Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
জলপাইগুড়ি

চা বাগানে কমলালেবু, তেজপাতা ফলিয়ে লাভ

বিকল্প চাষের খোঁজে ময়নাগুড়ির হুসলুরডাঙা গ্রামের মনোজ রায় বছর ষোলো আগে ধান আর সব্জি চাষের জমিতে চা বাগান তৈরি করেছিলেন। পাঁচ একর জমিতে বোনা চা গাছ প্রথম কয়েক বছর ভাল লাভও দিয়েছিল। এখন আর চা পাতার দাম মিলছে না।

ফলেছে কমলালেবু। নিজস্ব চিত্র।

ফলেছে কমলালেবু। নিজস্ব চিত্র।

বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৫ ০২:৩৪
Share: Save:

বিকল্প চাষের খোঁজে ময়নাগুড়ির হুসলুরডাঙা গ্রামের মনোজ রায় বছর ষোলো আগে ধান আর সব্জি চাষের জমিতে চা বাগান তৈরি করেছিলেন। পাঁচ একর জমিতে বোনা চা গাছ প্রথম কয়েক বছর ভাল লাভও দিয়েছিল। এখন আর চা পাতার দাম মিলছে না। তাই বিকল্প হিসেবে চা গাছের ছায়ায় কমলালেবু আর তেজপাতা ফলাচ্ছেন মনোজবাবু।

সব্জি ও ধান চাষের জমিতে চা বাগান তৈরির মোহ ঠেকাতে বরাবরই প্রচার চালিয়ে গিয়েছে কৃষি দফতর। জলপাইগুড়ি মহকুমার কৃষি ও উদ্যান পালন দফতরের কর্তারা গ্রামে গ্রামে ঘুরে সভা করে চাষিদের বুঝিয়েছেন। তবে লাভ যে বিশেষ হয়নি তা পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট। কৃষি দফতরের সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, জলপাইগুড়ি মহকুমায় ৩০ শতাংশের বেশি সব্জি চাষের এলাকা চা বাগানের দখলে চলে গিয়েছে। এক দশক আগে মহকুমায় প্রায় ২৭ হাজার হেক্টর জমিতে সব্জি চাষ হত। সেটা কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৬ হাজার হেক্টর। বেশি সব্জি চাষের এলাকা নষ্ট হয়েছে ময়নাগুড়ি, জলপাইগুড়ি সদর, রাজগঞ্জ ব্লকে।

জেলা ক্ষুদ্র চা চাষি সমিতির পরিসংখ্যানও বলছে, ২০০১ সালে মহকুমার ৮ হাজার সাতশো একর জমিতে ১ হাজার ৮২৪ টি ছোট চা বাগান ছিল। বর্তমানে প্রায় ৫০ হাজার একর জমিতে বাগানের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২০ হাজার। মহকুমা কৃষি আধিকারিক হরিশ্চন্দ্র রায় মানছেন, “শুধু সব্জি চাষের উঁচু জমি নয় ধান চাষের এলাকাতেও নতুন চা বাগান গড়ে উঠছে। প্রচার করে লাভ হচ্ছে না।” প্রচারে যে কাজ হয়নি, বাস্তব পরিস্থিতি কিন্তু সেই কাজটাই সহজ করে দিয়েছে। ঠেকে শিখে চাষিরা এখন নিজেরাই চা চাষ থেকে মুখ ফেরাচ্ছেন। কয়েক বছর হল কাঁচা চা পাতার বাজারে মন্দা। দাম মিলছে না। এই পরিস্থিতিতে যে সব চাষিরা এক সময় বাড়তি মুনাফার জন্য সব্জি বা ধান চাষের জমিতে চা গাছ বুনেছিলেন, তাঁরাই এখন চা বাগানে কমলালেবু বা তেজপাতা ফলাচ্ছেন। বিকল্প চাষে লাভও হচ্ছে ভালই।


চা বাগানে তেজপাতা। ছবি: দীপঙ্কর ঘটক।

হুসলুরডাঙার চাষি মনোজবাবু গত পাঁচ বছর ধরে চা চাষে আর তেমন দাম পাচ্ছিলেন না। উৎপাদন খরচ উঠছিল না। মনোজবাবুর কথায়, “একর প্রতি চাষে খরচ দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লক্ষ টাকা। অথচ চা পাতা বিক্রি করে আসছে ৮০ হাজার টাকা। পরিস্থিতি এমন যে ১৪ জন শ্রমিকের মজুরি দিতে পারছি না।”

অবস্থা বেগতিক দেখে মনোজবাবু দু’বছর আগে চা বাগানে ছায়া গাছ হিসেবে আড়াইশো তেজপাতা বুনেছিলেন। বছরে ৪৫ হাজার টাকার তেজপাতা বিক্রি হচ্ছে। গত বছর কার্শিয়াঙের শিটং থেকে সাতশো কমলালেবুর চারা কিনে এনে বুনেছেন। লেবু গাছও বেড়ে উঠেছে। আগামী বছর থেকে ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে। মনোজবাবু মানছেন, “নিরুপায় হয়ে ঝুঁকি নিতে হল।” জেলা ক্ষুদ্র চা চাষি সমিতির সভাপতি রজত কার্জিরও বক্তব্য, এক কেজি পাতা উৎপাদন করতে খরচ পড়ে ১৩ টাকা। কিন্তু বিক্রি করে গড়ে ১০ টাকার বেশি পাওয়া যায়নি। বাধ্য হয়ে চাষিরা বিকল্প চাষের কথা ভাবছেন।

মনোজবাবুর উদ্যোগ দেখে পড়শি চাষি দীপক বর্মণ, সরেন রায়রাও একই কায়দায় কমলালেবুর বাগান তৈরির কথা ভাবছেন। একই ভাবে রাজগঞ্জ ব্লকের সুকুমার সরকার ছ’বিঘা জমিতে চা গাছের সঙ্গেই তেজপাতার চাষ করে ভাল লাভ পেয়েছেন। জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের চাউলহাটি এলাকার অনুকূল বর্মন আবার সাড়ে চার বিঘার চা বাগানে আদা এবং হলুদ চাষ করছেন। চাষিদের এই উদ্যোগে খুশি উদ্যান পালন দফতরের আধিকারিকরা। দফতরের জলপাইগুড়ি জেলা আধিকারিক শুভাশিস গিরি বলেন, “এটা খুব ভাল লক্ষণ যে চাষিরাই অবশেষে বিকল্প চাষের কথা ভাবছেন।”

এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছে কৃষি দফতরও। জলপাইগুড়ি মহকুমা কৃষি আধিকারিক হরিশ্চন্দ্রবাবুর মতে, সব্জি ও ধান চাষের জমি সঙ্কুচিত হয়ে গেলে বিপদ। আর এক বার চা বাগান হয়ে গেলে সেই জমিতে সহজে অন্য চাষ করা সম্ভব নয়। তাই চাষিরা নিজে থেকে চা বাগানে কমলালেবু, তেজপাতা চাষ করলে ভাল। এতে ভবিষ্যতে ওই জমিতে ফের ধান বা সব্জি ফলানো সম্ভব হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE