Advertisement
০৫ মে ২০২৪

কবীর সুমনের স্তুতি, পার্থর কোপে দ্বাদশের বই

প্রি-টেস্ট সামনেই। এই অবস্থায় হঠাৎ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই ‘বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি’ প্রত্যাহার করে নিল রাজ্য সরকার। পরবর্তী নির্দেশ না-দেওয়া পর্যন্ত বইটি বিক্রি করা যাবে না বলে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদকে নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। কেন? সরকারি ভাবে জানানো হয়েছে, বইটি নিয়ে নানা বিতর্ক উঠছিল। বইটির পরিমার্জন দরকার।

—নিজস্ব চিত্র

—নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৪ ০৩:১৩
Share: Save:

প্রি-টেস্ট সামনেই। এই অবস্থায় হঠাৎ দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই ‘বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি’ প্রত্যাহার করে নিল রাজ্য সরকার। পরবর্তী নির্দেশ না-দেওয়া পর্যন্ত বইটি বিক্রি করা যাবে না বলে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদকে নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়।

কেন? সরকারি ভাবে জানানো হয়েছে, বইটি নিয়ে নানা বিতর্ক উঠছিল। বইটির পরিমার্জন দরকার।

তবে প্রশাসনের অন্দর মহলের একটি সূত্রের দাবি, বইয়ের একটি অধ্যায় ‘বাংলা গানের বাঁক বদল আট ও নয়ের দশক’। সেখানে কবীর সুমন প্রসঙ্গে প্রশংসাসূচক উক্তি ছিল। শাসক দলের সঙ্গে এই প্রাক্তন সাংসদের তিক্ত সম্পর্কের প্রেক্ষিতে সেটা আপত্তিকর মনে হয়েছে রাজ্যের। মূলত সেই কারণে শিক্ষাবর্ষের মাঝখানে বইটি তুলে নেওয়া হয়েছে।

কিন্তু শিক্ষা জগতের অনেকেরই প্রশ্ন, বাংলা গানের বাঁক বদলের ইতিহাস কবীর সুমনের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে লেখা যায় কি? দ্বিতীয়ত কবীর সুমনের নাম বাদ দেওয়াই যদি সরকারি সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে, তা হলে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ এমন বই প্রকাশ করল কী করে? পাঠ্যক্রম কমিটিই বা এমন বইয়ে অনুমোদন দিল কী করে?

এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে স্কুল পাঠ্যক্রম কমিটি এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ পরস্পরের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে।

বর্তমান পাঠ্যক্রম কমিটি তৈরি করেছিলেন প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। নতুন পাঠ্যক্রম ও নতুন বই প্রস্তুত করার কথা সেই কমিটিরই। কমিটির দাবি, পাঠ্যক্রম তৈরি করে দিলেও সময়ের অভাবে তারা নিজেরা বইটি লিখতে পারেনি। কমিটির এক সদস্যের কথায়, “প্রকাশক অর্থাৎ উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদই বইটি লিখিয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাঠ্যক্রম মানা হয়নি। বই প্রকাশিত হওয়ার পরে ১২ পাতার ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা আপত্তিপত্র দিয়ে সংসদকে তা জানিয়েছিলাম।”

সেই আপত্তিপত্রে কি কবীর সুমনের নাম বাদ দিতে বলা হয়েছিল? সরাসরি উত্তর এড়িয়ে কমিটি-সদস্য বলেন, “কবীর সুমনের নাম দিতে আমরা বলিনি।”

কিন্তু কাদের বিষয়ে পড়ানো হবে, সেটা ঠিক করে দেওয়ার দায়িত্ব কি কমিটির নয়? সংসদ অন্তত তেমনটাই দাবি করছে। সংসদের বক্তব্য, গত ২১ মে পাঠ্যক্রম কমিটির কাছে চিঠি পাঠিয়ে বইয়ের খসড়া দেখে দিতে অনুরোধ করা হয়েছিল। কমিটি তা দেখে লিখিত ভাবে ছাড়পত্র দেয়। কমিটি যে আপত্তিপত্র পাঠিয়েছে বলে দাবি করছে, তা ঠিক নয় বলে দাবি করছেন সংসদ-কর্তারা।

এখন অবশ্য এই বিতর্কও উঠছে যে, ‘আধুনিক বাংলা গানের ধারা’ অধ্যায়ে মান্না দে, শ্যামল মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নাম নেই কেন? সরকারের অন্দরে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কমিটির একটি সূত্রের দাবি, আপত্তিপত্রে তাঁরাও একই প্রশ্ন তুলেছেন। জানতে চেয়েছেন, যেখানে হেমন্ত-মান্না ঠাঁই পাননি, সেখানে কবীর সুমন নিয়ে এত কথা কেন?

সংসদের আধিকারিকের দাবি, এ ব্যাপারে তাঁদের কিছু করার নেই। ‘আধুনিক বাংলা গানের ধারা’য় কাদের নাম থাকবে, সেটা কমিটিই ঠিক করে দিয়েছিল। সেই মোতাবেক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতুলপ্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, নজরুল ইসলাম, রজনীকান্ত সেন, কবি মুকুন্দদাস ও সলিল চৌধুরীর নাম রাখা হয়েছে। তবে ওই আধিকারিক স্বীকার করছেন, ‘বাংলা গানের বাঁক বদল আট ও নয়ের দশক’ অংশে কাদের কথা পড়ানো হবে, পাঠ্যক্রমে তা সুনির্দিষ্ট করা ছিল না। বইয়ের প্রণেতারাই কবীর সুমন ও গৌতম চট্টোপাধ্যায়কে ওই অংশে রেখেছেন। কিন্তু বইয়ের খসড়া দেখে পাঠ্যক্রম কমিটি এ নিয়ে আপত্তি করেনি বলেই সংসদের দাবি। অর্থাৎ কমিটির ছাড়পত্র নিয়েই কবীর সুমনের অংশটি বইয়ে রয়েছে বলে দাবি।

তা হলে ১২ পাতা জুড়ে কী নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে কমিটি? কমিটি সদস্যদের বক্তব্য, প্রধানত কিছু তথ্যের ভুল এবং বানান বিভ্রাট নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। সে সব সংসদ মানেনি বলে অভিযোগ। কিন্তু আপত্তিপত্রটি তাদের কাছে পাঠানোই হয়নি বলে সংসদ যে দাবি করেছে, তা কি ঠিক? পাঠ্যক্রম কমিটির চেয়ারম্যান অভীক মজুমদার উত্তরে বলেন, “কিচ্ছু বলব না।” সংসদের সভানেত্রী মহুয়া দাসও কোনও কথা বলতে রাজি হননি।

এখন বইটির আরও কিছু অংশ নিয়েও জলঘোলা হচ্ছে। বিখ্যাত ভাস্কর রামকিঙ্কর বেজকে ওই বইয়ে ‘এক জন ভারতীয় সাঁওতাল ভাস্কর’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই নিয়ে আপত্তি তুলেছেন অনেকে। তাঁদের মতে, রামকিঙ্করের মতো প্রবাদপ্রতিম শিল্পীকে ‘সাঁওতাল’ পরিচয়ের

বন্ধনীতে আটকে রাখলে তাঁকে অসম্মান করা হয়।

আরও কিছু অসঙ্গতির দিকে আঙুল তুলেছেন কেউ কেউ। যেমন, বইয়ে জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে স্মরণ করা হয়েছে শুধুমাত্র কারিগরি শিক্ষার প্রসারের জন্য।

শিক্ষামন্ত্রী এ দিন বলেন, “বইটি নিয়ে নানা বিতর্ক উঠছে বলে শুনেছি। বইটি এমন ভাবে পরিমার্জন করতে হবে, যাতে আর বিতর্ক না-হয়।”

কিন্তু তৃণমূলের অন্দরে অনেকেই বলছেন, আসল সমস্যাটা কবীর সুমনকে নিয়ে। তড়িঘড়ি বই প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত সে কারণেই। বিষয়টিতে যাতে আপাত ভাবে রাজনৈতিক রং না লাগে, সেটা নিশ্চিত করতেই আরও কিছু ‘আপত্তি’র কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। সেগুলো শোধরানোর জন্য আগামী শিক্ষাবর্ষ অবধি অপেক্ষা করাই যেত। কবীর সুমনের বিষয়টিই বই প্রত্যহারের সিদ্ধান্ততে ত্বরান্বিত করেছে।

নতুন পাঠ্যক্রম মেনে তৈরি হওয়া এই বই এমনিতেই প্রকাশিত হয়েছে দেরিতে। সপ্তাহ দুয়েক হল, বইটি ছাত্র-শিক্ষকদের হাতে পৌঁছেছিল। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ওই বই থেকে ৪৩ নম্বরের প্রশ্ন আসার কথা। গরমের ছুটির পরে বেশির ভাগ স্কুলে ক্লাস শুরু হয়েছে জুনের গোড়ায়। নতুন পাঠ্যক্রমে পড়াতে সড়গড় হওয়ার জন্য প্রস্তুতি চালাচ্ছিলেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। এখন হঠাৎ বইটি তুলে নেওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সঙ্গে থমকে গিয়েছেন তাঁরাও। পাঠভবন স্কুলের বাংলার শিক্ষক দেবাশিস পাল বলেন, “আমরা সবে গুছিয়ে নিচ্ছিলাম পড়াব বলে। এখন তো বুঝতেই পারছি না, কোন অংশে কতটা বদল হবে!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

parha chattyopadhyay education department text book
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE