তৃণমূল ও ফরওয়ার্ড ব্লকের শহিদ বেদি পাশাপাশি। দিনহাটায় শুক্রবার হিমাংশুরঞ্জন দেবের তোলা ছবি।
শহিদ তুমি কার! দিনভর এই প্রশ্নেই তেতে রইল দিনহাটা শহর।
আট বছর আগে ৫ ফেব্রুয়ারি-ই দিনহাটায় ফরওয়ার্ড ব্লকের আইন অমান্য আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে ফরওয়ার্ড ব্লকের ৫ কর্মীর মৃত্যু হয়। তারপর থেকে প্রতি বছর এই দিন ফরওয়ার্ড ব্লক শহিদ দিবস পালন করে। সেই অনুষ্ঠানে বরাবরই নেতৃত্ব দিতেন উদয়ন গুহ।
কিন্তু এ বার দল বদলে উদয়নবাবু তৃণমূলে। তাই জানুয়ারি থেকেই ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলার নেতা-কর্মীরা প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন, এ বার শহিদ দিবস পালনের আর কোনও নৈতিক অধিকার কি উদয়নবাবুর আছে? উদয়নবাবু অবশ্য সে প্রশ্নে কর্ণপাত করেননি। তিনি তাঁর মতো করে দিনহাটায় মহকুমা শাসকের দফতরের সামনে এ দিন শহিদ দিবস পালনের আয়োজন করেন। উদয়নবাবু যেখানে সভা করছিলেন, তার দশ কিলোমিটার দূরে ফরওয়ার্ড ব্লকও তাঁদের মতো করে শহিদ দিবস পালনের অনুষ্ঠান করে।
বাম সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই যে মহাকরণ অভিযানে পুলিশের গুলিতে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল, সেই কর্মসূচি ছিল যুব কংগ্রেসের। পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল গঠন করার পর থেকে ২১শে জুলাই তাঁর দলই বড় করে শহিদ দিবস পালন করে। কংগ্রেস নেতারা বারবার আক্ষেপ করে এসেছেন, কংগ্রেসের শহিদদের ‘ছিনতাই’ করে নিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী! এ বার দিনহাটার শহিদদের নিয়েও উদয়নবাবু তথা তৃণমূল একই কাণ্ড ঘটানোর চেষ্টা করেছিল বলে আশঙ্কা ছিল ফরওয়ার্ড ব্লকের। দুই পক্ষই প্রশাসনের কাছে অনুমতি চেয়েছিল। পেয়েওছিল।
শহরবাসীর নজর ছিল, কোন অনুষ্ঠানে যাবেন শহিদদের পরিবারের লোকজনেরা? শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, গো-হারা হারলেন উদয়নবাবুই। ৫ শহিদের পরিবারের কেউই তাঁর সভাতে যাননি। তাঁরা ছিলেন প্রাক্তন মন্ত্রী ফরওয়ার্ড ব্লকের আয়োজিত সভায়। সে দিন পুলিশের গুলিতে মারা যান ফরওয়ার্ড ব্লকের কর্মী নীরেন হালদার। তাঁর স্ত্রী বিমলাদেবী এ দিন বলেন, “উদয়নবাবু ডেকেছিলেন। যাইনি। ফরওয়ার্ড ব্লকে আছি। সেখানেই থাকব।” আরেক শহিদ নিরদ রায়ের স্ত্রী রেবাদেবী বলেন, “উদয়নবাবু কোনওদিন খোঁজ নেননি। ফরওয়ার্ড ব্লকই খোঁজ নিয়েছে।”
উদয়নবাবুর অবশ্য দাবি, “ওই দিন জখম হয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের অনেকেই আমাদের মিছিলে ছিলেন।”
ফরওয়ার্ড ব্লক নেতৃত্বের অবশ্য যুক্তি, আসলে তৃণমূলে কোণঠাসা হয়ে রয়েছেন উদয়নবাবু। তাই তিনি চাইছেন, ফরওয়ার্ড ব্লকে থাকাকালীন তাঁর যে সব সমর্থক ছিলেন, তাঁদের এই দিবস উপলক্ষে এককাট্টা করতে। উদয়নবাবু অবশ্য সে কথা মানতে চাননি। তবে জেলা তৃণমূলের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ এ দিন উদয়নবাবুর শহিদ দিবস এড়িয়ে গিয়েছেন। প্রকাশ্যে তাঁর বক্তব্য, ‘‘অন্য কাজ ছিল বলে যেতে পারিনি। কিন্তু শহিদ দিবস পালনের অধিকার উদয়নবাবুর রয়েছে।’’
ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা সভাপতি পরেশ অধিকারী সরাসরি দাবি করেন, ‘‘দলত্যাগে করার পরে শহিদ দিবস পালনের অধিকার হারিয়েছেন উদয়নবাবু।’’ উদয়নবাবুর পাল্টা, শহিদ কোনও দলের একার হতে পারে না। গণতন্ত্র-প্রিয় খেটে খাওয়া মানুষের আন্দোলন হয়েছিল সে দিন। তিনি দাবি করেন, সেই সময় তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শহিদদের পাশে ছিলেন। উদয়নবাবু তখন ফরওয়ার্ড ব্লকে। তাঁকে সে সময় বাড়িতে ডেকে নিয়ে যান মমতা। তিনি বলেন, “মমতা বলেছিলেন পাশে থাকবেন। তাই তৃণমূলের হয়ে শহিদ দিবস পালন করা হয়েছে।”
উদয়নবাবু মালা দিয়ে চলে যাওয়ার কিছু পরেই হাজির হন ফরওয়ার্ড ব্লক সমর্থকরা। পরেশবাবু, দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অক্ষয় ঠাকুর, যুবলিগের রাজ্য সম্পাদক আব্দুর রউফ, প্রাক্তন সাংসদ নৃপেন রায়ও ছিলেন মিছিলে। পরেশবাবু বলেন, “ওই দিন কারও হাতে তেরঙ্গা ছিল না। ফরওয়ার্ড ব্লকের হয়ে মানুষ আন্দোলনে শহিদ হয়েছেন। এই শহিদ দিবসকে নিয়ে উদয়নবাবু রাজনীতি করতে চাইছেন।”
প্রতি বছরই কেন্দ্রীয় ভাবে কলকাতায় সমাবেশ করে দিনহাটার পঞ্চশহিদকে শ্রদ্ধা জানায় ফরওয়ার্ড ব্লক। কিন্তু এ বার দলের রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষ গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকায় ফব-র রাজ্য দফতর হেমন্ত বসু ভবনেই ছোট অনুষ্ঠানে শহিদদের স্মরণ করা হয়েছে। ছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত বিশ্বাস ও রাজ্য কমিটির চেয়ারম্যান বরুণ মুখোপাধ্যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy