Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

‘অর্জুন’ যখন গ্রিকের নিশানা

বেশ কিছু দিন পরে দেখা হল হাওড়ার সঙ্গে। শহরটা আর আগের মতো নেই। জল-জঞ্জাল-আলো-রাস্তাঘাট পুর-পরিষেবার এই সব জরুরি শর্ত পূরণ না হওয়ার ফলে হাওড়ার নগরজীবনে বহু দিন ধরেই ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। কেন হয়নি, কে করেনি সে সব তর্কাতর্কির ঊর্ধ্বে যে সত্যটি নির্মম ভাবে সামনে এসেছিল, তা হল না-পাওয়া।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
হাওড়া শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:১৪
Share: Save:

বেশ কিছু দিন পরে দেখা হল হাওড়ার সঙ্গে। শহরটা আর আগের মতো নেই।

জল-জঞ্জাল-আলো-রাস্তাঘাট পুর-পরিষেবার এই সব জরুরি শর্ত পূরণ না হওয়ার ফলে হাওড়ার নগরজীবনে বহু দিন ধরেই ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। কেন হয়নি, কে করেনি সে সব তর্কাতর্কির ঊর্ধ্বে যে সত্যটি নির্মম ভাবে সামনে এসেছিল, তা হল না-পাওয়া। বিস্তীর্ণ এলাকায় পানীয় জলের হাহাকার, উপচানো ভ্যাটের সমারোহ, প্রায়ান্ধকার পথঘাট, খানাখন্দ সব মিলিয়ে হাওড়া শহর নাগরিকদের কাছে ক্রমেই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। বেশ কিছু দিন পরে হাওড়ায় গিয়ে বোঝা গেল, কোথাও একটা পরিবর্তন সত্যিই ঘটেছে।

ছবিটা স্টেশন চত্বর থেকেই স্পষ্ট। অন্যতম ব্যস্ত এই এলাকায় প্রতিদিন দশ-বারো লক্ষ মানুষের যাতায়াত। অগোছালো বিশৃঙ্খলা, ট্যাক্সি পেতে হয়রানি, ভাঙাচোরা রাস্তা জুড়ে হকারদের মৌরসিপাট্টা ছিল তাঁদের নিত্যসঙ্গী। হাওড়া শহরের জন্য

পুলিশ কমিশনারেট তৈরি হওয়ার পরে ক্রমে অবস্থার লক্ষণীয় উন্নতি হয়েছে। হকারদের দখলদারি নেই বললেই চলে। প্রশাসনের হস্তক্ষেপে শৃঙ্খলা এসেছে ট্যাক্সির লাইনে। রাস্তাঘাটেও মেরামতির প্রলেপ। জ্বলছে জোরালো আলো।

স্টেশন পেরিয়ে মুখরাম কানোরিয়া রোড, ডবসন রোড, অবনী দত্ত রোড, বেনারস রোড সবখানেই ঝকঝকে হয়ে ওঠার ছাপ। হাওড়াবাসীরা হয়তো ভুলেই গিয়েছিলেন, জঞ্জালের বড় বড় ভ্যাট সাফ করা যায়! পে-লোডার দিয়ে তুলে নেওয়া যায় রাস্তার ধারের দুর্গন্ধময় আবর্জনার স্তূপ! পিলখানা মোড়ে সকালবেলায় এমন দৃশ্য হাওড়ার বাসিন্দাদের অনেকেরই চোখে হয়তো স্বপ্নসম! সূর্য ডুবলে আলোয় ভাসবে হাওড়া শহর, সেটাও প্রায় বিস্মৃতিতে চলে যেতে বসেছিল।

হাওড়াবাসী যে যুবকের বয়স ত্রিশ বছর, তিনি জন্ম ইস্তক মহাকরণের মতো হাওড়া পুরভবনেও বামফ্রন্টকেই দেখে এসেছিলেন। গত ডিসেম্বরে পরিবর্তন দেখেছেন তিনি। সিপিএম-কে কার্যত পর্যুদস্ত করে ‘দিদি’র দল ভার নিয়েছে গঙ্গার পশ্চিম কূলে কলকাতার চেয়েও ঢের পুরনো এই শহরের। নিজের দলের মেয়র হাওড়া পুরসভায় বসার পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের ১১০ কোটি টাকা দিয়েছেন। সেই টাকায় উন্নয়নের নানা কাজ চলছে।

মহাকরণ ছেড়ে দিদি স্বয়ং তাঁর ক্ষমতার ভরকেন্দ্র হাওড়ার নবান্ন-তে সরিয়ে আনার পরে শহরের গুরুত্ব আরও কয়েক গুণ বেড়েছে। নবান্ন-কে ঘিরে উন্নততর হয়েছে এবং হচ্ছে তার সংলগ্ন পাড়াগুলি। হাওড়ার বুক চিরে চলে যাওয়া জি টি রোড— রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারে যাওয়ার পরে তারও স্বাস্থ্য ফিরে গিয়েছে। চিকন শরীরে সে এখন দ্রুতগামী।

হাওড়া লোকসভার অর্ধেকের বেশিটাই হাওড়া পুর-এলাকায়। সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের সবই এখন তৃণমূলের। তার মধ্যে চারটি হাওড়া পুরসভার অন্তর্গত। গত পুর-ভোটের নিরিখে সেখানে নিকটতম সিপিএমের চেয়ে লক্ষাধিক ভোটে এগিয়ে তৃণমূল। এ বার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বদলে যাওয়া হাওড়ার মুখচ্ছবি! হয়তো তাই আট মাস আগের উপ-নির্বাচনে বিজেপি না থাকা সত্ত্বেও মাত্র সাতাশ হাজারে জেতা তৃণমূল প্রার্থী প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় কেমন নিশ্চিন্ত ভাব।

মধ্য হাওড়ার সুরকি কল এলাকায় একটি ছোট্ট ছিমছাম বাড়ির উপরতলায় বাসা বেঁধেছেন বাঙুর অ্যাভিনিউ থেকে ডেলি-প্যাসেঞ্জারি করা এই সাংসদ-প্রার্থী। সাদা রং করা বাড়ির বাইরের দেওয়ালে আঁকা প্রসূনের বিশাল প্রতিকৃতি নেমপ্লেট ছাড়াই জানান দেয়, এখানেই তাঁর খোঁজ মিলবে! তাপপ্রবাহের দুপুরে বড় শীতল তাঁর বিশ্রাম কক্ষ।

সচরাচর মিডিয়ার ধরাছোঁয়ায় থাকেন না, এমন একটি ‘অপবাদ’ সাংসদ প্রসূনের সঙ্গী। আবার কোনও ক্রমে ধরে ফেলতে পারলে পরম সৌহার্দ্যে তাঁর কথা ফুরোয় না, এটাও ঘটনা। স্নিগ্ধ আবহে বসে তিনি বলতে লাগলেন তাঁর অবশ্যম্ভাবী জয়ের কার্যকারণ: “প্রথম বার আমি ছিলাম শুধুই দিদির প্রার্থী, অর্জুন পুরস্কার পাওয়া ফুটবলার। এ বার তো সাংসদের কাজ দিয়ে আমারও একটা অন্য পরিচিতি হল। এখন আমি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেও লোকের সামনে দাঁড়াতে পারি। পুরসভার কাজের সুফল তো আছেই। আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল, মোহনবাগান! দিকে দিকে লোক বলছে, মোহনবাগানকে বাঁচান, ভোট আপনার।” তা হলে মোহনবাগানকে ‘বাঁচানোর’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে তৃণমূল প্রার্থীকে ভোট চাইতে হচ্ছে? “আসলে হাওড়া তো মোহনবাগানের জায়গা, আমিও মোহনবাগানের ছেলে। তাই আর কী!” লাজুক জবাব তাঁর।

গত বার বিজেপি ছিল না। এ বার মোদী-রব। তার উপরে হাওড়ার একটি বড় অংশের ভোটার অবাঙালি ব্যবসাদার। দুপুরের তপ্ত হাওয়ায় কিংবা সন্ধ্যার মন্দ বাতাসে পদ্মের রেণু উড়ছে না বললে সত্যের অপলাপ হবে। আন্তরিক আলাপে জোড়া ফুলের লোকজনও এটা মানেন। যেমন মানেন অবনী দত্ত রোডের চায়ের দোকানের আড্ডায় জড়ো হওয়া মুখগুলি। হাওড়ায় তৃণমূলের ‘মাহল’ স্বীকার করে নিয়েও তাঁরা ঢোক গিলে বলছেন, “ইস বার তো বিজেপি ভি...।”

এই অসমাপ্ত বাক্যটাই অনিশ্চয়তার মূল। কে কার ভাত কতটা খাবে, নাকি মাঝখান থেকে কোনও নেপো দই মারবে সেটা তৃণমূল, বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস কারওরই আসলে জানা নেই। যে যার নিজের মতো করে হিসেব অথবা আবেগের আশ্রয়প্রার্থী।

প্রসূনের হিসেবের অঙ্ক বলছে,“এখানে সরকার, পুরসভা সবই তো তৃণমূলের। ব্যবসা করতে হলে তৃণমূল ছাড়া গতি নেই। যাঁরা বোঝার, তাঁরা এটা বুঝেছেন। কেউ অত বোকা নন।”

অতএব, চল পান্সি বেলঘরিয়া! চারটের রোড শো-য় পৌঁছতে প্রসূনের সাড়ে ছ’টা বেজে যায়। তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা ফ্ল্যাগ-ফেস্টুন-ম্যাটাডর সাজিয়ে বসে থাকেন। আন্দুল রোড ধরে তাঁদের দীর্ঘ মিছিল শুরু হলে যানজটও দীর্ঘ হয়।

তবে ‘দিদি’র নামে কম্পিত নয় গ্রিকের হৃদয়! পঞ্চাননতলায় দলের জেলা দফতরে বসে বিজেপি প্রার্থী, অভিনেতা জর্জ বেকার জানিয়ে দেন, “প্রসূূনবাবু তো প্রতিনিধি মাত্র! আমি হারাতে এসেছি দিদিকে। তিনি আসল। তিন বছরের মিসরুল! শি হ্যাজ নো রাইট টু বি ইন পাওয়ার। লোকসভা ভোটে হাওড়ার মানুষ বিজেপি-কে জিতিয়ে সেই কথাটাই বলবে। দিস উইল বি দ্য বিগিনিং অফ হার ফল। হাওড়া থেকেই সেই পতনের শুরু হবে।”

এক সময়ে মমতার ‘কাছের লোক’ ছিলেন জর্জ। সে দিনের মমতা অবশ্য আজকের এই মমতা নন। জর্জ বেকারও তখন কংগ্রেসের বৃত্তে ঘুরতেন। জর্জের নিউ আলিপুরের বাড়িতে মমতার যাতায়াত ছিল বলেও দাবি করলেন তাঁর স্ত্রী অর্পিতা। “কিন্তু এক বার ভেবে দেখুন, এত শিল্পীকে এত সম্মান দেওয়া হল। আমার নামটা এক বার ওঁর মনেও পড়ল না!” ক্ষোভের আগুন জর্জের গলায়। তবে কি সেই ক্ষোভ থেকেই তিনি বিজেপি-র প্রার্থী হলেন? জর্জ বললেন “জন্মসূত্রে ভারতীয় হলেও আমার শরীরে গ্রিক রক্ত। আলেকজান্ডার! শুনে রাখুন, গ্রিকরা কারও কাছে করুণা চেয়ে মাথা নত করে না। যুদ্ধে জয়ী হলে সেই গৌরব সকলের মধ্যে ভাগ করে দেয়।”

আর জয় না এলে?

জর্জ বেকার একটু থামলেন এবং বললেন, “দুঃখ হলে গ্রিকরা একা একা কাঁদে। সবার চোখের আড়ালে। যাতে কেউ সেই কান্না দেখতে না পায়!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

debasish bhattacharjya howrah vote
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE