হাসপাতালে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকা। আর দিনের শেষে হতাশ হয়ে বাড়ি ফেরা। গত ছ’মাস এমনই নিষ্ফলা কাটছে সাড়ে তিন বছরের রজব শেখের পরিবারের। বহরমপুরের খাগড়ার বাসিন্দা রজব জন্ম থেকেই হার্টের জটিল অসুখে আক্রান্ত। একটা অস্ত্রোপচার তার জীবনটাই বদলে দিতে পারে। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, রাজ্যের একাধিক বেসরকারি ও সরকারি হাসপাতালে নিখরচায় তা করানোর ব্যবস্থাও রয়েছে। কিন্তু গত ছ’মাস সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে গিয়ে তার বাবা-মাকে একটাই কথা শুনতে হয়েছে, ‘এখন কিছু হবে না। পরে যোগাযোগ করুন।’
রজব একা নয়। গোটা রাজ্যে এই মুহূর্তে এমন কয়েক হাজার শিশু অস্ত্রোপচারের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রতীক্ষায় থেকে থেকে অবস্থার গুরুতর অবনতি হচ্ছে বহু শিশুর। এক কথায়, শুরু হওয়ার আড়াই বছরের মধ্যেই থমকে যেতে বসেছে মুখ্যমন্ত্রীর সাধের ‘শিশুসাথী’ প্রকল্প।
সরকারের দাবি, তাদের টাকার কোনও অভাব নেই। অথচ হাসপাতালগুলির অভিযোগ, মাসের পর মাস তাদের বিল মেটানো হচ্ছে না। ফলে বিভিন্ন হাসপাতালেই শিশু হৃদরোগীদের অস্ত্রোপচার নিয়ে নানা টালবাহানা চলছে। ইতিমধ্যেই এ নিয়ে অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়েছে স্বাস্থ্য ভবনে। বসেছে দফায় দফায় বৈঠকও। পরিস্থিতি এমনই যে গত সপ্তাহে স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সমস্ত পক্ষকে ডেকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। যে ভাবেই হোক চলতি মাসেই এই সমস্যা মিটিয়ে ‘শিশুসাথী’ যাতে ফের নিজের ছন্দে ফিরতে পারে তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। যদিও তা আদতে কতটা ফলপ্রসূ হবে সে নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরেই।
২০১৩ সালের অগস্টে এ রাজ্যে শিশুসাথী প্রকল্পের উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যে শিশুদের হার্টে এমন কোনও সমস্যা রয়েছে যাদের অস্ত্রোপচার প্রয়োজন, তাদের নিখরচায় অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা হয় এই প্রকল্পে। সরকারি স্তরে এসএসকেএম এবং চারটি বেসরকারি হাসপাতালকে এই অস্ত্রোপচারের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, হার্টের অস্ত্রোপচারের জন্য শিশুরা গেলে তাদের নিখরচায় অস্ত্রোপচার করবে ওই হাসপাতালগুলি। পরিবর্তে তাদের বিল মেটাবে রাজ্য সরকার।
জননী সুরক্ষা যোজনা-র মতো এই প্রকল্পটিতেও টাকা আসে মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল থেকে, তা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী এই রাজ্যে ওই প্রকল্পটিকে রাজ্যের সাফল্যের তালিকাতেই রেখে এসেছেন বরাবর। স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন, নিয়ম অনুযায়ী, শিশুদের হার্টের অস্ত্রোপচারের ৭৫ শতাংশ টাকা দেওয়ার কথা কেন্দ্রের। বাকি ২৫ শতাংশ দেওয়ার কথা রাজ্যের। কিন্তু এ রাজ্যে শুরু থেকেই চুক্তিবদ্ধ হাসপাতালগুলিকে ২৫ শতাংশ ছাড়ে অস্ত্রোপচার করার কথা বলা হয়, যাতে রাজ্যের তরফে কোনও খরচই করতে না হয়। পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলি যেহেতু প্রচুর সংখ্যক রোগী পাবে, তাই তাদেরও মুনাফার দিকে কোনও ঘাটতি হবে না বলেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন স্বাস্থ্যকর্তারা।
চুক্তি হয়েছিল, অস্ত্রোপচারের ৩০ দিনের মধ্যে বিল মিটিয়ে দেওয়া হবে। বাস্তবে কী হচ্ছে? এক হাসপাতালের কর্তা বলেন, ‘‘ছ’মাস-আট মাস, কোনও কোনও ক্ষেত্রে এক বছরও পেরিয়ে যাচ্ছে। শিশুদের হার্টের অস্ত্রোপচার করার জন্য পৃথক পরিকাঠামো তৈরি করতে হয়েছে। একাধিক ডাক্তার নিয়োগ করতে হয়েছে। মাসের পর মাস টাকা না পেলে সেই পরিকাঠামো কী ভাবে বজায় রাখা যাবে সেটাই আমরা বুঝতে পারছি না। সরকারি প্রকল্পের জন্য তো এ বার আমরা ফতুর হয়ে যাব।’’
স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর দাবি, ‘‘টাকার কোনও অভাব নেই। বিল নিয়ে কিছু সমস্যা চলছিল। সেটা দ্রুত মিটিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। বিলের নতুন ফরম্যাট চালু হচ্ছে। যত দ্রুত সম্ভব অন লাইন বিলিং পরিষেবা চালু করে দেওয়া হবে। তা হলে আর দেরি হবে না কোনও কিছুতেই।’’
প্রশ্ন হল, সমস্ত টাকা যদি কেন্দ্রের কাছ থেকেই পাওয়া যাচ্ছে, তা হলে সেই টাকা হাসপাতালগুলিকে সময়মতো মেটানো হচ্ছে না কেন?
স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে খবর, লাল ফিতের এক একটি ফাঁস ছাড়াতেই অনেকটা সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। বিল পেশ করার পর তা অনুমোদন হয়ে চেক পাঠানো পর্যন্ত পর পর ধাপগুলোতেই অনেকটা সময় লেগে যাচ্ছে। কোনও প্রকল্পকে গতি দিতে যে সদিচ্ছা প্রয়োজন, এ ক্ষেত্রে বহু সময়েই তার অভাব দেখা যাচ্ছে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগী হাসপাতালগুলির কর্তারা। তাঁদের কারও ১০ কোটি, কারও ১২ কোটি করে বকেয়া রয়েছে।
শুধু বেসরকারি নয়, অস্ত্রোপচারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে গিয়েছে এই অস্ত্রোপচারের জন্য নির্ধারিত একমাত্র সরকারি হাসপাতাল এসএসকেএম-এও। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গিয়েছে, এক একটি শিশুর অস্ত্রোপচারের জন্য অনুমোদন আদায় করতে যে সময় লাগছে, তাতে বীতশ্রদ্ধ ডাক্তার এবং হাসপাতাল কর্তা— দু’পক্ষই। অনেকেই বলছেন, বিপুল কাজের চাপের মধ্যে এই কাজে অনর্থক এতটা বাড়তি সময় দেওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এসএসকেএম-এর এক কর্তার কথায়, ‘‘যে বিষয়ে ছাড়পত্র পেতে বড়জোর ২৪ ঘণ্টা লাগার কথা, মাস কাবার করেও তা পাওয়া যাচ্ছে না। মুখ্যমন্ত্রী তো নিজেই বলেছিলেন, এটা তাঁর স্বপ্নের প্রকল্প। তা হলে সেই প্রকল্প ঠিকঠাক চলছে কি না সে ব্যাপারে তাঁর বা তাঁর দফতরের কর্তাদের নজরদারি নেই কেন?’’
‘শিশুসাথী’র দুরবস্থার কারণ খুঁজতে গিয়ে অবশ্য জানা গিয়েছে, গলদটা গোড়াতেই। শুধু বিল নয়, প্রত্যেকটি পদক্ষেপে এই টালবাহানার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে খবর, প্রকল্পটির দেখভালের জন্য আলাদা কোনও ইউনিট নেই। ধরা যাক, যাঁর ওপরে রক্তাল্পতা কমাতে শিশুদের আয়রন ক্যাপসুল খাওয়ানোর দায়িত্ব, তাঁকেই বিলের প্রাথমিক খসড়া দেখতে হয়। কিংবা পরিবারকল্যাণ বিভাগের হাজারো কাজে এমনিতেই যাঁর নাজেহাল দশা, তাঁকে আবার ‘শিশুসাথী’তেও মাথা ঘামাতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফল যা হওয়ার তাই। এক সঙ্গে অনেক কিছু করতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে বহু কাজই। কেন এমন একটা গুরুত্বর্ণ প্রকল্পে পৃথক কর্মী রাখা হবে না সে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরেই।
যত দিন না সামগ্রিক ভাবে এই সমস্যাগুলির সমাধান হচ্ছে, তত দিন রজব আলিদের প্রাণে বাঁচাটা যেমন অনিশ্চিত হয়ে থাকবে, তেমনই চুক্তিবদ্ধ হাসপাতালগুলিও এ থেকে নিষ্কৃতির রাস্তা খুঁজবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সরকারি শিশু চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ।
‘শিশুসাথী’র খুঁটিনাটি
• সরকারি স্কুলগুলিতে শিশু হৃদরোগীর ‘স্ক্রিনিং’
• ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত হার্টের যে কোনও অস্ত্রোপচার
• সমস্ত খরচ বহন করবে রাজ্য সরকার
•পারিবারিক আয় এ ক্ষেত্রে বিচার্য নয়
•একটি সরকারি এবং চারটি বেসরকারি হাসপাতালে আপাতত অস্ত্রোপচার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy