Advertisement
১১ মে ২০২৪

অন্ধকারে জঙ্গলের পথে ছুটে মুক্তি

তিন দিন ধরে অন্ধকার ঘরে আটক থাকার ফাঁকে ঠিক করেছিলেন, যে ভাবে হোক পালাবেন। ঘাবড়ে যাওয়া চোখ-মুখ দেখে গা ঢিলে দিয়েছিল অপহরণকারীরাও। তাই মাঝরাতে যখন শৌচকর্ম সারতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, পাহারাও ছিল তুলনায় কম।

ভানুবেন্দ্র গুছাইত

ভানুবেন্দ্র গুছাইত

বিপ্লব ভট্টাচার্য
পানাগড় শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:২০
Share: Save:

তিন দিন ধরে অন্ধকার ঘরে আটক থাকার ফাঁকে ঠিক করেছিলেন, যে ভাবে হোক পালাবেন। ঘাবড়ে যাওয়া চোখ-মুখ দেখে গা ঢিলে দিয়েছিল অপহরণকারীরাও। তাই মাঝরাতে যখন শৌচকর্ম সারতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, পাহারাও ছিল তুলনায় কম। সেই সুযোগে এক ছুট। পরে এক ট্রাকচালকের সহায়তায় পুলিশের কাছে। বিহারের বক্সারে দুষ্কৃতী-ডেরা থেকে পালিয়ে এসে এমন বিবরণই দিয়েছেন পানাগড়ের ওষুধ ব্যবসায়ী ভানুবেন্দ্র গুছাইত।

সোমবার রাতে দোকান বন্ধ করে পাঁচ কিলোমিটার দূরে বাঁকুড়ার সোনামুখীর লালবাবা চরের বাড়িতে ফেরার পথে উধাও হন বছর পঁচিশের ওই যুবক। বৃহস্পতিবার ওই ট্রাকচালক তাঁকে পৌঁছে দেন বক্সারের ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ ফাঁড়িতে। শুক্রবার রাতে তাঁকে ফেরায় বাঁকুড়া পুলিশ।

ভানুবেন্দ্রর বাবা লক্ষ্মণ গুছাইত হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। পানাগড় রেলপাড়ে তাঁদের একটি তিনতলা বাড়ি রয়েছে। একতলায় ওষুধের দোকান চালান ভানুবেন্দ্র। বাকিটা অনুষ্ঠানে ভাড়া দেওয়া হয়। লালবাবা চরে তাঁদের জমিও রয়েছে। ভানুবেন্দ্র জানান, প্রতিদিনই রাত ৯টা নাগাদ দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরেন। সোমবারও ফিরছিলেন। মাঝরাস্তায় একটি দাঁড়ানো গাড়ির পাশ থেকে এক জন হাত নেড়ে দাঁড়াতে বলে তাঁকে। মোটরবাইক থামাতেই বিপদ।

ভানুবেন্দ্রর কথায়, ‘‘সপাটে চড় মারল লোকটা। আমি পড়ে যেতেই কয়েকজন গাড়ি থেকে নেমে মুখে কালো কাপড় বেঁধে গাড়ির সিটের তলায় ঢুকিয়ে দিল। কাড়ল মোবাইল। ছটফট করলেই জুটছিল লাথি।’’ তিনি জানান, অপহরণকারীরা হিন্দি বা ভোজপুরিতে কথা বলছিল। এক জন বলছিল, ‘তিন-চার মাস ধরে নজরদারি করে কাজ হল’। দীর্ঘ যাত্রার পরে গাড়ি থামতে চোখ বাঁধা অবস্থায় একটি ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে।

পুলিশকে ভানুবেন্দ্র জানিয়েছেন, সেই রাতেই তাঁকে কিছুটা দূরে অন্য একটি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। মঙ্গলবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত কেটেছে সেখানেই। ঘরের দরজা দিনভর বন্ধ থাকত। শুধু খাবার দেওয়া আর রাতে জঙ্গলে তাঁকে শৌচকর্ম করাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য দরজা খোলা হতো। ভানুবেন্দ্র বলেন, ‘‘ওরা জনা পাঁচেক ছিল। আমাদের সম্পত্তি কত, কত টাকা দিতে পারব, সে সব জানতে চেয়েছে। মঙ্গল ও বুধবার রাতে জঙ্গলে নিয়ে যাওয়ার সময়ে চার জন করে পাহারায় ছিল। বৃহস্পতিবার ঠিক করি, পালাব।’’

যুবকের অনুমান, তাঁর শুকিয়ে যাওয়া চোখ-মুখ দেখে বোধহয় ‘শিকারের হাল’ সম্পর্কে নিশ্চিন্ত ছিল অপহরণকারীরা। তাই বৃহস্পতিবার রাতে জঙ্গলে নিয়ে যাওয়ার সময়ে পাহারায় ছিল মোটে এক জন। দরজার বাইরে পা রাখতেই মরিয়া ছুট দেন ভানুবেন্দ্র। তাঁর কথায়, ‘‘আছাড় খেলেও সঙ্গে সঙ্গে উঠে ফের দৌড়েছি। পিছনে যে ছিল, সে অন্ধকারে বেশিক্ষণ ধাওয়া করতে পারেনি। রাতভর জঙ্গলের এ দিক-ও দিক দৌড়ে ভোরে বড় রাস্তায় পৌঁছই। হাত দেখিয়ে ট্রাক থামাই।’’

ট্রাকচালকই প্রথম ভানুবেন্দ্রকে জানান, এলাকাটা বক্সার। তাঁর মোবাইল থেকে বাড়িতে ফোন করেন ভানুবেন্দ্র। ট্রাকচালক তাঁকে পুলিশ ফাঁড়িতে পৌঁছে দেন। পুলিশ ঘটনা শুনে তাঁকে নিয়ে তল্লাশিতে বেরোয়। খুঁজেখুঁজে ভানুবেন্দ্রর বর্ণনার সঙ্গে মেলে এমন একটি বাড়িতেও পৌঁছয়। কিন্তু সেখানে হাজির দু’জন মহিলা দাবি করেন, তাঁরা কিছু জানেন না।

বক্সারের পুলিশ সুপার উপেন্দ্রকুমার শর্মা জানান, এ ব্যাপারে যা বলার সোনামুখী থানা বলবে। সোনামুখী থানার বক্তব্য, ওই দুই মহিলাকে জেরা করা হয়েছে। তবে শনিবার রাত পর্যন্ত কেউ আটক বা গ্রেফতার হয়নি। ভানুবেন্দ্র বলেন, ‘‘মাসকয়েক আগে সোনার হার, লকেট পরে এক আত্মীয়ের বিয়েতে গিয়েছিলাম। আমাকে অপহরণ করার পরে দুষ্কৃতীরা জানতে চেয়েছে, ‘তোর হার-লকেট গেল কোথায়?’ বুঝতে পারছি না, পরিচিত কারও সূত্রে ওরা আমার খোঁজ পেল কি না।’’

ভানুবেন্দ্রর বাবা লক্ষ্মণবাবু বলেন, ‘‘মঙ্গলবার ছেলের মোবাইল থেকে ফোনে হিন্দিতে হুমকি দিয়েছিল কেউ এক জন। তার পর থেকে মোবাইলটা বন্ধ। তাই থানায় অপহরণের অভিযোগ করি।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘ও পালিয়ে এসেছে ঠিকই, কিন্তু ওরা আবার হামলা করবে কি না, সেই চিন্তায় রয়েছি।’’

(সহ-প্রতিবেদন: রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE