ডার্বির টিকিট দিয়ে ফোনের লাইন পেয়েছিলাম
শ্যাম থাপা
খেলোয়াড় জীবনে ডার্বি আসা মানেই শুরু হয়ে যেত টিকিটের হাহাকার। অফিসে প্রায় যার সঙ্গেই সামান্য চেনাশোনা ছিল, তারাই এসে বলত, ‘‘শ্যামদা টিকিট কিন্তু চাই।’’ আমার খারাপ লাগত। এত জন ম্যাচ দেখতে চায়, অথচ সবাইকে টিকিট দেওয়া সম্ভব নয়। তাই আমি ঠিক করেছিলাম অফিসের ইউনিয়ন লিডারকে দিয়ে লটারি করে টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা করব।
সেই মতো ইউনিয়ন লিডারকে বলেছিলাম, আমি নিজে কাউকে টিকিট দেব না। আপনি লটারি করুন। যাদের নাম উঠবে তাদের দিন। তখনকার সময় ফোন কানেকশন পাওয়ার ব্যাপারটা খুব ঝামেলার ছিল। কিন্তু ডার্বির টিকিট দিয়ে আমি ফোন আর গ্যাস কানেকশন—দু’টোই পেয়েছিলাম।
মনে আছে, ডার্বির আগের দিন আমি কালীমন্দিরে পুজো দিতে যেতাম। সেখানেও পাণ্ডারা দুই ক্লাব নিয়ে ঝগড়া বাধিয়ে দিত। আমায় বসিয়ে রেখে ঝগড়া শুরু হয়ে যেত, ইস্টবেঙ্গল জিতবে না মোহনবাগান। আমি বলতাম, ‘‘আরে তোমরা মন্ত্র পড়বে নাকি ঝগড়া করবে।’’
আমি সাধারণত একটা রুটিন মেনে চলতাম। খাওয়াদাওয়া হোক বা ঘুমোতে যাওয়া, সব কিছুই নিয়ম মেনে। মাথায় সব সময় একটা চাপ থাকত কিন্তু সমর্থকরা আশ্বাস দিত ঠিক পারবে। সেই পাঁচ গোলের ম্যাচে আমি ইস্টবেঙ্গলের হয়ে দু’গোল করেছিলাম ঠিকই। কিন্তু খারাপ লাগছিল মোহনবাগান সমর্থকদের কথা ভেবে। দিনের শেষে তো আমরা সমর্থকদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্যই লড়াই করি। তাই কারও চোখে জল ভাল লাগে না।
হাবিবের চড়টা কোনও দিন ভুলব না
সুব্রত ভট্টাচার্য
ডার্বি এমন একটা ম্যাচ যার উন্মাদনার ধারেকাছে অন্য কিছু আসে না। আমাদের সময় উন্মাদনাটা একটু হলেও বেশি ছিল। কারণ তখন বাঙালি ফুটবলারের সংখ্যা ছিল বেশি।
আজও মনে আছে হাবিবের সেই থাপ্পড়। ডার্বির আগে খুব টেনশন হতো। ১৯৭৬-এর জুলাই মাস। মোহনবাগান মেস-এ থাকতাম। আমার সঙ্গে হাবিব থাকতেন। সিনিয়র প্লেয়ার ছিলেন। সব সময় আমায় আগলে রাখতেন। আমিও খুব মানতাম। এ রকমই এক ডার্বির আগের রাত। সে বার খুব একটা ভাল খেলছিলাম না আমরা। তাই চাপটা ছিল। ভাবছিলাম এ বার যদি বড় ম্যাচে হারি, তা হলে আরও হয়তো বেশি গালিগালাজ খেতে হবে। সেই সব ভেবে আমার রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিল। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমি করিডরে নিজের মনে হাটছি। মাথায় চিন্তা ছিল। রাত অনেক হয়ে গিয়েছিল। আমাকে ঘুমোতে না দেখে হঠাৎ করে হাবিব উঠে এলেন। প্রথমেই আমার গালে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘কেয়া হুয়া, তু অভি তক সোনে কিঁউ নেহি গয়া।’’ আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, টেনশন হচ্ছে। তাতেও কী শোনে। আমায় বোঝালেন, ‘‘ম্যাচ তো কাল হোগা। আজ সো যা। রেস্ট কর লে।’’
আমি সাধারণত অত বেশি কুসংস্কার মানতাম না। কিন্তু হাবিবদার চাপে পড়ে আগে ডান পা ফেলে মাঠে ঢুকতে হতো। আমি যখন সিনিয়র হলাম, চেষ্টা করতাম বাকিদের সাহায্য করার। আমি সাধারণত ম্যাচের আগের দিন মেস থেকে বেরোতাম না। খাবার নিয়েও অত বেশি কিছু নিয়ম থাকত না। হারলে মন খারাপ লাগত কিন্তু খুব বেশি প্রভাব ফেলতে দিতাম না।
দেরি হয় হোক, ক্লাব তাঁবুতে যাওয়ার রাস্তা বদলাতাম না
অলোক মুখোপাধ্যায়
আমি ইছাপুর থেকে এসেছিলাম। আমার বাড়িতে বরাবর সবার স্বপ্ন ছিল, ছেলে একদিন বড় ম্যাচ খেলবে। তাই আমার কাছে ডার্বিটা কোনও স্বপ্নের থেকে কম কিছু ছিল না।
আমি খুবই কুসংস্কারে বিশ্বাস করতাম। যেমন ম্যাচের আগের দিন বেশি কারও সঙ্গে কথা বলতাম না। ম্যাচের আগের দিন ঘর থেকে বেরোতাম না। কেউ টিকিট চাইতে এলেও সামনে এসে দিতাম না। কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতাম।
কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত কুসংস্কার ছিল, ক্লাব তাঁবুতে যাওয়ার রাস্তা নিয়ে। আমি ইস্টবেঙ্গলে থাকাকালীন উত্তর কলকাতার এক হোটেলে থাকতাম। আর মোহনবাগানে থাকাকালীন লেক গার্ডেন্স। ডার্বির দিন ক্লাব তাঁবুতে যেতাম একটা বিশেষ রাস্তা ধরেই। জ্যাম হোক, ঝামেলা হোক— ওই রাস্তা ধরেই আমাকে যেতে হবে। তাতে ক্লাব তাঁবুতে পৌঁছতে দেরি হলে হবে। অন্য রাস্তা ধরে গেলে ভয় হতো, হয়তো খারাপ খেলব।
ম্যাচের দু’দিন আগে সময় পেলে আমি ইছাপুর ঘুরে আসতাম। মা-বাবার সঙ্গে একটু সময় কাটিয়ে আসা। যাতে টেনশন কমে। সুযোগ পেলে ওরাও আমার লেক গার্ডেন্সের বাড়িতে আসত। গল্পটল্প হতো। লেক গার্ডেন্সের সামনে লেক কালীবাড়িতেও পরের দিকে বহু বার পুজো দিয়েছি। নিয়মমাফিক ডার্বির আগের দিন যেতাম। পুজো দিতাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy