাই, খারাপ হলেও।’’ একটু থেমে সংযোজন, ‘‘আমার নীতিটাও বদলাচ্ছে না। প্লেয়ার হিসেবে যা করতাম, যে ভাবে রোজ খাটতাম, এখানেও তাই করব। আমার সব কাজই হবে বাইশ গজ ভিত্তিক। দেশের হয়ে খেলা শুরু করেছিলাম যখন ভাবিনি, তিন বছরের মধ্যে অধিনায়ক হয়ে যাব। সিএবিতে সচিব হলাম যখন, ভাবিনি এগারো মাসের মধ্যে প্রেসিডেন্ট হব। দেখা যাক।’’
কী মনে হচ্ছে? মধুরেণ সমাপয়েৎ?
নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। ঘটনা হল, সিএবিতে সৌরভ-যুগের সূচনার দিন কোনও কোনও ব্যাপার বিসদৃশ লেগেছে। যেমন সংস্থার কোষাধ্যক্ষ বিশ্বরূপ দে-র অনেক দেরি করে সৌরভকে মাল্যদান। যা ঘটল গরিষ্ঠের সংবর্ধনার পর, প্রায় শেষের দিকে। একটা গোষ্ঠী আবার ক্রমাগত দাবি করে গেল, বৈঠকে সদস্যদের উপস্থিতি সংখ্যা মোটেও একশো ছিল না। ছিল সম্ভাব্য একশো আঠারোর মধ্যে সাতাশি। আরও একটা ব্যাপার কেউ কেউ মৃদু তুললেন। সেটা হল, প্রয়াত জগমোহন ডালমিয়ার অদৃশ্য সত্ত্বার সঙ্গে এ বার থেকে সৌরভের কর্মকাণ্ডের নিরন্তর তুলনা। মানে, ডালমিয়া কী করতেন আর সৌরভ কী করছেন, তার চাপ।
অনুভব করবেন সেটা?
সৌরভ আনন্দবাজারকে বললেন, ‘‘না। আমি নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করব। আর না পারলে চলে যাব!’’
ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy