খুচরো দু’-এক রান নেওয়া নয়, এ বার বাউন্ডারি হাঁকালেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা!
খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের অব্যবহিত পরে ঘটনাস্থলেই দুই মহিলা-সহ তিন সন্দেহভাজন জঙ্গি রাজ্য পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল। আর বিস্ফোরণের প্রায় চার মাস পরে, মঙ্গলবার ওই জেহাদি জঙ্গি চক্রে জড়িত থাকার অভিযোগে চার জনকে এক সঙ্গে গ্রেফতার করল জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)। খাগড়াগড়-কাণ্ডে এক সঙ্গে এত জন অভিযুক্ত এর আগে ধরা পড়েনি। সে দিক দিয়ে তদন্তে বড়সড় সাফল্য পাওয়া গেল বলে দাবি করছেন গোয়েন্দারা। এই নিয়ে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের মামলায় ধৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১৬। এর আগে যে ১২ জন ধরা পড়েছিল, তাদের মধ্যে এক জন বাংলাদেশ ও এক জন মায়ানমারের নাগরিকও রয়েছে।
তবে এনআইএ সূত্রের খবর, মঙ্গলবার ধৃত চার জনকেই প্রাথমিক ভাবে ভারতীয় নাগরিক বলে মনে করা হচ্ছে। এরা হল বীরভূমের ডালিম শেখ, নদিয়ার মতিউর রহমান ও গিয়াসউদ্দিন মুন্সি এবং মুর্শিদাবাদের হবিবুর রহমান। এরা প্রত্যেকেই পশ্চিমবঙ্গে জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর জাল ছড়াতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল বলে তদন্তকারীদের দাবি। বুধবার নগর দায়রা আদালতে তাদের হাজির করানো হলে মুখ্য বিচারক মহম্মদ মুমতাজ খান চার জনকেই ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এনআইএ-র হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন।
যদিও ওই চার জনকে এক সঙ্গে কলকাতা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে, এনআইএ এ কথা জানানোয় বিচারক জিজ্ঞেস করেন, চার জনকেই এক সঙ্গে একই জায়গা থেকে ধরা হল? কী ভাবে তারা কলকাতায় এল? তখন এনআইএ-র পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কলকাতায় ডাকা হয়েছিল, তার পর তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ দিন শুনানির পরে আদালত কক্ষ ফাঁকা করে দিয়ে বিচারক ওই চার ধৃতের সঙ্গে একান্তে কথাও বলেন।
গত বছরের ৩১ অক্টোবর এনআইএ খাগড়াগড়ের কয়েক জন অভিযুক্তের যে তালিকা প্রকাশ করে বিভিন্ন অঙ্কের ইনাম ঘোষণা করেছিল, তাতে এই চার জনের নাম ছিল না। এনআইএ-র এক অফিসারের কথায়, “ইনামের তালিকায় কারও নাম না-থাকলে তদন্তে তার গুরুত্ব কম, এমনটাও নয়। অনেক সময়ে কৌশল হিসেবেই কোনও কোনও অভিযুক্তের নাম প্রকাশ করা হয় না।” ওই অফিসার জানান, খাগড়াগড় বিস্ফোরণের সূত্রে যে জঙ্গি নেটওয়ার্কের হদিস মিলেছে, এদের কেউই সে অর্থে তার চাঁই না হলেও প্রত্যেকেরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ধৃত চার জনের মধ্যে বীরভূমের বাসিন্দা ডালিম শেখ ওরফে ফইজুল হক শেখ সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বোলপুর লাগোয়া মুলুক গ্রামের শান্তিপল্লির ডালিম শেখ জেএমবি-র এক জন পুরোদস্তুর সদস্য বলে এনআইএ-র দাবি। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে জেএমবি ঘাঁটি ও গোপন ডেরা গড়ে তোলা, এই জঙ্গি সংগঠনের জন্য এ রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে অর্থ সংগ্রহ এবং এ দেশের বেশ কয়েক জন তরুণ-তরুণীর মগজধোলাই করে তাদের সদস্য হতে উদ্বুদ্ধ করার দায়িত্ব ছিল ডালিমের উপরে। তা ছাড়া, জঙ্গি-জাল ছড়াতে বাংলাদেশের নাগরিক, জেএমবি-চাঁইদের কৌশলগত ও বিভিন্ন জিনিসপত্র দিয়ে সহায়তা করার কাজও ডালিম করত। এনআইএ-র দাবি, বীরভূমে জঙ্গিদের যে ‘অ্যাকশন টিম’ তৈরি করা হয়েছিল, ডালিমই ছিল তার মাথা।
এ দিন মুলুক গ্রামের শান্তিপল্লির বাসিন্দারা জানান, বছর ছয়েক আগে শান্তিপল্লিতে এসে থাকতে শুরু করে ডালিম। তার আচরণ যে ‘রহস্যজনক’, সে কথা জানিয়েছেন প্রতিবেশীরা। পেশায় বাসনের ফেরিওয়ালা হলেও তাঁরা তাকে একাধিক ল্যাপটপ ব্যবহার করতে দেখেছেন।
তবে হবিবুর রহমান নামে যাকে মঙ্গলবার গ্রেফতার করা হয়েছে, তার নামে জারি হওয়া গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করে নিতে গত ১৩ জানুয়ারি কলকাতার নগর দায়রা আদালতে আবেদন জানিয়েছিল এনআইএ। বিচারক সেই আবেদন মঞ্জুরও করেন। তা হলে সেই হবিবুরকেই মঙ্গলবার গ্রেফতার করার কারণ কী?
এনআইএ-র এক শীর্ষকর্তা বুধবার বলেন, “হবিবুরের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করে নেওয়ার আবেদন জানানো আমাদের কৌশলের অঙ্গ ছিল। এর মানে এই নয় যে, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে।” ওই অফিসারের বক্তব্য, “জেএমবি-র বর্ধমান মডিউলের মাথা সাজিদ ওরফে শেখ রহমতুল্লার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিল হবিবুর। খাগড়াগড় কাণ্ডে অভিযুক্তেরা প্রচণ্ড বুদ্ধিমান। তাই, সেই মতো পাল্টা চাল চালতে হচ্ছে আমাদেরও।” এনআইএ-র দাবি, জেএমবি-র সদস্য ওই যুবক লালগোলার মকিমনগর মাদ্রাসায় রান্নার কাজ করত এবং ওই জঙ্গি ডেরায় জেহাদি প্রশিক্ষণ শিবির চালানোর দায়িত্বে ছিল।
আবার খাগড়াগড় বিস্ফোরণে নিহতদের অন্যতম, শাকিল গাজির ঘনিষ্ঠ সহযোগী সন্দেহে এনআইএ মঙ্গলবারই গ্রেফতার করেছে মতিউর রহমান ওরফে নুর আলমকে। মতিউরের বাড়ি নদিয়া জেলার কালীগঞ্জের মির্জাপুরে। তবে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙায় ‘বোরখা ঘর’ নামে পোশাকের দোকানের আড়ালে শাকিল গাজি বোমা সরবরাহের যে ডেরা তৈরি করেছিল, সেখানে মতিউর সর্বক্ষণের কর্মী ছিল বলে গোয়েন্দারা জেনেছেন। তাঁদের বক্তব্য, মতিউর নিজে বোরখা তৈরি করতে পারত আবার বেলডাঙার কারখানায় তৈরি হওয়া গ্রেনেড, রকেট, সকেট বোমা বোরখা ঘরে পৌঁছে জেওয়ার দায়িত্ব ছিল তার ওপর। খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণ হওয়ার কিছু ক্ষণের মধ্যে মতিউর বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায় বলে এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন।
ধৃত চতুর্থ জন, গিয়াসউদ্দিন মুন্সিও মতিউরের মতো কালীগঞ্জের মির্জাপুরের বাসিন্দা। এনআইএ জানিয়েছে, গিয়াসউদ্দিন ও তার স্ত্রী সাহিদা বিবি, দু’জনেই জেএমবি-র তত্ত্বাবধানে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। তদন্তকারীদের বক্তব্য, জেএমবি-র সক্রিয় সদস্য গিয়াস এ দেশে সংগঠনের বাংলাদেশি সদস্যদের আশ্রয় দেওয়ার বন্দোবস্ত করত।
এই চার জনকে জেরা করে ভারতে জাল ছড়ানো জেএমবি জঙ্গি-চক্রের অধরা মাথারা তো বটেই, এখনও নজরের আড়ালে পড়ে থাকা বেশ কিছু চাঁইয়ের নাম-ধামও জানা যেতে পারে বলে আশা করছেন গোয়েন্দারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy