Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

এনআইএ খুঁজে হন্যে, আরবি পড়াচ্ছেন তিনি

খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পরে যখন এনআইএ এবং এনএসজি চারদিকে তল্লাশি করে বেড়াচ্ছে, তখনও তিনি নিয়মিত ক্লাস নিয়ে গিয়েছেন। সেই শান্ত মিতবাক আরবির শিক্ষক যে জঙ্গি হতে পারেন, তা ভাবতেই পারছে না তালিত গৌড়েশ্বর হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। যেমন ভাবতে পারছে না কালিয়াচকে পুরাতন ১৬ মাইল গ্রামের অনেকেই। অথচ শনিবারই কলকাতার নগর দায়রা আদালতে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) দাবি করল, বর্ধমানে খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ডে ধৃত শিক্ষক জিয়াউল হক জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-র সদস্য।

জিয়াউল হক। (ডান দিকে) শনিবার তাকে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে তোলা হচ্ছে।  ছবি:সুদীপ্ত ভৌমিক

জিয়াউল হক। (ডান দিকে) শনিবার তাকে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে তোলা হচ্ছে। ছবি:সুদীপ্ত ভৌমিক

সৌমেন দত্ত ও পীযূষ সাহা
বর্ধমান ও কালিয়াচক শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৫৭
Share: Save:

খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পরে যখন এনআইএ এবং এনএসজি চারদিকে তল্লাশি করে বেড়াচ্ছে, তখনও তিনি নিয়মিত ক্লাস নিয়ে গিয়েছেন।

সেই শান্ত মিতবাক আরবির শিক্ষক যে জঙ্গি হতে পারেন, তা ভাবতেই পারছে না তালিত গৌড়েশ্বর হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। যেমন ভাবতে পারছে না কালিয়াচকে পুরাতন ১৬ মাইল গ্রামের অনেকেই।

অথচ শনিবারই কলকাতার নগর দায়রা আদালতে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) দাবি করল, বর্ধমানে খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ডে ধৃত শিক্ষক জিয়াউল হক জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-র সদস্য। সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। বিস্ফোরণের পরে জেএমবি নেতাদের সঙ্গে তিনি একাধিক বার ফোনে কথাও বলেছেন। নগর আদালতের মুখ্য বিচারক মহম্মদ মুমতাজ খান তাঁকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত এনআইএ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। ওই দিনই খাগড়াগড় বিস্ফোরণে আহত আব্দুল হাকিমকেও আদালতে হাজির করানো হবে।

তালিতের স্কুলটির হাজিরা খাতা বলছে, জিয়াউল পারতপক্ষে ছুটিছাটা নিতেন না। ২০১১ সালের ৯ জুলাই কাজে যোগ দেওয়া ইস্তক পাওনা ছুটির বাইরে কখনও তিনি তিন-চারের দিন বেশি টানা ছুটি নেননি। তালিত বর্ধমান জেলায় হলেও মঙ্গলকোটের শিমুলিয়া থেকে তার দূরত্ব কম নয়। মুর্শিদাবাদের বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা লালগোলার মকিমনগর তো আরও দূরে। অথচ তদন্তে নেমে এনআইএ জেনেছে, শিমুলিয়া ও মকিমনগরের মাদ্রাসায় অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের তিনি জঙ্গি ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করতেন।

কোনও দিন সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েনি বলেই হয়তো হতবাক হয়ে গিয়েছেন গৌড়েশ্বর হাইস্কুলের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা। এ দিনই এনআইএ-র ডিএসপি প্রেমবীর সিংহ লিখিত ভাবে প্রধান শিক্ষককে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানান। প্রধান শিক্ষক মানসকুমার হাজরার কথায়, “আমার কাছে পুরোটাই বিস্ময়কর। কিছুতেই মেলাতে পারছি না।” স্কুল পরিচালন কমিটির সম্পাদক শেখ সাইদুল হক বলেন, “বুঝতেই পারছি না, স্কুলের শিক্ষক কী ভাবে জড়িয়ে পড়লেন।”

কী রকম মানুষ জিয়াউল?

স্কুলে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে যারা জিয়াউলের কাছে ঐচ্ছিক আরবি পড়ত, সেই ছাত্রছাত্রীরা জানাচ্ছে, পড়ানোয় স্যারের কোনও খামতি ছিল না। মাঝে-মধ্যে তিনি ল্যাপটপ এনে ছবি-কার্টুন এই সব দেখিয়ে পড়াতেন। তাতে তারা মজাই পেত। সহকর্মীরা জানান, জিয়াউল একটু বেশি ধর্মভীরু। প্রতি শুক্রবার কাছেই মসজিদে নমাজ পড়তে যেতেন তিনি। স্কুলের কাছে নমাজের জন্য বরাদ্দ সময় বাড়ানোর আর্জিও জানিয়েছেন কয়েক বার। কিন্তু সহকর্মীরা তাঁর আচরণে কখনও সন্দেহজনক কিছু দেখেননি।

মাস আটেক আগে খাগড়াগড়ে এক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্মীর বাড়িতে ভাড়া থাকতে শুরু করেন জিয়াউল। এ দিন সকালে এনআইএ গিয়ে সেখানে তল্লাশি চালায়। কিছু বই বাজেয়াপ্ত করে বাড়িটি সিল করে দেয় তারা। পড়শিরা জানান, জিয়াউল তাঁদের সঙ্গে কমই কথা বলতেন। তবে বাড়ির মধ্যে কাউকে ঢুকতে দিতেন না। দরজা-জানলাও বেশির ভাগ সময়ে বন্ধ থাকত। ওই বাড়ি থেকে দেড়শো মিটারের মধ্যে খাগড়াগড়ের সেই বিস্ফোরণস্থল। এনআইএ সূত্রের দাবি, ওই সময়ে পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি ফোনে এনআইএ-র গতিবিধি জেএমবিকে জানাতেন।

মুর্শিদাবাদের কালিয়াচকে পুরাতন ১৬ মাইল গ্রামের বাসিন্দারা কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছেন না, জিয়াউল জঙ্গি হতে পারেন। তাঁদের পরিবার ‘শিক্ষিত’ বলেই পরিচিত। জিয়াউলের বাবা মহম্মহ ফাইম শেখ স্থানীয় নাসিরটোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। মেজো ভাই সাইদ জালালপুর হাইস্কুলে আরবি শিক্ষক। তাঁরা দু’জনেই এ দিন স্কুলে গিয়েছেন। ছোট ভাই আবদুল্লা কালিয়াচক কলেজের ছাত্র। তাঁদের খুড়তুতো ভাই বরকত আলিও উত্তর দিনাজপুরে বিন্দোল হাইস্কুলের শিক্ষক।

জিয়াউল কয়েকটি অনুমোদনহীন মাদ্রাসায় জিহাদের মন্ত্র দিতে যেতেন বলে তদন্তে জানা গেলেও তিনি নিজে কিন্তু মাদ্রাসায় পড়েননি। ২০০৩-এ রাজনগর হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক, সুজাপুর নয়মৌজা শুভানিয়া হাইস্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, বৈষ্ণবনগরের সাউথ মালদহ কলেজ থেকে আরবি অনার্স, গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। তার পরে স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিয়ে স্কুলে চাকরি। কিন্তু ছোট থেকেই যে তিনি ধর্মগোঁড়া ছিলেন তা গ্রামের অনেকেই বলছেন।

গ্রামের রাজীব শেখ বলেন, “আমি জিয়াউলের সঙ্গে এক স্কুলে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছি। ছোটবেলা থেকেই এলাকার কোথাও ধর্মীয় ‘জালসা’ হলেই ও গিয়ে পরিচালনা করত।” তাঁর কট্টর মনোভাব নিয়ে অনেকের ঝামেলাও হয়েছে। রাজীব বলেন, “এক ইসলাম ধর্মপ্রচারকের বক্তব্য ক্যাসেটবন্দি করে ও গ্রামের লোকদের শোনাত। তবে চাকরি হওয়া ইস্তক গ্রামে কম আসত। আমাদের সঙ্গে তেমন মেলামেশাও করত না।”

জিয়াউলের ভাই সাইদ শিক্ষকতার সঙ্গে হার্ডওয়্যার ব্যবসাও করেন। বিস্ফোরণের কয়েক দিন পরে তাঁর কাছেই জিয়াউল নিজের ল্যাপটপ রেখে আসেন। শুক্রবার এনআইএ-র অফিসারেরা গেলে সাইদ তাঁর বন্ধু তথা ব্যবসার সঙ্গী এনামুল হকের দোকান থেকে সেটি এনে দেন। গ্রামের এক মোবাইলের সিমকার্ড ব্যবসায়ী জানান, পুজোর সময়ে বাড়ি এসে জিয়াউল তাঁর কাছ থেকে সিমকার্ড কিনেছিলেন। তবে তার জন্য ভোটার কার্ড দিয়েছিলেন। ল্যাপটপ ছাড়াও কিছু সিডি ও প্রচুর কাগজপত্র বাজেয়াপ্ত করে এনআইএ চলে যায়।

শুক্রবার এনআইএ-র অফিসারেরা জিয়াউলকে নিয়ে কলকাতায় চলে যাওয়ার পরেই তাঁর শ্বশুর হুমায়ুন শেখ ও শ্যালক আবদুর সাহিদের সঙ্গে বর্ধমান থেকে মালদহের বৈষ্ণবনগরে বাপের বাড়িতে ফেরেন জিয়াউলের স্ত্রী মাহিরা বিবি ও তাঁর এক বছরের মেয়ে। একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময়ে মাহিরার বিয়ে হয়েছিল। বৈষ্ণবনগর থানা থেকে কিলোমিটার আটেক দূরে শাহাবানচকে তাঁদের বাড়ি এ দিন সন্ধ্যায় কার্যত অন্ধকারে ডুবে ছিল। অনেক ডাকাডাকি পরে জিয়াউলের শ্বশুর ও ছোট শ্যালক বেরিয়ে হাতজোড় করে বলেন, “আমাদের মানসিক অবস্থা ভাল নয়। দয়া করে জিয়াউল নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না।” পরে শ্যালক আবদুর সাহিদ বলেন, “নিরপেক্ষ তদন্ত হোক। তাতে যদি দেখা যায় আমার জামাইবাবু দেশদ্রোহী, তবে এক বার নয়, দশ বার সাজা হোক।” পিছনে দাঁড়িয়ে তাঁর মা তখন ঝরঝর করে কাঁদছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE