অগ্রভাগে জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)। অনেকটা বড় শরিকের ভূমিকায়। কিন্তু কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা জেনেছেন, বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণের সূত্রে হদিস মেলা জঙ্গি চক্রটি আসলে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের কয়েকটি জঙ্গি গোষ্ঠী ও কট্টর মৌলবাদী সংগঠনের সমষ্টি। গোয়েন্দারা দাবি করছেন, আল কায়দার নির্দেশ ও পরিকল্পনা মাফিকই হয়েছে এই মেলবন্ধন।
গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, খাগড়াগড় কাণ্ডে ধৃতদের কয়েক জনকে জেরা করে এবং তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া নথিপত্র ঘেঁটে এমনটাই জানা গিয়েছে। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, আল কায়দার লক্ষ্য ছিল সোমালিয়ায় সক্রিয় আল শাবাব কিংবা নাইজেরিয়া ও ক্যামেরুনে জঙ্গি হামলায় অভিযুক্ত বোকো হারাম-এর মতো কোনও জঙ্গি সংগঠন গড়ে তোলা। যেটি পশ্চিমবঙ্গ ও অসমকে কেন্দ্র করে পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারত এবং বাংলাদেশে নাশকতা চালাবে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের দাবি অনুযায়ী, সব ভেদাভেদ ভুলে একটিই জেহাদি সংগঠন গড়ে তোলার নির্দেশ ছিল আল কায়দা নেতৃত্বের, যেটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও অসমের পাশাপাশি পড়শি বাংলাদেশ ও মায়ানমারেও নাশকতা চালাবে।
সেই প্রস্তাবিত সংগঠনের নাম কী? জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র কাছে বিষয়টি এখনও স্পষ্ট না হলেও সাজিদ, জিয়াউল, শাহনুর, হাকিমদের কাছ থেকে এবং বিভিন্ন সন্দেহভাজন জঙ্গি ডেরায় উদ্ধার হওয়া নথিপত্রে একটা নাম বার বার পাওয়া গিয়েছে। কায়দা-এ-হিন্দ। আরবি শব্দবন্ধ আল কায়দা-র বাংলা প্রতিশব্দ ‘ঘাঁটি’। সে ক্ষেত্রে নতুন এই নামে হিন্দুস্তানের ঘাঁটি বোঝানো হচ্ছে কি না, সেটাই খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।
তাঁদের হিসেবে, গত পাঁচ বছরে ওই চক্রটি পশ্চিমবঙ্গে বসে অন্তত দু’হাজার আইইডি (ইমপ্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) তৈরি করেছে। কিন্তু বেলডাঙার বরুয়া মোড়ের নিকটবর্তী কারখানা ও খাগড়াগড়ের গবেষণাগার থেকে বেরিয়ে সেগুলি কোথায় গিয়েছে, এখন সেগুলি কোথায় মজুত রাখা হয়েছে সেই ব্যাপারে গোয়েন্দারা এখনও অন্ধকারে। গোয়েন্দারা জেনেছেন, কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ ও অসমের কয়েকটি শপিং মল ও বড় হোটেলে বিস্ফোরণ ঘটাতে নির্দেশ দিয়েছিল ওসামা বিন লাদেনের সংগঠন, এখন যার নেতৃত্বে আয়মান আল-জাওয়াহিরি। ঢাকায় ধরা পড়া কিছু জঙ্গি বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের কাছে এমন দাবিও করেছেন, প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে জাওয়াহিরি এক বার চট্টগ্রামে সফর করে গিয়েছেন। সেখানে একটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনি বাংলাদেশের নানা শহর ও মায়ানমার থেকে আসা জঙ্গিদের সামনে বক্তৃতাও দিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের কয়েকটি সংগঠনের প্রতিনিধিরাও জাওয়াহিরির এই সভায় হাজির ছিলেন।
খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্তকারী এক অফিসারের বক্তব্য, ভারতে নানা নাশকতা ও জঙ্গি হামলায় যত প্রাণহানি ঘটেছে, খাগড়াগড়ে সেই তুলনায় কিছুই হয়নি। তবে তাঁর কথায়, “যদি চক্রান্তের মাত্রা ও ব্যাপকতা ধরা হয়, তা হলে ২৬/১১-র জঙ্গি হানার পরেই খাগড়াগড়ের নাম আসা উচিত। আমরা এখনও পেঁয়াজের খোসা ছাড়িয়েই চলেছি। মূল জায়গায় কবে পৌঁছনো যাবে, কে জানে!”
এ বছর সেপ্টেম্বরে জাওয়াহিরি ঘোষণা করেন, বহু চেষ্টার পর ভারতীয় উপমহাদেশে আল কায়দার শাখা গড়ে তোলা গিয়েছে। ঘটনাচক্রে তার এক মাসের মধ্যেই খাগড়াগড়ে আইইডি তৈরি হওয়ার সময়ে ঘটা বিস্ফোরণের সূত্র ধরে আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্ক-এর হদিস মেলে।
গত ২৪ অক্টোবর এনআইএ একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, খাগড়াগড় কাণ্ডে অভিযুক্ত ও তাদের সহযোগীরা জেএমবি-র সদস্য এবং পশ্চিমবঙ্গে আইইডি তৈরি করে বাংলাদেশেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তা হলে এনআইএ কি এখন সেই বক্তব্য থেকে সরে আসছে?
এনআইএ-র এক শীর্ষকর্তার কথায়, “একেবারেই না। জেএমবি-র ভূমিকাই তো এর মধ্যে প্রধান। বাংলাদেশে নাশকতা ঘটানোর জন্য ইতিমধ্যেই বহু আইইডি সীমান্ত টপকে ও দিকে চলে গিয়েছে।” ওই অফিসার বলেন, “এটা অনেকটা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জোট বা ফ্রন্টের মতো। একটি রাজনৈতিক দল যেখানে বড় শরিকের ভূমিকায়। এ ক্ষেত্রে জেএমবি।”
এনআইএ সূত্রের খবর, ২০০৭ থেকে ২০১২ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে ওই জঙ্গি নেটওয়ার্কের নেতৃত্বে ছিল জেএমবি-র চাঁই হাতকাটা নাসিরুল্লা ওরফে সোহেল মাহফুজ। পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গি মডিউল বা গোষ্ঠীর সদস্যদের হাতেকলমে আইইডি তৈরির শিক্ষা দিয়েছিল নাসিরুল্লা। তবে নাসিরুল্লা পাঁচ বছর দায়িত্বে থাকলেও তাকে ‘আমির’ বলে কখনও ঘোষণা করা হয়নি। কিন্তু ২০১২-তে নাসিরুল্লাকে শুধু দায়িত্ব থেকে সরানোই হল না, সাজিদ ওরফে মাসুদ রানাকে আমির বলে ঘোষণা করা হল। বর্তমানে বাংলাদেশের জেলে, বন্দি জেএমবি-র মাথা সাইদুর রহমানের নির্দেশেই এমনটা হয়েছিল।
কিন্তু নেতৃত্বে কেন এই পরিবর্তন?
এনআইএ-র দাবি, সাজিদ এক জন সুবক্তা। প্রচুর লোকশ্রুতি ওর জানা। অন্যকে সহজেই প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। সে ধৈর্যশীল, বুদ্ধিমান, সংগঠক ও তাত্ত্বিক। কিন্তু এই সব গুণ নাসিরুল্লার নেই। উল্টে একটি হাত বিস্ফোরণে উড়ে গিয়েছে বলে সহজেই তাকে চিহ্নিত করা যায়। তবে নাসিরুল্লা ওরফে সোহেল মাহফুজ এখনও সংগঠনের সামরিক শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে।
এক গোয়েন্দা অফিসার বলেন, “মনে হচ্ছে, আল কায়দার নির্দেশে গড়া এই জঙ্গি জোট ২০১২-তেই অবয়ব পেতে শুরু করে। তখন আর নাসিরুল্লাকে দিয়ে হচ্ছিল না। দরকার হয়েছিল সাজিদের মতো কাউকে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy