অস্থায়ী রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগকে ‘অসাংবিধানিক’ তকমা দিয়ে তাকে চ্যালেঞ্জ করা হল আইনের দরবারে। বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে দায়ের করা মামলাটি গ্রহণও করল কলকাতা হাইকোর্ট। যার প্রথম শুনানিতে আবেদনকারীর হয়ে সওয়াল করতে নেমে দুঁদে আইনজীবী তুলে আনলেন সাংবিধানিক পদাধিকারীর উপরে ‘সরকারি চাপ’ ও ‘সংবিধানকে ধর্ষণের’ অভিযোগ।
১৯৯৪-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নির্বাচন কমিশন আইনের ৩ নম্বর ধারার ২ নম্বর উপধারাটি (যার সুবাদে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে অস্থায়ী নির্বাচন কমিশনার নিযুক্ত করেছেন রাজ্যপাল) সংবিধানসম্মত নয় বলে এ দিন হাইকোর্টে আবেদনকারীর হয়ে সওয়াল করেন প্রবীণ আইনজীবী সমরাদিত্য পাল। বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের এজলাসে বাদীপক্ষের আর্জি ছিল, অস্থায়ী কমিশনার যাতে গুরুত্বপূর্ণ কোনও সিদ্ধান্ত নিতে না-পারেন, সে ব্যাপারে আদালত অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশ জারি করুক। বিচারপতি দত্ত মামলাটি শুনানির জন্য গ্রহণ করলেও অস্থায়ী কমিশনারের কাজ সম্পর্কে অন্তর্বর্তীকালীন কোনও নির্দেশ এ দিন দেননি। মামলার মূল বিষয়ের শুনানি অবশ্য চলবে।
সমরাদিত্যবাবু এ দিন তাঁর সওয়ালে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, অস্থায়ী রাজ্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে আলাপনবাবু স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারবেন না। বিচারপতি দত্ত পাল্টা প্রশ্ন তোলেন, ‘‘এক জন সরকারি অফিসার স্বাধীন ভাবে কাজ করতে পারবেন না, এমন আশঙ্কার কারণ কী?’’ সমরাদিত্যবাবুর জবাব, ‘‘উনি ও সরকারের অধীনেই আছেন। তাই একেবারে নিরপেক্ষ ও স্বাধীন ভাবে কাজ করতে দেওয়া না-ও হতে পারে।’’
এবং এ প্রসঙ্গে সমরাদিত্যবাবু সদ্য প্রাক্তন রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের ইস্তফার দৃষ্টান্ত টেনে আনেন। বলেন, ‘‘প্রাক্তন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় নিজেই জানিয়েছিলেন, চাপের কাছে মাথা নুইয়ে তিনি ইস্তফা দিয়েছেন। চাপের কাছে নতিস্বীকার করে কেউ ওই পদে কাজ করতে না-পারলে ধরে নিতে হবে, দেশের সংবিধান ধর্ষিত হচ্ছে।’’ শুনে বিচারপতি দত্তের মন্তব্য, ‘‘কেউ যদি চাপ সহ্য করতে না পারেন, তা হলে ইস্তফা দেওয়া ছাড়া তাঁর আর কী-ই বা করার থাকে?’’ যদিও এ ক্ষেত্রে সুশান্তরঞ্জনবাবু আদালতের দ্বারস্থ হতে পারতেন বলে অভিমত প্রকাশ করেন বিচারপতি। প্রশ্নও তোলেন— ‘‘রাজ্য নির্বাচন কমিশনার কে হতে পারেন, সংবিধানে কি তা বলা আছে?’’ সমরাদিত্যবাবু জবাব দেন, ‘‘ তা বলা নেই। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী, রাজ্য নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচন কমিশনের সমতুল।’’
এমতাবস্থায় বিচারপতি দত্ত সমরাদিত্যবাবুকে নির্দেশ দেন, কোন ব্যক্তি ভারতের মুখ্য নির্বাচন কমিশন নিযুক্ত হন, তাঁর দুই সহকারীই বা কারা হন, এ সব তথ্য আদালতকে জানাতে হবে। আজ, শুক্রবার বেলা বারোটায় পরবর্তী শুনানি। তখনই তথ্যগুলি পেশ করতে বলা হয়েছে।
রাজ্য নির্বাচন কমিশনের আইনবলে (৩ নম্বর ধারার ২ নম্বর উপধারা) আলাপনবাবুকে যে ভাবে অস্থায়ী রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের পদে বসানো হয়েছে, তার সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে মামলাটি দায়ের করেছেন সল্টলেকের বাসিন্দা অমিতাভ মজুমদার। তাঁর তরফে সমরাদিত্যবাবু এ দিন আদালতের কাছে দাবি করেন, ধারাটি অসাংবিধানিক। প্রবীণ আইনজীবীর বক্তব্য: ভারতীয় সংবিধানের ২৪৩ জেড-এ ধারা মোতাবেক, রাজ্য নির্বাচন কমিশনার স্বশাসিত একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান, তিনি কারও নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারেন না। বস্তুত ২০০৬-এ সুপ্রিম কোর্ট একটি মামলার (কিষাণ সিংহ তোমার বনাম মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন, গুজরাত) রায়ে সংবিধানের ওই ধারাটিকেই বহাল রেখেছে বলে তিনি আদালতকে জানান।
নিজের দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করার পিছনে যুক্তি হিসেবে সমরাদিত্যবাবু আরও বলেন, আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্য সরকারের অধীনে কর্মরত, তিনি এখনও রাজ্য পরিবহণ দফতরের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির পদে ইস্তফা দেননি। ‘‘এই পরিস্থিতিতে তিনি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন ভাবে কমিশনারের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। অথচ সংবিধান বলছে, রাজ্য নির্বাচন কমিশনার একা, স্বাধীন ভাবে কাজ করবেন। তাঁকে কড়া হাতে দায়িত্ব পালন করতে হবে।’’— পর্যবেক্ষণ সমরাদিত্যবাবুর। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও রাজ্যের বিধানসভা যখন কোনও আইন তৈরি করবে, তাকে দেশের সংবিধান মেনে চলতে হবে। অথচ রাজ্য নির্বাচন কমিশন আইন সংশোধন করে ৩ নম্বর ধারার ২ নম্বর উপধারা ঢোকানোর সময়ে সংবিধানের ধারা মানাই হয়নি।’’
প্রাক্তন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার কেমন ‘চাপের’ মুখে পড়েছিলেন, সওয়ালে সে প্রসঙ্গও তোলেন সমরাদিত্যবাবু। তাঁর অভিযোগ: ৩ অক্টোবরের বিধাননগর পুরভোট সুশান্তরঞ্জনবাবুর নিয়ন্ত্রণে ছিল না। ‘‘রাজ্য ওঁকে বারবার চাপ দিয়ে বলেছে, এই কাজ আপনাকে করতে হবে। গণনা স্থগিত ঘোষণা করতেই শাসকদলের নেতা, মন্ত্রীরা ঘেরাও করে বসলেন! চাপ সৃষ্টি করলেন! ওঁকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করতে দেওয়া হল না। চাপ সইতে না-পেরে তিনি ইস্তফা পেশ করলেন। ইস্তফা গৃহীত হওয়ার খবরও মানুষ জানতেও পারল না!’’— সওয়ালে আক্ষেপ করেন বাদী কৌঁসুলি।
ঠিক এই সময়ে রাজ্যের অতিরিক্ত অ্যাডভোকেট জেনারেল লক্ষ্মী গুপ্ত একটি সরকারি গেজেট আদালতে দাখিল করেন। সেটি পড়ে বিচারপতি দত্ত বাদী কৌঁসুলিকে বলেন, ‘‘এতে লেখা রয়েছে, সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়ের ইস্তফা গৃহীত হয়েছে। আর রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের পদ খালি হওয়ায় সরকারি অফিসার আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজ্যপাল ওই দায়িত্বে নিযুক্ত করছেন।’’ এ দিনের শুনানিতে সমরাদিত্যবাবুকে সাহায্য করেছিলেন হাইকোর্টের আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য ও অরুণাভ ঘোষ। তাঁরা পরে বলেন, নিযুক্তির বৈধতা নিয়ে হাইকোর্টে মামলার শুনানি হচ্ছে জেনেও সল্টলেকের কিছু বুথে পুনর্নির্বাচন ঘোষণা করেছেন আলাপনবাবু! এ-ও সরকারের চাপের কাছে নতিস্বীকারের সামিল বলে ওঁরা মনে করছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy