সজল সাহা
যাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হল, সে-ই কি না যোগ দিয়েছে অপহরণকারীদের দলে! আর ঘোড়ার মুখের এই খবর নিয়েই এই মুহূর্তে তোলপাড় এক সময়ে মাওবাদীদের ব্যস্ত করিডর লালগড়ের ঝিটকা গ্রাম।
ঝিটকা গ্রামের সজল সাহাকে মাওবাদীরা অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছে বলে মামলা রুজু করেছিল পুলিশ। তার পরে ছ’বছর আর খোঁজ ছিল না তাঁর। এখন শোনা যাচ্ছে, অপহৃত সজল মাওবাদী সদস্য হিসেবে ধরা পড়েছে ওড়িশায়। খোঁজখবর শুরু করেছে রাজ্য গোয়েন্দা শাখা (আইবি) ও লালগড় থানার পুলিশ।
কী করে এই খবর এল ঝিটকায়?
সজলদের পাশের বাড়ির এক মহিলা জানিয়েছেন, সম্প্রতি ওড়িশার বারিপদার কেশিপুরে তাঁর বাপের বাড়িতে গিয়ে একটি খবরের চ্যানেলে তিনি সজলের ছবি দেখছেন। ভীমুপুরের বাসিন্দা সুচিত্রা দাসের দাবি, ‘‘খবরে ন’জন মাওবাদীর গ্রেফতার হওয়ার কথা বলে ছবি দেখাচ্ছিল। তখন একটি ছবি দেখিয়ে বলা হয়— পশ্চিমবঙ্গের মাওবাদী সজল সাহা।’’ ওই মহিলার কথায়, ‘‘সাহাদের বাড়ি আমাদের বহু দিনের যাতায়াত। সজলের বিয়ে-বউভাত, ওর ছেলের মুখেভাত-জন্মদিন সব অনুষ্ঠানেই গিয়েছি। সজলকে চিনতে একটুও ভুল হয়নি।’’ সুচিত্রা জানাচ্ছেন— টিভি-র ছবিতে তিনি সজলের চাপদাড়ি দেখেছেন, যা আগে ছিল না।
সুচিত্রা দাসের দেওয়া এই সূত্র থেকেই সজলে ব্যাপারে ফের খোঁজ নিচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ ও গোয়েন্দারা। এই তল্লাটে মাওবাদীদের হাতে অপহৃত বহু মানুষের দেহ এখনও না-মিললেও গ্রামের মানুষ চাপা স্বরে জানিয়ে দেন— কোথায় তাদের খুন করে কোথায় দেহ পুঁতে বা জ্বালিয়ে দিয়েছিল মাওবাদীরা। সবাই হতদরিদ্র মানুষ। সজলের বেলায় কিন্তু এমন কোনও খবর নেই ছ’বছরেও। আবার ঝিটকার এই সাহা পরিবারের সঙ্গে রাজনীতিরও তেমন সংস্রব নেই। তাই প্রতিবেশী মহিলার দেওয়া খবরে আশার আলো দেখছেন সজলের স্বজনরা।
মেদিনীপুর থেকে লালগড়ের পথে দু’পাশে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার জুড়ে ঝিটকা জঙ্গল। সেই জঙ্গল শুরু হওয়ার ঠিক আগে এই ঝিটকা গ্রাম। বড় রাস্তার ওপর বিধানচন্দ্র সাহার পরিবার ধনী না-হলেও অভাবী নয়। মুদির দোকান ও সাইকেল সারাইয়ের কারবার রয়েছে প্রৌঢ় বিধানবাবুর, সঙ্গে বিঘে চারেক পাট্টার জমি। ছোট ছেলে উজ্জ্বল লরি চালান। বড় ছেলে সজল ছিলেন বাস কন্ডাকটর।
লালগড় আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে সশস্ত্র মাওবাদী স্কোয়াড। কথায় কথায় বন্ধ ডাকছে পুলিশি সন্ত্রাসবিরোধী জনসাধারণের কমিটি। সেই সময়ে ২০০৯-এর ২১ জুলাই অপহৃত হন সজল।
বিধান সাহা জানান, তখন কমিটির ডাকে লাগাতার বন্ধ চলছে। বেলা ১১টা নাগাদ বন্ধু সঞ্জয় দাসকে নিয়ে নিজের মোটর সাইকেলে চড়ে গোয়ালতোড়ে দিদির বাড়ির দিকে রওনা হন সজল। সঞ্জয়ের বাড়ি শালবনি এলাকার ঢ্যাংবহ্ড়া গ্রামে। পিচ রাস্তা এড়িয়ে ঝিটকা জঙ্গলের মধ্যে ক্যানালের পাড় ধরে যাচ্ছিলেন দু’জনে।
সজলের বাবার কথায়, ‘‘আমি বাড়ি ছিলাম না। পরে কৃষ্ণা, মানে আমার বড় বউমার কাছ থেকে শুনি— বেরিয়ে কিছু ক্ষণের মধ্যেই সজল প্লাস্টিকের ১২টা খালি জলের বোতল নিয়ে ফিরে আসে।’’ বিধানবাবু জানতে পারেন, কৃষ্ণাকে তাঁর স্বামী বলেছেন, জোড়া ব্রিজের কাছে মাওবাদীদের একটা সশস্ত্র দল ওঁদের পথ আটকায়। ওরা সঞ্জয়কে আটকে রেখে বাড়ি থেকে জল নিয়ে যেতে বলেছে। সজল জল নিয়ে গেলে তবে ওকে ছাড়া হবে। জঙ্গলের মধ্যে ক্যানালের উপরে ওই জোড়া ব্রিজ সেই সময়ে ছিল মাওবাদীদের শক্ত ঘাঁটি। এতটাই যে, পুলিশ ওখানে অভিযান চালানোর আগে দু’বার ভাবত।
বাড়ির কুয়ো থেকে সজল জল ভরে নিয়ে চলে যাওয়ার পর বিধানবাবু বেলা দেড়টায় ছেলের মোবাইলে ফোন করেন। বিধানবাবুর কথায়, ‘‘সজল বলল গোয়ালতোড়ে আছি। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে ফিরব। কিন্তু রাতেও ফিরছে না দেখে আবার ফোন করি। দেখি মোবাইল তখন বন্ধ। আমার মেয়েকে ফোন করে জানতে পারি— সজল ওর বাড়িতে যায়নি!’’ এক সপ্তাহ অপেক্ষা করার পর ২৮ জুলাই লালগড় থানায় নিখোঁজ ডায়েরি (জিডিই নম্বর ১০৪৯) করেন সজলের বাবা। তদন্তের পরে ৮ অগস্ট অপহরণের মামলা দায়ের (কেস নম্বর ১০৩/০৯) করে লালগড় থানার পুলিশ। তার পর থেকে সজল ও সঞ্জয়ের খোঁজ নেই। হদিস মেলেনি সজলের মোটর সাইকেল এবং দু’জনের মোবাইল ফোনেরও। চোখের জল থামছে না সজলের মা চন্দনা দেবীর। ছ’বছর আগে অপহৃত সজলের ছবি ভিন রাজ্যের টিভি চ্যানেলে দেখে চিনতে ভুল হয়নি তো? ভীমপুরে নিজের বাড়িতে বসে সুচিত্রা দাস বলেন, ‘‘আমি ছোট থেকে ওড়িয়া মাধ্যমে পড়ে উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ করেছি। ওড়িয়া ভাষায় সজলের খবর বুঝতে আমার ভুল হয়নি! তবে হ্যাঁ, সঞ্জয়কে সেই খবরে দেখায়নি।’’
সজলের বাবার ধারণা, তাঁর ছেলের মোটর সাইকেলটা মাওবাদীরা নিতে চেয়েছিল। সেটা তিনি ছাড়তে চাননি বলেই তিনি মাওবাদীদের কবল থেকে বেরোতে পারেননি। বিধানবাবুর কথায়, ‘‘মোটর সাইকেলটা সজলের খুব পছন্দের ছিল। কিস্তিতে কিস্তিতে ৪৫ হাজার টাকা শোধ করেছিল।’’ তবে সজলের বাবা এ কথাও বলছেন— নতুন ছেলেদের কী ভাবে মগজধোলাই করতে হয়, কী ভাবে বশ করে দলে টানতে হয়, সে সব কৌশল তো মাওবাদীদের ভালই জানা।
শূন্য চোখে চেয়ে থাকেন বিধান সাহা। আপন মনে বলে চলেন, ‘‘ছেলে কি সত্যিই মাওবাদী হয়ে গিয়েছে? কী জানি! দেখা হলে ওর কাছেই জানতে চাইব— কেন তুমি এটা করলে? বাড়িতে তোমার বউ রয়েছে, দু’টো বাচ্চা রয়েছে! তাদের কে দেখবে? জবাব ওকে দিতেই হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy