Advertisement
১১ মে ২০২৪
আমার পড়শি

আপেলে মনে পড়ে নিউটন, চম্পাকে

এমন ভাবে বেঁচেছি, যেন বাঁচতেই হত। আমাদের সীমান্ত গ্রামে বড়রা বলত, ‘‘এত দস্যি হইছে পোলাপানগুলান!’’ দস্যি তো হবই। দরিদ্র ভুবনে সবই অল্প অল্প। শুধু ভালবাসাটা অফুরান। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের অভাব সহ্য হয়ে যায় অভ্যাসে, কিন্তু ভালবাসাহীন নিঃসঙ্গতার কথা ভাবাই যায় না।

বিভাস রায়চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:০৮
Share: Save:

এমন ভাবে বেঁচেছি, যেন বাঁচতেই হত। আমাদের সীমান্ত গ্রামে বড়রা বলত, ‘‘এত দস্যি হইছে পোলাপানগুলান!’’

দস্যি তো হবই। দরিদ্র ভুবনে সবই অল্প অল্প। শুধু ভালবাসাটা অফুরান। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের অভাব সহ্য হয়ে যায় অভ্যাসে, কিন্তু ভালবাসাহীন নিঃসঙ্গতার কথা ভাবাই যায় না। যেখানে শূন্যতা, সেখানেই ভালবাসা ঝন্‌ন্‌ন্ করে বাজে।

আজ বুঝি, প্রথমাবধি বিশ্বাস করতাম একতরফা ভালবাসায়। মানে, আমি ভালবাসি... ভালবাসি বলেই মেতে থাকি... দাঁড়িপাল্লায় মেপে দেখতে যাই না, পড়শি আমায় ভালবাসে কি না! শাসনবেষ্টিত ঘরের বাইরেই যে ভুবনের অধিকাংশ পড়ে আছে, তা অস্পষ্ট টের পেয়ে সেই বয়সেই ছুট... ছুট... ছুট...।

কত পড়শি যে চারপাশে!

বি-রা-ট আকাশ মুঠোয় পেয়ে যেতাম। একচিলতে ইছামতী ফুরোত না কিছুতেই। ভ্যারেন্ডা-ঢোলকলমি-কালকাসুন্দির ঝোপ-জঙ্গলকেই মনে হত অরণ্য। এক দুপুরে প্রবল জ্বরের মধ্যে মনে হল হারান মাঝির কাছে যাই। সবার চোখ এড়িয়ে দৌড়লাম। হারান মাঝি কোনও কোনও বিকেলে আমাদের ছোট্ট নৌকোয় তুলে ঘুরিয়ে আনত। লোকগান গাইত সুন্দর। নদীর ধারে তার একলা থাকার মাটির বাড়ি।

জ্বরের মধ্যে কত রকম হয়। হারান মাঝি কেন আমাকে ডাকছিল, জানি না। কিন্তু পৌঁছে দেখি, সে বাড়িতে নেই। কোনও কষ্ট হল? নাঃ! বরং মন ঘুরে গেল নদীর জলে। দে ঝাঁপ! ভালবাসা একতরফা বলেই বিরহের বদলে এল আরও জ্বর। সেই জ্বর বোধহয় এ-জীবনে আর সারল না।

তপনের জন্মদিনে পায়েস খেয়ে এলাম কোন ছোটবেলায়! কয়েক বছর পরে, স্কুল পালটে গিয়েছে তত দিনে, শুনলাম হঠাৎ অসুখে মারা গিয়েছে সে। কষ্ট তো পাওয়ারই কথা। কষ্ট কিন্তু পাই না। ভালবাসার জাদুকর বলে, ‘‘ওই তো তপন... সে তোমার ছেলেবেলা।’’ আনন্দাশ্রু চোখ ঝাপসা করে দেয়। আবছা টলটলে দেখতে পাই— বাবুইপাখির বাসা কুড়িয়ে আমায় দিতে ছুটে আসছে তপন।

বড়বেলায় এসে বুঝি, তীব্র ভাবে বুঝি, ভালবাসার ধরনই এই। সে কেবল দিতে চায়— নে... নে... নে...! জীবন উপচে যায়। এইটুকুনি জীবনে কত আর নেব?

পথে চলতে মাঝে-মাঝেই দেখি, সেই সব জ্বরের খোলসগুলো পড়ে আছে ইতিউতি। একটার মধ্যে ঢুকে পড়লেই হল। সময় বেজে উঠবে। হারানো সময়। এমন একটা খোলসের মধ্যে ঢুকে পড়তেই শুনতে পাই, মাটির বারান্দায় ঝুঁকে পড়ে মা বমি করছে আর ভুতুড়ে গলায় ডাকছে— ‘বাপি...বাপি...’। অন্তরাত্মা কেঁপে যায় সেই ডাকে।

বাবা ছিলেন স্বপ্নবাজ মানুষ। দারিদ্রকে তেমন আমল দিতেন না। আমাদের খাওয়া-পরায় কষ্ট ছিল খুব। মা-কে সামলাতে হত সেই বাস্তব। ফলে মা ছিল দিশেহারা, রুক্ষ, মারকুটে। স্নেহার্দ্র কণ্ঠস্বর হারিয়ে গিয়েছিল। ছোটবেলায় আমরা মা-কে ভালবাসতাম না। অপেক্ষা করতাম দুর্লভ বাবার জন্য।

কিন্তু এটাই জীবনের মজা যে, কোনও প্রান্তরই ভালবাসাহীন হয় না। মা দেখানেপনা থেকে অনেক দূরে, সত্তার গভীরে যে জল, তা দিয়ে ছুঁয়ে থাকত। আমিও প্রতিটি নির্জন কান্নায় মা-কে টের পেয়েছি প্রবল।

যৌবনের শুরুতেই কবিতার অন্ধ স্বপ্নে আক্রান্ত হয়ে মা-বাবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছি। বাবা তখন আমায় পছন্দই করতেন না। কারণ তাঁরা ফুরিয়ে যাচ্ছিলেন। আর, আমি পরিবারের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করছিলাম। আমাকে তখন লেখায় খেয়েছে। অবুঝ অভিমান হত। একটুতেই ঝরে পড়তাম।

আমার মেরুদণ্ড শক্ত হল মেয়ে জন্মানোর পরে। প্রসূতিসদনের বাইরে ভোরবেলা এক বার কি দেখলাম ভাঙাচোরা বাবাকে? হ্যাঁ, বাবাই তো! একটা গল্পও লিখেছিলাম এই নিয়ে। ত বাবা বলল, ‘‘এ বার বুঝবি।’’

দূরত্বে দাঁড়িয়ে অভিমানে নীল হতে-হতে আমি বাবার অন্তরটাকে পেলাম। আর মা? বাবার প্রয়াণের পরে আমার রুক্ষ, রুগ্ণ মা বাবার মলিন ছবিতে মেলে ধরে আছে একটা পুরনো ছাতা। বাবাকে খাবার দিচ্ছে নিজের বাড়ির কলপাড়ে। একটা কাক এসে খাচ্ছে। আর মা বলছে, ‘‘ওই দ্যাখ, তোর বাবা। সারা জীবন হাড়মাস জ্বালিয়ে খেয়েছে। এখনও ছাড়ছে না। তুই চলে যা। তোর পাকা বাড়িতে আমি যাব না।’’

মায়ের প্রত্যাখ্যানের থেকে বড় হয়ে ওঠে মায়ের অতল। মা হয়ে ওঠে আমার স্নান।

আমার ঘরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অনেক বই। এক-এক রাতে অনুভব করি, বইগুলো যেন তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তারা কিছু বলতে চায়। যেমন আমিও চেয়ে থাকি জগতের দিকে। জগৎ তো আসলে পড়শিদের সমবেত স্বর। আমার-তোমার একার নয়, তা যেন সমষ্টিতে গিয়ে মেশে। ভালবাসার কোনও এ পাড়া-ও পাড়া তো নেই, আছে নিরন্তর বয়ে যাওয়া। যে-ঠোঁটটি এগিয়ে এল, তাও তোমার সম্পত্তি নয়, তা আসলে জগতের সৃজন-আকাঙ্ক্ষা জেনো।

এই কথাটি, এইমাত্র লেখা এই কথাটি, সাদা কাগজে ফুটে ওঠার মুহূর্তে কত কী যে হল! এক ঝলক হাওয়ায় দুলে উঠল সামনের গাছ, ছোট্ট হলুদ প্রজাপতি উড়ল ফুলের দিকে, বসন্তবৌরি ডানা মেলল, রোদ্দুর এসে পড়ল ছাদের কার্নিসে।

আর... একটা অনুতাপও মনে পড়ল আমার।

প্রাইমারি স্কুলে তখন ছেলেদের দল, মেয়েদের দলে আড়ি-পর্ব চলছে। ক’দিনে আবার ভাবসাব হয়ে গেল সকলের। শুধু কথা বন্ধ আমার আর চম্পা মৌলিকের। চম্পা বড়লোকের মেয়ে। ফুটফুটেও। এক বাহাদুর অবিরাম ৭২ ঘণ্টা সাইকেল চালাচ্ছে কলেজ মাঠে। তাকে স্কুলের পক্ষ থেকে ফুলের মালা দেওয়া হবে। ক্লাস ফোরের ফার্স্টবয় হিসেবে আমি তুলে দেব। কিন্তু শেষ মুহূর্তে স্যার বললেন, ‘‘চম্পা দিক। আমাদের ফার্স্টবয়ের জামা ছেঁড়া।’’

লজ্জায় মরে গেলাম। হাততালির মধ্যে চম্পা পরাল ফুলের মালা। সেই থেকে হীনমন্যতায় ভুগতাম বোধহয়। চম্পাকে এড়িয়ে যেতাম। চম্পা করল এক কাণ্ড। স্কুলে এসে সবার সামনে আমার দিকে এগিয়ে দিল একটা লাল আপেল। বলল— ‘‘নে, এ বার ভাব কিন্তু আমাদের।’’

আমি গোঁয়ারের মতো চুপ করে রইলাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চম্পা ফিরে গেল নিজের আসনে। স্কুল শেষে ফিরছি, দেখি ছোট ভাইয়ের হাতে সেই লাল আপেল। জিগ্যেস করলাম, ‘‘কোথা থেকে পেলি রে?’’ ভাই বলল, ‘‘চম্পাদি দিয়েছে।’’

শোনা মাত্র আপেলটা কেড়ে নিয়ে গায়ের জোরে ছুড়লাম শূন্যে। আপেল কিছু দূর উঠে মাধ্যাকর্ষণের টানে নীচে এসে পড়ল দিঘির জলে। বিজয়ীর গর্বে কিছু দূর হেঁটেছিলাম। তার পরেই ঘিরে ধরল কী এক মনখারাপ। কেউ জানল না। ভাই না, বন্ধুরা না। চম্পাও না। স্কুল পালটে গেল কয়েক মাস পরে। হাইস্কুলে ভর্তি হলাম। চম্পাদের অন্য স্কুল। আর একটু বড় হয়ে শুনি, ওরা অন্য কোথাও চলে গিয়েছে।

আজ অবধি চম্পার খোঁজ নেই। তবে কি সে হারিয়ে গেল আমার জীবন থেকে? ভালবাসা বলে, ‘‘কষ্ট তো পাও। ওটাই চম্পা।’’

কী জানি! যে-কোনও আপেল দেখলেই আমার মনে পড়ে নিউটন আর চম্পা মৌলিককে। ভাইকে। প্রাইমারি স্কুলের রাস্তাকেও।

জীবনকে জাদু করে রেখেছে বহুরূপী পড়শির ভালবাসা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE