Advertisement
১৯ মে ২০২৪
বল গড়াল সাম্বার ছন্দে

বিশ্বযুদ্ধ নয়, ব্যতিক্রমী বিশ্বযুদ্ধ

আকাশবাণী ভবন থেকে ইডেনের প্যাগোডা— দূরত্বটা আনুমানিক ছকে রাখুন। এ বার ভাবুন ওই অবধি লম্বা পলিথিনে ঢেকে দিয়ে ভেতরে বিশ্বকাপের উদ্বোধন হচ্ছে। অবিশ্বাস্য? অকল্পনীয়? অমার্জনীয়? যা-ই মনে আসুক, এটাই বিশ্বকাপের উদ্বোধনীতে এরিনা কোরিন্থিয়ান্স। পলিথিনে ঢেকে রাখার কারণ তো বোঝাই যাচ্ছে। স্টেডিয়ামের বাইরের কাজ শেষ হয়নি। কমনওয়েলথ গেমসে দুর্নীতির দায়ে সুরেশ কলমডীকে তিহাড় জেলে যেতে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু স্টেডিয়ামগুলো অন্তত তৈরি হয়ে গিয়েছিল গেমসের আগে।

প্রথম খেলাতেই দুরন্ত গোল। পিছিয়ে থাকা ব্রাজিলকে ম্যাচে ফিরিয়ে হুঙ্কার নেইমারের। পরে পেনাল্টি থেকে আরও একটি গোল করেন তিনি। দলের তৃতীয় গোলটি আসে অস্কারের পা থেকে।  ছবি: এপি।

প্রথম খেলাতেই দুরন্ত গোল। পিছিয়ে থাকা ব্রাজিলকে ম্যাচে ফিরিয়ে হুঙ্কার নেইমারের। পরে পেনাল্টি থেকে আরও একটি গোল করেন তিনি। দলের তৃতীয় গোলটি আসে অস্কারের পা থেকে। ছবি: এপি।

গৌতম ভট্টাচার্য
সাও পাওলো শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৪ ০৩:৫৭
Share: Save:

ব্রাজিল: ৩
ক্রোয়েশিয়া: ১

আকাশবাণী ভবন থেকে ইডেনের প্যাগোডা— দূরত্বটা আনুমানিক ছকে রাখুন। এ বার ভাবুন ওই অবধি লম্বা পলিথিনে ঢেকে দিয়ে ভেতরে বিশ্বকাপের উদ্বোধন হচ্ছে।

অবিশ্বাস্য? অকল্পনীয়? অমার্জনীয়? যা-ই মনে আসুক, এটাই বিশ্বকাপের উদ্বোধনীতে এরিনা কোরিন্থিয়ান্স।

পলিথিনে ঢেকে রাখার কারণ তো বোঝাই যাচ্ছে। স্টেডিয়ামের বাইরের কাজ শেষ হয়নি। কমনওয়েলথ গেমসে দুর্নীতির দায়ে সুরেশ কলমডীকে তিহাড় জেলে যেতে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু স্টেডিয়ামগুলো অন্তত তৈরি হয়ে গিয়েছিল গেমসের আগে।

বৃহস্পতিবার সকালে স্টেডিয়ামে ঢোকার সময় দৃশ্যটা দেখে মনে হচ্ছিল, সব দিক থেকেই বোধহয় ব্যতিক্রমী হতে যাচ্ছে কুড়িতম বিশ্বকাপ! নইলে উদ্বোধনের আগে বিক্ষোভ সামলাতে কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে হয়! আর এ দিন বেলো হরাইজন্তেতে আর্জেন্তিনা বেস ক্যাম্প থেকে আসা খরবটাও তো অবিশ্বাস্য।

রোনাল্ডিনহোর মতো দেখতে এক ব্রাজিলীয় সমর্থক প্র্যাকটিসের সময় নিরাপত্তারক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে লিওনেল মেসিকে চমকে দিয়েছেন। শুনলাম, লিও মেসি যেমন প্র্যাকটিসের সময় আর্জেন্তিনীয় সমর্থকদের কাছে বন্দিত হয়েছেন, সারাক্ষণ ‘মেসি মেসি’ বলে চিৎকার হয়েছে, তেমনই ব্রাজিলীয় সমর্থকরা মেসিকে বিদ্রুপও করেছেন। ফুটবলের ধাত্রীভূমিতে এসে বিদ্রুপের মুখে ফুটবলের রাজপুত্র, এটাও তো নজিরবিহীন!

নজিরবিহীন আরও অনেক কিছু! যেমন বিশ্বকাপ ফুটবলের এমন মেগা ওপিনিয়ন পোল, যেখানে আছেন কিংবদন্তি স্টিফেন হকিং থেকে সিডনির ছোট ক্যাঙারু, ব্রাজিলের ছোট কচ্ছপ থেকে আমেরিকার ভোটের ফল অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে দিয়ে টাইম ম্যাগাজিনের প্রভাবশালী তালিকায় চলে যাওয়া নেট সিলভার!

কে জিতবেই শুধু নয়, কোন ম্যাচে কী ঘটবে— তা পুঙ্খানুপুঙ্খ আগাম বলে দেওয়া এ রকম সর্বগ্রাসী জ্যোতিষচর্চা কোনও খেলার ইতিহাসেই কখনও ঘটেছে কি না সন্দেহ! পেলের আমলে এ সব পূর্বাভাস-টাস মিডিয়াই করত। বড়জোর উইলিয়াম হিল জাতীয় জুয়াড়ি সংস্থাগুলোর রেটিং গুরুত্ব পেত। তারাই ঠিক করে দিত, কারা কত দরের ফেভারিট। কাগজে সেগুলোই ফলাও করে বেরোত।


ভবিষ্যৎদ্রষ্টাদের একজন। ছবি: এএফপি

এ বারেও জুয়াড়িদের পূর্বাভাস আছে। বাজির দর আছে। কিন্তু চার পাশ থেকে অর্থনীতিবিদ সংস্থা, স্ট্যাটিস্টিশিয়ান, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ, পদার্থবিজ্ঞানী, তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, জীবজন্তুর ভবিষ্যৎ বলে দেওয়ার এমন ককটেল শুরু হয়েছে যে, জুয়াড়িরা কী বলল তা এখন বিক্রি হয়ে যাওয়া খবরের কাগজ।

যাবতীয় আগাম-সমীক্ষায় জয়ীর মুকুট কিন্তু তিনটে দেশের মধ্যেই ঘোরাফেরা করছে। না, রোনাল্ডোর পর্তুগাল তো নয়ই। মেসির আর্জেন্তিনাও নয়!

সবচেয়ে বেশি উঠছে ব্রাজিলের নাম। তার পর স্পেন। তার পর জার্মানি।

নেট সিলভারের কথা লিখলাম। ইনি জনসমক্ষে প্রবল ভাবে আবির্ভূত ২০০৮ আমেরিকার নির্বাচনের ফল মিলিয়ে দিয়ে। ৫০ প্রদেশের মধ্যে তিনি ৪৯টা মিলিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সিলভার বিশ্বকাপের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন সকার পাওয়ার ইনডেক্স। সেই ইনডেক্স দেখাচ্ছে ব্রাজিল ৪২.২। তার অনেক পরে দ্বিতীয় হল আর্জেন্তিনা ১২.৮। ইনডেক্সের চেহারার মতোই নাকি টুর্নামেন্টে একাধিপত্য থাকবে স্কোলারির দলের।

সিডনিবাসী ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের একটা গোষ্ঠী আবার বহু গবেষণার পর সিলভারের পূর্বাভাস উড়িয়ে দিয়েছে। যাবতীয় আঁকজোক কষে তাদের ভবিষ্যদ্বাণী: ব্রাজিল ফাইনালে পৌঁছবে না। ফাইনাল হবে মেসি বনাম সোয়াইনস্টাইগার। আর তাতে হেরে যাবেন বিশ্ব ফুটবলের রাজকুমার।

সুইৎজারল্যান্ডের সিইপিএস ফুটবল অবজারভেটরি আবার বলছে, ট্রফি জিতবেন ফের ইনিয়েস্তারা। রিওর ফাইনালে স্পেন বদলা নেবে কনফেডারেশনস কাপে হারের। এই গোষ্ঠীর রেটিং অনুযায়ী ব্রাজিল রানার্স আপ। আর্জেন্তিনা তৃতীয়। ফ্রান্স চতুর্থ। এরা খতিয়ে দেখেছে অংশগ্রহণকারী ৩২ দেশের প্লেয়ারদের বিশ্বকাপের স্ট্যাটিস্টিক্স, ব্রাজিলের গরম, মাঠের অবস্থা। সব দিক দেখে তাদের বক্তব্য, একটা সেমিফাইনালে আর্জেন্তিনা হারবে স্পেনের কাছে। আর একটায় ব্রাজিল হারাবে ফ্রান্সকে।


উচ্ছ্বাসের মুখ। বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচের আগে সাও পাওলোর
স্টেডিয়ামের বাইরে। বৃহস্পতিবার। ছবি: এএফপি।

জীবজন্তুদের দিয়ে ফুটবল জ্যোতিষচর্চা সেই পল অক্টোপাসের সময় থেকে আবির্ভাবেই এমন জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছে যে, এ বার তার হিড়িক আরও বেশি। বাজারে নামানো হয়েছে ফ্লপসি নামের অস্ট্রেলিয়ান ক্যাঙারু, ব্রাজিলের কচ্ছপ, আল্ফ নামক পেঙ্গুইন, শাহিন নামক মরুভূমির উট, আর নেলি নামাঙ্কিত হাতিকে। পলিথিন বেঁধে বিশ্বকাপ উদ্বোধন যেমন নজিরবিহীন। তেমনই নতুন পৃথিবীর নানান প্রান্তের জীবজন্তুকে দিয়ে স্পোর্টস ইভেন্টের ভাগ্য গণনাও। জন্তুরাও অবশ্য ঘুরেফিরে মানুষের পর্যবেক্ষণের পথেই হেঁটেছে। সেই ব্রাজিল, জার্মানি বা স্পেন।

গোল্ডম্যান স্যাক্সের অর্থনীতিবিদেরা আবার তাঁদের ষাট পাতার রিপোর্টে (হ্যাঁ, সাত নয়) বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন, কেন ব্রাজিলকে তাঁরা ফেভারিট আখ্যা দিয়েছেন। এঁদের ব্যাখ্যা একটা ফর্মুলার ওপর দাঁড়িয়ে, যা তৈরি হয়েছে অতীতের গবেষণায় ভিত্তি করে যে অমুক ম্যাচে একটা টিম কত গোল করতে পারে। এই ‘কত করতে পারে’, সেটা ঠিক করার সময় তাঁরা পরিচিত পরিবেশের সুযোগ পাচ্ছে কি পাচ্ছে না, এটাও মাথায় রাখা হয়েছে। গোল্ডম্যান স্যাক্সও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছে কোন ম্যাচে কী হবে এবং কেন হবে।

কোনও কোনও পূর্বাভাস অনুযায়ী উদ্বোধনী ম্যাচে ব্রাজিল ২-০ হারাবে ক্রোয়েশিয়াকে। অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন ব্রাজিল জিতবে ৪-১... আর এই ভাবে চলে তারা ফাইনালে ৩-১ হারাবে মেসিদের। এই গবেষণার সমালোচনাও শুরু হয়ে গিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে অতীত পারফরম্যান্সের ওপর এই গবেষণাটা বড় বেশি নির্ভরশীল। টুর্নামেন্টে যে টিম হঠাৎ উন্নতি করতে শুরু করল বা যারা হঠাৎ বাধার সামনে পড়ে ধ্যাড়াচ্ছে— সেই চান্স ফ্যাক্টরগুলো এখানে ধরা হয়নি।

সবচেয়ে শোরগোল ফেলেছে অবশ্যই বিশ্ববন্দিত স্টিফেন হকিংয়ের পূর্বাভাস। তিনি প্রধানত গবেষণা করেছেন ইংল্যান্ডের কাপ জেতার সম্ভাবনা নিয়ে। হকিং তাঁর ডেটা হিসেবে ব্যবহার করেছেন ছেষট্টির বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত বিশ্বকাপের সব ক’টা ম্যাচ। খেয়াল রেখেছেন দলগুলোর সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সের উপরে। এমনকী ফ্রেন্ডলি ম্যাচগুলোও। তাঁর গবেষণা বলছে, ইংল্যান্ড লাল জার্সি পরে খেললে বেশি ভাল খেলবে। ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেললে তাদের জেতার সম্ভাবনা বেড়ে দাঁড়াবে শতকরা ৫৮ ভাগ, ৪-৪-২ খেললে সেটা কমে হবে শতকরা ৪৮ শতাংশ। তাঁর স্টাডি অনুযায়ী কোন তাপমাত্রায় খেলা হচ্ছে, সেটা ইংল্যান্ডের পক্ষে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তাপমাত্রা পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়া মানে ইংল্যান্ডের জেতার শতকরা ৫৯ ভাগ আশা চলে গেল। আর বলেছেন ইংল্যান্ড লাইন-আপে যেন লালচুলো প্লেয়ারের সংখ্যা বেশি থাকে। তা হলে জেতার চান্স বাড়বে।

হুইলচেয়ার আবদ্ধ পৃথিবীর অন্যতম সেরা মস্তিষ্ক অবশ্য গবেষণা প্রকাশিত হওয়ার পর বিরোধিতার মুখেও পড়েছেন। এক ভক্ত উত্তেজিত চিঠি লিখেছে, আপনার মতো রোল মডেল কী করে এই সব পাবলিসিটি স্টান্টে জড়াতে পারেন? আর এক ভক্ত টুইট করেছেন, লম্বা হাঁটতে চললাম। আদর্শের অপমৃত্যু দেখে আর কীই বা করার আছে!

এতগুলো সমীক্ষার মধ্যে একমাত্র হকিংই রেফারি ফ্যাক্টরকে গবেষণার মধ্যে রেখেছেন। তাঁর উপসংহার অনুযায়ী ইংল্যান্ডের জেতার সম্ভাবনা ইউরোপীয় রেফারির বেলা ৬৮ ভাগ। অন্য মহাদেশের রেফারি থাকলে শতকরা ৩৮ ভাগ।


আত্মঘাতী গোল দিয়ে শুরু ব্রাজিলের বিশ্বযুদ্ধ! নিজেদের জালে বল ঢুকিয়ে মার্সেলো। ছবি: এএফপি

আশ্চর্যের হল, একটা গবেষণার মধ্যেও তারকা প্লেয়ারের চোট-আঘাত ফ্যাক্টরকে বিবেচনার মধ্যে নেওয়া হয়নি। ম্যাচ চলাকালীন কোচের সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবা হয়নি। রেফারির লালকার্ড বা একটা পেনাল্টিও তো বিশ্বকাপের ভাগ্য ঘুরিয়ে দিতে পারে। ২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনালে জিদান মাঠে থেকে পেনাল্টি মারলে কে বলতে পারে, ফ্রান্স টাইব্রেকে জিতত না?

আর পেনাল্টি! আজকালকের মধ্যেই আর্জেন্তিনীয় রেডিওর হয়ে ধারাভাষ্য দিতে যাঁর ব্রাজিল পৌঁছনোর কথা, তাঁকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়। তিনি, দিয়েগো মারাদোনা, তো নব্বইয়ের বিশ্বকাপ ফাইনালে জার্মানিকে পেনাল্টি দেওয়া সেই রেফারিকে আজও খুঁজে চলেছেন!

আর একটা কথা। কোনও পূর্বাভাসই বলেনি, এ বারের বিশ্বকাপ ব্যাপারটাই যে ব্যতিক্রমী হবে। উদ্বোধনও যে পলিথিন জড়াতে হবে, উত্তেজিত জনতার দিকে কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে হবে! শুরু থেকেই যদি সমীক্ষার রিপোর্ট না মেলে, তাতে পরে আস্থা রাখার কোনও কারণ আছে?

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE