যত দিন কোচিং করাব ওই মেসেজটা আমার মোবাইলে থাকবে!
মোহনবাগান আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর কয়েকশো মেসেজ পেয়েছি। নতুন মরসুম শুরুর আগে তার সব ক’টা মুছেও ফেলেছি। কিন্তু ওই একটা রেখে দিয়েছি।
প্রায় রাতারাতি সনি-শিল্টনদের দায়িত্ব নেওয়ার দিন এক কট্টর বাগান সমর্থক আমাকে মেসেজ করেছিলেন, ‘আপনিই না আমাদের ক্লাবকে বলেছিলেন, মোহনবাগান এখন আর বড় ক্লাব নয়। সেই ক্লাবে কোচিং করতে আসছেন! লজ্জা করছে না? ’
সত্যি বলতে মেসেজটা পেয়ে প্রচণ্ড লজ্জা পেয়েছিলাম। বলতে পারেন একটা শিক্ষাও পেয়েছিলাম। আসলে হয়েছিল কী, ইউনাইটেডে কোচিং করানোর সময় মোহনবাগানকে টানা পাঁচ বার হারিয়েছিলাম। তখন ওই রকম কিছু একটা বলেছিলাম সত্যিই। সেটাও প্রকাশ্যে। একটা সাংবাদিক সম্মেলনে।
আমার ওই এক ঠোঁটকাটা দুমদাম বলে দেওয়ার স্বভাব আছে! তাতে নানা সমস্যাও তৈরি হয়। এ নিয়ে শুধু মাঠে নয়, আমার পরিবারেও নানা সমস্যা হয়েছে। ঝগড়া বেঁধেছে।
ক্লাবেও এই যেমন বেলো রজ্জাক ইস্টবেঙ্গলে চলে যাওয়ার পর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। কর্তাদের সম্পর্কে কিছু খারাপ শব্দ বলে ফেলেছিলাম। কারণ, নতুন মরসুমের যে প্লেয়ার্স লিস্ট আমি দেবাশিস-সৃঞ্জয়দের হাতে তুলে দিয়েছিলাম তাতে এক নম্বর নামটাই তো ছিল বোলোর। দু’নম্বরে সনি। আর তিনে কাতসুমি। পরে কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে আমার ভুল ভাঙে। বুঝি, অন্যায়টা বেলোই করেছে।
কিছু দিন আগে বাংলার ফুটবলের ইউথ ডেভেলপমেন্টের ব্যাপারে আমার একটা মন্তব্য ঘিরে বিরাট বিতর্ক হল। কিন্তু বিশ্বাস করুন, কাউকে দুঃখ দেওয়ার জন্য আমি সেদিন কথাগুলো বলিনি।
কোচিংয়ে আমাদের ‘এ’ লাইসেন্স পেতে আট-নয় বছর লেগেছিল। আর এখন অনেককে আট-নয় দিনে ‘ডি’ লাইসেন্স করে ফেলতে দেখেও ভীষণ রাগ হয়েছিল আমার। এই সিস্টেমের বিরুদ্ধেও আমি কড়া মন্তব্য করেছি। শুনেছি তাতেও অনেকে চটেছে!
এটাও শুনছি, অনেকে আমাকে ময়দানের ‘নতুন বাবলু ভট্টাচার্য’ বলছে। নানা বিতর্কিত কথা বলার জন্য। এটা ঠিক, রেলে যখন খেলতাম তখন বাবলুদার মতোই ষোলো নম্বর জার্সি পরে খেলতাম। আমরা দু’জনেই স্টপার। আবার এটাও ঠিক, আমি কারও কার্বন কপি নই। কারও ছায়াও হতে চাই না। নিজের টিআরপি বাড়ানোর জন্য বিতর্কিত কিছু বলি না।
আসলে আমি যেটা বলি নিজের বিশ্বাস থেকে বলি। আত্মোপলব্ধি থেকে বলি। এখন বুঝতে পারছি, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলে কোচিং করতে এলে তাদেরকে কূটনীতিক হতে হয়। অনেক সতর্ক থাকতে হয়। সব কথা বলে ফেলা যায় না। আমার স্ত্রী এবং বন্ধুরাও বলছে, সতর্ক থেকে কথা বলো। তবে জানি না, নিজের বিশ্বাস সরিয়ে রেখে কত দিন সেটা পারব আমি! যদিও খুব ভাল জানি, বড় ক্লাবে কোচের জীবন ফুটবলের সাডেনডেথের মতোই। যখন-তখন ঝুপ করে শেষ!
ইস্টার্ন রেলের কোচ থাকার সময় কল্যাণীতে আন্তঃ রেলের একটা ম্যাচে আমার টিমের সন্দীপ কর্মকারের ঘাড়ে এক বিপক্ষ ডিফেন্ডার এমন বিশ্রী ভাবে মেরেছিল যে, আমি রাগে রিজার্ভ বেঞ্চ থেকে মাঠে ঢুকে গিয়ে সেই ডিফেন্ডারের জার্সির কলার টেনে ধরেছিলাম। মাঠে সে দিন ইস্টার্ন রেলের জিএম ছিলেন। রেলের অনেক বড় অফিসারও। ম্যাচটা না জিততে পারলে হয়তো শাস্তি হত আমার। চাকরি নিয়েও সমস্য হতে পারত। ফুটবলারজীবনে প্রচুর লালকার্ড দেখেছি। ওই গরম মেজাজের জন্যই। এখন বুঝতে পারি ভুল করেছিলাম। এখন কাতসুমি-শিল্টনদের সঙ্গে টিম মিটিংয়ে কার্ড দেখার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলি। বারবার নিজের ফুটবলারজীবনের ভুলের কথা বলি।
এখন আমার মাঝেমাঝে কেমন যেন আশ্চর্য লাগে যে, মোহনবাগানের আই লিগ চ্যাম্পিয়নশিপের রাস্তায় অসংখ্য সমস্যা-ঝামেলার মধ্যেও নিজেকে কী ভাবে অত শান্ত রাখতে পারলাম! আমাদের ক্লাবে টাকাপয়সার সমস্যা চলছেই। স্পনসর নিয়ে সমস্যা আছে। কর্তারা চেষ্টা করে যতটা পেরেছেন, করেছেন। তাঁদের শত চেষ্টা সত্ত্বেও গতবার সমস্যায় পড়েছি।
এখন বলে দিতে বাধা নেই, পুণে ম্যাচের পর সনি নর্ডি এসে বলেছিল, ‘‘কোচ, অনেক হয়েছে আর নয়। টাকা না পেলে খেলব না।’’ পিয়ের বোয়া টাকা না পাওয়ায় ফ্লাইটে উঠতেই চাইছিল না! অন্য অনেক ফুটবলারও আমার কাছে এসে বারবার বকেয়া মাইনের কথা বলত। আমি সবাইকে আশ্বস্ত করতাম। ক্লাব কর্তাদের সঙ্গে একান্তে কথা বলতাম। তবু কিছুতেই টিমের ফোকাস নড়তে দিইনি। সেই সময় ঘরের কথা বাইরে বলিনি। মাঝেমধ্যে ভাবি আমি যেখানেই যাই সেখানেই কি আর্থিক সমস্যা হয়? আমিই কি অপয়া!
ইউনাইটেডে থাকার সময় সমস্যা ছিল। মহমেডানেও একই অবস্থা হয়েছিল। টাকা না পাওয়ায় আইএফএ শিল্ডে মাঠে নামেনি পেন, লুসিয়ানো, জোসিমাররা। মোহনবাগানেও গত মরসুমে তখন একই অবস্থা। রাতে শুয়ে চিন্তা করতাম। পরে অবশ্য ভেবেছি, আমি যদি অপয়াই হই, তা হলে মহমেডান চুয়াল্লিশ বছর পর কী ভাবে আমার কোচিংয়ে শিল্ড জিতল? মোহনবাগান কী ভাবে তেরো বছরের খরা কাটিয়ে আই লিগ জিতল? তা হলে কি অভাবের সংসারের মতো অভাবের টিমের জেদ বেশি থাকে?
আমি আর্সেন ওয়েঙ্গারের ভক্ত। তারকা তোষণের রাস্তায় হাঁটি না। বরাবর টিমগেমে বিশ্বাসী। রাম মালিকের মতোই দেখি সনি নর্ডিকে। তারকাদের আমি যথাযোগ্য সম্মান দিই। কিন্তু মাথায় তুলি না। সেটা করলে টিমের মনোবল নষ্ট হয়। ড্রেসিংরুমের পরিবেশে প্রভাব পড়ে। ওডাফার সময় তিন বছরের মোহনবাগান তার জলন্ত উদাহরণ।
আনন্দবাজারে আমার প্রথম কলাম শুরু করেছিলাম এক বাগানঅন্ত প্রাণের রাগত মেসেজের গল্প দিয়ে। শেষ করছিও আর একটা মেসেজের গল্প শুনিয়ে। এটা যিনি পাঠিয়েছিলেন, তাঁর আরও প্রচুর মেসেজ পেয়েছি পরে। জেতার পর অভিনন্দন পেয়েছি। ড্র বা হারের পর উদ্বুদ্ধ হওয়ার মতো লাইন লিখে পাঠিয়েছেন। আমার পরিবার থেকে মামার বাড়ি পর্যন্ত— কোনও কথাই তাঁর অজানা নয়। এই জানকবুল সমর্থকরাই তো এখনও প্রাণ বড় ক্লাবের।
এ বছর ইস্টবেঙ্গল আমার কাছে দু’বার কোচিং করানোর প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। আমি মোহনবাগানী নই। তবে একজন পেশাদার কোচ। জীবনে কখনও ইস্ট-মোহন খেলিনি। সেই আক্ষেপ মেটানোর জন্য স্বপ্ন দেখি ওই দুই বড় ক্লাবে কোচিং করানোর। ইস্টবেঙ্গলের প্রস্তাব পাওয়ায় সেটা এ বারই হয়তো পূর্ণ হত। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আই লিগ জেতার পর দমদম এয়ারপোর্ট থেকে মোহনবাগান তাঁবু পর্যন্ত যে প্রচণ্ড আবেগ আর উচ্ছ্বাস দেখেছি, সেটাকে কয়েক দিনের মধ্যেই সরিয়ে রেখে কী ভাবে ইস্টবেঙ্গলে যাই?
তাই আরও একটা মরসুম থেকে গেলাম মোহনবাগানে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy