Advertisement
০৪ মে ২০২৪

জঙ্গলমহলে বনপার্টির নয়া নেতা অপুদা

বিমলদা, কিরণদা, বিকাশদার পর এ বার অপুদা। জঙ্গলমহলে ভেঙে যাওয়া সংগঠন নতুন করে গড়ার লক্ষ্যে আরও এক ‘দাদা’-কে হাজির করেছে মাওবাদীরা।

অদূরেই ঝাড়খণ্ড। এই রাস্তাতেই পড়ে ছিল মাওবাদী পোস্টার।— নিজস্ব চিত্র

অদূরেই ঝাড়খণ্ড। এই রাস্তাতেই পড়ে ছিল মাওবাদী পোস্টার।— নিজস্ব চিত্র

সুরবেক বিশ্বাস
বেলপাহাড়ি শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:০৫
Share: Save:

বিমলদা, কিরণদা, বিকাশদার পর এ বার অপুদা। জঙ্গলমহলে ভেঙে যাওয়া সংগঠন নতুন করে গড়ার লক্ষ্যে আরও এক ‘দাদা’-কে হাজির করেছে মাওবাদীরা।

বেলপাহাড়ি থেকে পশ্চিমে কাঁকরাঝোড় জঙ্গলে যাওয়ার পথে বোদাদিহি মোড় থেকে বাঁ দিকে বেঁকেছে মোরাম রাস্তা। সেখানে পর পর পাথরচাকরি, শাখাভাঙা এবং জামাইমারির মতো ঝাড়খণ্ড ঘেঁষা বাংলার গ্রাম। শিমুলপাল গ্রাম পঞ্চায়েতের ওই তল্লাটেই প্রথম কানে আসে অপুদার নাম। এক প্রবীণ কথায় কথায় বলেন, ‘‘বনপার্টির অপুদা এখানে বার কয়েক এসেছে বটে। মিটিংও করে গিয়েছে।’’

স্কোয়াডে নেতার যে নাম, তার সঙ্গে দাদা যোগ করে মাওবাদী নেতাদের একাংশকে সম্বোধন করার রেওয়াজ লাল মাটির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেণজি এক সময়ে বিমলদা নামে পরিচিত ছিলেন লালগড়ে। সেখানকার ভূমিপুত্র শশধর মাহাতো হয়ে গিয়েছিলেন কিরণদা। গোয়ালতোড়ের মনসারাম হেমব্রম লালগড় আন্দোলন ইস্তক তরুণদের কাছে এখনও পরিচিত বিকাশদা নামে। প্রবীণ মাওবাদী নেতা প্রশান্ত বসু যেমন কিষেণদা।

শিমুলপাল অঞ্চলের মানুষের একাংশের কথায় পরিষ্কার, মোটামুটি এই বছরের গোড়া থেকেই অপুদাকে সামনে রেখে বেলপাহাড়ির হারানো জমি উদ্ধারে নেমেছে মাওবাদীরা। গ্রামবাসীদের বক্তব্য, অপুদার বয়স তিরিশের কোঠায়, বাংলা ও হিন্দিতে চোস্ত, সাঁওতাল ভাষা অল্পসল্প জানেন এবং তিনি বাগ্মী।

জামাইমারির এক যুবকের কথায়, ‘‘অপুদা যে সব সময়ে স্কোয়াডের সঙ্গে আসে এমনটা নয়। তবে ও-ই যে নেতা, তাতে সন্দেহ নেই।’’ কেন? ওই যুবক বললেন, ‘‘সম্প্রতি মাঝরাতে ওদের মিটিংয়ে গ্রামের কিছু লোক একটা ব্যাপারে সাহায্য চেয়েছিল। মিটিংয়ে অপুদা ছিল না। অন্যরা বলে— অপুদাকে নিয়ে আসব। এটা ওকেই বোলো।’’

স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, একশো দিনের কাজ না-পাওয়া কিংবা এক বছর আগের কাজের মজুরি না-পাওয়া নিয়ে গ্রামবাসীদের ক্ষোভের কথা মাওবাদীরা শুনছে। আর শাসক দলের যে সব নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, তাদের তালিকা তৈরি করছে। সবই হচ্ছে রাতের অন্ধকারে। প্রাক্-লালগড় আন্দোলন পর্বে যেমন হতো। আর অল্প হলেও নতুন সদস্য নিয়োগ ও লিঙ্কম্যান তৈরির কাজও করেছে মাওবাদীরা।

তার বড় প্রমাণ— স্থানীয় চিড়াকুটি গ্রামে পিচরাস্তার উপর মাওবাদী পোস্টার পড়া। বেলপাহাড়িতে তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় গত ১৭ জুলাই বলেন, কিষেণজিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারই হত্যা করেছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পড়ে পোস্টার। চিড়াকুটির ওদলচুয়া হাইস্কুলে ১৭ অগস্ট কালো পতাকাও তোলে মাওবাদীরা।

চিড়াকুটি গ্রামের চামুলাল সিংহ জানান, ১৪ থেকে ১৬ অগস্ট ওই স্কুলে ঘাঁটি গেড়েছিল যৌথবাহিনী। তারা চলে যাওয়ার পরেই স্কুল চত্বরে ও পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছের গায়ে কালো পতাকা টাঙিয়ে দেওয়া হয়। খেতমজুর দীপেন মাহাতো বলেন, ‘‘পোস্টার ফেলা আর কালো পতাকার ঘটনায় গ্রামের কিছু লোকের হাত আছে। বাইরে থেকে এসে এত অল্প সময়ে মাওবাদীদের পক্ষে এই কাজ করা সম্ভব নয়।’’ কিন্তু কারা তারা? দীপেনবাবুর সাফ কথা, ‘‘জানি, কিন্তু বলব না। আমার বিপদ হলে কে দেখবে? পুলিশকেও সেই কথাই বলেছি।’’

বেলপাহাড়ি পঞ্চায়েত সমিতির কংগ্রেস সদস্য ও ঝাড়গ্রাম জেলা কংগ্রেসের মুখ্য আহ্বায়ক সুব্রত ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘জুলাইয়ের শেষ থেকে অগস্টের গোড়া পর্যন্ত শহিদ সপ্তাহ পালনের সময়ে মাওবাদীরা পুরনো কায়দায় বেলপাহাড়ি ও জড়কডাঙার মাঝখানে রাস্তা কেটে দেয়। পুলিশের উদ্যোগে দ্রুত তা সারিয়ে ফেলা হয়।’’ বেলপাহাড়ি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ও ব্লক তৃণমূল সভাপতি বংশীবদন মাহাতোও স্বীকার করছেন, ‘‘অনুন্নয়নের কথা প্রচার করে মাওবাদীরা সমর্থন পাচ্ছে।’’

এই সব কিছুই ‘অপুদা’-র নেতৃত্বে হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কিন্তু কে এই অপুদা? আসল নামটা কেউ বলতে পারছেন না।

লালগড় আন্দোলনের সময়ে মাওবাদী স্কোয়াডে চলে গিয়ে পরে মূলস্রোতে ফিরে আসা কাঁটাপাহাড়ির এক যুবক বলেন, ‘‘সেই সময়ে প্রথম অপুদার নাম শুনি। বাঁকুড়ার দিকে সংগঠন করত। জঙ্গলমহলের কলেজে কলেজে ছাত্র সংগঠন তৈরির দায়িত্বে ছিল অপুদা।’’

এখনও লালগড়ের বেলাটিকরি, শ্যামচরণ ডাঙায় অপুদার নিয়মিত আনাগোনা রয়েছে, বলছেন বাসিন্দারা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, ‘‘তালড্যাংরার কাছে ছাগুলিয়া, নাকাইজুড়ি, তালবান্দি, মদনপুরের মতো গ্রামের মানুষ বছর পাঁচ-ছয় আগে অপুদার কথা বলেছিল। যেটুকু বুঝেছিলাম, ওই ছেলেটির সাংগঠনিক দক্ষতা রয়েছে।’’

সেই অপুদাই কি এই অপুদা? সেটাই এ বার খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bon party Apu Da belpahari
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE