কেউ কেউ বলছেন, ঘোর অপরাধ। তাঁরা আইনি পদক্ষেপের পক্ষে। কেউ চাইছেন খোদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হস্তক্ষেপ। আবার কারও মতে, এটা স্বাভাবিক ঘটনা, অনিয়ম কিছু হয়নি।
আদালতে হিডকো-র প্রাক্তন জনসংযোগ আধিকারিক অঞ্জন ভট্টাচার্যের দেওয়া গোপন জবানবন্দি পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম মঙ্গলবার প্রকাশ্যে আনায় রাজ্যের রাজনৈতিক ও আইনি মহলে এ ভাবেই দানা বেঁধেছে প্রশ্ন আর বিতর্ক। মামলার চার্জশিট দেওয়ার আগে আদালতের সম্পত্তি এ ভাবে বাইরে আসায় সিপিএম আইনি পদক্ষেপ করার কথা ভাবছে। শুধু তা-ই নয়, ওই জবানবন্দি প্রকাশ্যে এনে ফিরহাদ যাঁর সঙ্গে সারদা গোষ্ঠীর ‘যোগসাজশ’ প্রমাণ করতে চেয়েছেন, প্রাক্তন আবাসনমন্ত্রী সেই গৌতম দেব বুধবার পুরমন্ত্রীকে জেলে পাঠানোর দাবি তুলেছেন। কেন?
গৌতমবাবুর ব্যাখ্যা, “১৬৪ ধারায় কেউ জবানবন্দি দিলে তা ম্যাজিস্ট্রেটের সম্পত্তি। জবানবন্দির বিষয়বস্তু এক জন মন্ত্রী প্রকাশ্যে পড়ে দিলেন কী ভাবে? জবানবন্দির বিষয় ঠিক না ভুল, সেটা পরের কথা। কিন্তু এ জিনিস প্রকাশ্যে বলে দেওয়ার অপরাধেই আইনত মন্ত্রীর জেল হওয়া উচিত।” এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার কথা তাঁরা ভেবে দেখবেন বলে জানিয়েছেন গৌতমবাবু। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর মন্তব্য, “ওই মন্ত্রী যা করেছেন, আমাদের দেশের স্বাভাবিক আইন অনুযায়ী তা করা যায় না। দেখা যাচ্ছে, আইন-কানুন বা সংবিধান কোনও কিছুই তৃণমূলের জন্য নয়! যা খুশি করছে!”
পুরমন্ত্রী কোন পরিস্থিতিতে এমন কাজ করলেন? মঙ্গলবার দুপুরে গৌতমবাবু সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারের লোকজন অল্প সময়ে বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হলেন কী ভাবে? আর বিকেলেই পাল্টা সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে পুরমন্ত্রী টেনে আনেন অঞ্জনবাবুর জবানবন্দির প্রসঙ্গ। ‘‘অঞ্জনবাবু বলেছেন, সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেন গৌতম দেব-ই। সুদীপ্ত সেনের কাছ থেকে গৌতম দেবের কাছে সাদা খামও আসত। অঞ্জনবাবু এ সব কথা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গোপন জবানবন্দিতে জানান।” দাবি করেন ফিরহাদ।
কিন্তু অঞ্জনবাবুর গোপন জবানবন্দি তাঁর কাছে এল কী ভাবে? পুরমন্ত্রী এ দিন বলেন, “কোর্টে যে দিন জিজ্ঞেস করবে, সে দিন জবাব দেব।” তবে ‘সাদা খাম’ নেওয়ার প্রসঙ্গে এ দিন তিনি কিছুটা রক্ষণাত্মক। তাঁর যুক্তি, “আমি বলেছি, সাদা খাম নিতেন। তাতে কী থাকত, তা তো বলিনি!”
এমতাবস্থায় পুরমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়েছেন রাজ্যের আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। যিনি এ দিন গোপন জবানবন্দির নতুন এক আইনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন, “১৬৪ ধারায় গোপন জবানবন্দির অর্থ, জবানবন্দি গোপনে দেওয়া। এক বার দেওয়ার পরে তা আদালতের সম্পত্তি। বাইরে বেরোতেই পারে।” কিন্তু মামলায় চার্জশিট পেশের আগে কি তা অন্যের হাতে আসতে পারে?
আইনমন্ত্রীর দাবি, পারে। তৃণমূল আইনজীবী সেলের সদস্য, হাইকোর্টের আইনজীবী রাজদীপ মজুমদারেরও যুক্তি, “যিনি গোপন জবানবন্দি দিয়েছেন, তিনি তো বাইরে বলতেই পারেন! পুলিশের কেস ডায়েরিতেও গোপন জবানবন্দির উল্লেখ থাকে! এতে তেমন অপরাধের কিছু নেই।”
এ হেন যুক্তির তীব্র বিরোধিতা করেন আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ। তাঁর ব্যাখ্যা, “গোপন জবানবন্দি বন্ধ খামে ভরা থাকে। চার্জশিট দেওয়ার আগে খোলাই যায় না। চার্জশিটের সময়ে অভিযুক্তকে জানানো হয়। পরে কেউ আদালতে আবেদন করে তা হাতে পেতে পারেন।” কিন্তু এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মামলায় চার্জশিট পেশ হয়নি। “তাই জবানবন্দি প্রকাশ্যে আসারও প্রশ্ন ওঠে না।” জানাচ্ছেন অরুণাভবাবু। তাঁর মন্তব্য, “ববি হাকিম আদালতের গোপন জবানবন্দি জানলেন কী করে? মন্ত্রীর দাবি সত্যি হয়ে থাকলে যে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গোপন জবানবন্দি দেওয়া হয়েছে, তাঁর বিরুদ্ধে অবিলম্বে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হওয়া উচিত। মন্ত্রীর দাবি সত্যি হলে বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাবে। এ ব্যাপারে আমি কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।”
কলকাতা পুলিশের পদস্থ কর্তাদের একাংশও জানাচ্ছেন, গোপন জবানবন্দিতে ঠিক কী বলা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ গোপন রাখাই নিয়ম। এক পুলিশ-কর্তার কথায়, “গোপন জবানবন্দি আদালতের সম্পত্তি। মামলা চলাকালীন বিচারকের নির্দেশে তদন্তকারী অফিসার তদন্তের স্বার্থে তা পড়ে দেখতে পারেন। কারণ, তদন্ত এগোতে সাহায্য করার মতো কিছু সূত্র তাতে থাকতে পারে। মামলা চলাকালীন সাক্ষী বয়ান পাল্টালেও জবানবন্দিতে থাকা বয়ানের ভিত্তিতে তাঁকে জেরা করা হয়।” তবে গোপন জবানবন্দি যে কোনও মতেই প্রকাশ্যে আনা বা সংবাদপত্রে প্রকাশ করা চলে না, তিনি তা পরিষ্কার করে দিয়েছেন।
ঘটনাটির মধ্যে চক্রান্তের গন্ধও পাচ্ছেন আইনজীবীদের একাংশ। কী রকম? আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “ববি হাকিম আদৌ জবানবন্দি দেখে বলছেন কিনা, তার প্রমাণ নেই। আসলে সারদা নিয়ে রাজ্যের বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্টে সমালোচিত। তাই এখন তারা চেষ্টা করছে সারদা-কেলেঙ্কারির তদন্তকে আরও লঘু করে দেওয়ার। এ হয়তো তারই অঙ্গ।” একই সঙ্গে বিকাশবাবুর বক্তব্য, “জবানবন্দি সত্যি কোর্টের বাইরে বেরিয়ে গেলে আদালত মামলাটির তদন্তকারী অফিসারের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে পারে। একমাত্র অভিযুক্তকে চার্জশিট
দেওয়ার সময়ে জবানবন্দি পাঠানো হয়, যাতে অভিযুক্ত জানতে পারেন তাঁর বিরুদ্ধে কী অভিযোগ।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy