Advertisement
১১ মে ২০২৪
কবে নালিশ ঠুকবেন? ব্যস্ত পুলিশই

জমি মালিক নয়, মামলা কর্মচারীর বয়ান পেয়েই

প্রাক্তন তৃণমূল নেতা আসিফ খানকে গ্রেফতার করতে কম কাঠ-খড় পোড়াতে হয়নি পুলিশকে! অভিযোগ, রাজারহাটে ১০০ বিঘা জমি পাইয়ে দেবেন বলে ২০১২ সালে রাজারাম শরাফ নামে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৮ কোটি টাকা নিয়েছিলেন আসিফ। কিন্তু জমি দেননি। দু’বছর পরে সেই অভিযোগের ভিত্তিতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ গ্রেফতার করেছে আসিফকে। এমন একটি সময়ে এই গ্রেফতার, যখন সারদা মামলায় তৃণমূলের নেতা-নেত্রীদের নাম প্রকাশ্যে আনছিলেন আসিফ।

নিজের দফতরে বসে রাজারাম শরাফ। পাশে দাঁড়িয়ে ম্যানেজার কৃষ্ণপ্রসাদ সিংহ। শুক্রবার। —নিজস্ব চিত্র।

নিজের দফতরে বসে রাজারাম শরাফ। পাশে দাঁড়িয়ে ম্যানেজার কৃষ্ণপ্রসাদ সিংহ। শুক্রবার। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:৪৬
Share: Save:

প্রাক্তন তৃণমূল নেতা আসিফ খানকে গ্রেফতার করতে কম কাঠ-খড় পোড়াতে হয়নি পুলিশকে!

অভিযোগ, রাজারহাটে ১০০ বিঘা জমি পাইয়ে দেবেন বলে ২০১২ সালে রাজারাম শরাফ নামে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৮ কোটি টাকা নিয়েছিলেন আসিফ। কিন্তু জমি দেননি। দু’বছর পরে সেই অভিযোগের ভিত্তিতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ গ্রেফতার করেছে আসিফকে। এমন একটি সময়ে এই গ্রেফতার, যখন সারদা মামলায় তৃণমূলের নেতা-নেত্রীদের নাম প্রকাশ্যে আনছিলেন আসিফ। দাবি করছিলেন, এক সময়ে তৃণমূল নেতা মুকুল রায়ের ঘনিষ্ঠ সহচর হওয়ার সুবাদে তিনি অনেক তথ্যই জানেন।

কী ভাবে গ্রেফতার হলেন আসিফ? রাজারামকে শুক্রবার সন্ধ্যায় পাওয়া গেল তাঁর অফিসে। তিনিই বিস্তারিত জানালেন আসিফকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশের তৎপরতার কথা। পুলিশের খাতায় অবশ্য অভিযোগকারী হিসেবে নাম নেই রাজারামের। রয়েছে কৃষ্ণপ্রসাদ সিংহের নাম। যিনি রাজারামের সংস্থার এক জন ম্যানেজার।

রাজারামের বয়ান অনুযায়ী, ২০১২ সালে ৮ কোটি টাকা দেওয়ার পরে জমি বা টাকা কোনওটাই না-পেয়ে গত সেপ্টেম্বর মাসে তিনি আসিফের নামে অভিযোগ করবেন বলে বিধাননগর পুলিশের কাছে যান। কিন্তু সে দিন বিধাননগরের কমিশনার রাজীব কুমারের সঙ্গে দেখা করে মৌখিক অভিযোগ জানালেও লিখিত ভাবে কিছু দেননি।

কেন? রাজারাম বলেন, “ভয় লাগছিল। ক্ষমতাবান লোকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তো! রাজীব কুমারকে বলে এসেছিলাম, ভেবে জানাব।” এর ক’দিনের মধ্যে ব্যবসার কাজে সৌদি আরব চলে যান রাজারাম। তাঁর দাবি, সেই সময় বিধাননগর পুলিশের কাছ থেকে একের পর এক ফোন আসতে শুরু করে তাঁর রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডের অফিসে। ফোন ধরছিলেন তাঁর ম্যানেজার কৃষ্ণপ্রসাদ সিংহ।

ফোন করে কী বলছিল পুলিশ?

রাজারামবাবু এ বার কৃষ্ণপ্রসাদকে ডেকে নেন ঘরে। তাঁর সামনেই বলেন, “পুলিশ বারবার ফোন করে জিজ্ঞাসা করছিল, আমি কবে অভিযোগ জানাতে যাব। কৃষ্ণই বারবার ফোন ধরছিল। এর পর এক দিন সে সৌদি আরবে ফোন করে বিষয়টি আমাকে জানায়। আমি বলি, এ বার ফোন করলে তুমি চলে যেও। দেখে এসো, কী জানতে চাইছে পুলিশ।” মালিকের সেই নির্দেশ পেয়ে বিধাননগর কমিশনারেটে গিয়ে সেই অফিসারের সঙ্গে দেখা করেন কৃষ্ণপ্রসাদবাবু।

কৃষ্ণপ্রসাদবাবু জানান, আসিফের বিরুদ্ধে রাজারামের কী কী অভিযোগ রয়েছে, তা সে দিন তিনি পুলিশ অফিসারকে জানান। পুলিশ তাঁর সেই বয়ান লিখে নেয়। পুলিশ যে বয়ান লিখে নিল, তা কৃষ্ণপ্রসাদবাবু কি রাজারামকে জানিয়েছিলেন? শুক্রবার কৃষ্ণপ্রসাদবাবু বলেন, “হ্যাঁ, কমিশনারেট থেকেই সৌদি আরবে রাজারামকে ফোন করেছিলাম। উনি (রাজারাম) বলেন, তুমি সত্যি কথা বল। পুলিশ লিখে নিলে লিখে নিক।” বয়ান লেখার পরে কৃষ্ণপ্রসাদবাবুর ঠিকানা ও বাবার নাম জেনে নেয় পুলিশ। এর পরে তাঁর নাম করেই আসিফের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়ে যায়। রাজারাম তখনও বিদেশে।

রাজারাম জানাচ্ছেন, তিনি বিদেশে গিয়েছিলেন সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। ফিরে আসেন এক সপ্তাহ পরে। তার পরে তিনি থানায় গিয়ে অভিযোগ জানালেন না কেন? রাজারামের জবাব, “আমি কৃষ্ণকে নিয়ে ফের বিধাননগর পুলিশের কাছে যাই। রাজীব কুমারের সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাকে বলেন, ভেবে দেখুন, অভিযোগ জানাবেন কি না! চাইলে তুলেও নিতে পারেন। আমি পড়ে দেখি, কৃষ্ণ যা বলেছে তা পুরোপুরি ঠিক। তখন ওই বয়ানের উপরেই অভিযোগ করা হবে বলে ঠিক হয়।”

কৃষ্ণপ্রসাদবাবু অবশ্য দাবি করছেন, তাঁর বয়ানের উপরে ভিত্তি করে যে অভিযোগ করা হবে, সেটা মোটেই তাঁর জানা ছিল না। এ দিন দুপুরে আসিফের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী হিসেবে তাঁর নাম রয়েছে শুনে আকাশ থেকে পড়েন তিনি। অবাক হয়ে বলেন, “কই! আমি তো কোনও অভিযোগ করিনি! আমি তো সাধারণ এক জন কর্মচারী। আমি তো কোনও জমি কিনিনি। তা হলে আমি অভিযোগ করতেই বা যাব কেন?”

যে ভয়ে দু’বছর ধরে আসিফের বিরুদ্ধে নিজে অভিযোগ করেননি, সেই ভয়েই কি রাজারাম সামনে এগিয়ে দিলেন এক কর্মচারীকে? রাজারামের জবাব, “পুলিশ যদি ওর বয়ানের উপরে ভিত্তি করে অভিযোগ লিপিবদ্ধ করে তা হলে আমার কী-ই বা বলার থাকতে পারে!”

এখন প্রশ্ন হল, এক জন অভিযোগকারী যদি বলেন যে তিনি পরে এসে অভিযোগ জানাবেন, তা হলে কি প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বারবার ফোন করেন পুলিশ অফিসারেরা? যিনি প্রতারিত হলেন, তাঁর জায়গায় অন্য কেউ অভিযোগ করলে সেটা কি গ্রহণযোগ্য হয় পুলিশের কাছে?

এই প্রশ্নের উত্তর পেতে এ দিন সন্ধ্যায় বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকে ফোন করা হয়েছিল। তাঁর ফোন বেজে যায়। এসএমএস করলেও জবাব পাওয়া যায়নি।

কৃষ্ণপ্রসাদবাবুর নামে দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে শুক্রবার বারাসত আদালতের ভারপ্রাপ্ত মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট দেবাশিস সাঁতরার এজলাসে আসিফ খানের বিরুদ্ধে মামলাটি ওঠে (নিউটাউন থানার কেস নম্বর ২৯৫)। অভিযুক্তের আইনজীবীরাও কয়েকটি অসঙ্গতির কথা উল্লেখ করে প্রশ্ন তোলেন, কেন এত দিন পরে মামলা দায়ের করা হল। রাজারামবাবু মুখে ১০০ বিঘা জমি প্রতারণার কথা বললেও অভিযোগে লেখা রয়েছে ২৮২ একর জমি। আইনজীবীদের প্রশ্ন, নিউটাউনে এত পরিমাণ জমি কেনার মতো ক্ষমতা অভিযোগকারীর কি আছে?

আসিফকে এ দিন অবশ্য আদালতে তোলা হয়নি। তাঁকে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এ দিন আসিফকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ তাঁর বুকে ব্যথা ফের বাড়তে থাকে বলে হাসপাতাল সূত্রে খবর। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তাঁর ডায়াবিটিস এবং হাইপারটেনশনও রয়েছে। সব মিলিয়ে যে কোনও সময়ে অবস্থার অবনতি ঘটতে পারে। সেই আশঙ্কাতেই এ দিন দুপুরে তাঁর ইকো কার্ডিওগ্রাম এবং সিটি স্ক্যান হয়। আসিফ খানের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঁচ জন চিকিৎসকের একটি বোর্ড তৈরি হয়েছে।

শনিবার সকালে বোর্ডের সদস্যরা ফের তাঁকে দেখবেন। তার পরেই হাসপাতাল থেকে ছাড়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

asif khan tmc bidhannagar police commissionerate
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE