Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

দিনভর চলল ‘ভোট-লুঠ’, সব দেখেও সুশান্ত শান্তই

ঢাল, তরোয়াল সবই আছে। কিন্তু তার কোনটারই ব্যবহার তিনি করলেন না! বরং চুপচাপ বসে থেকে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় প্রমাণ করে দিলেন, ভোটারদের কোনও রকম নিরাপত্তা দিতে তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ!

সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়

সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:১৭
Share: Save:

ঢাল, তরোয়াল সবই আছে। কিন্তু তার কোনটারই ব্যবহার তিনি করলেন না! বরং চুপচাপ বসে থেকে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় প্রমাণ করে দিলেন, ভোটারদের কোনও রকম নিরাপত্তা দিতে তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ! শনিবার নির্বাচন কমিশনের এমন ভূমিকায় শুধু যে সব স্তরে ক্ষোভ ছড়িয়েছে, তা-ই নয়। বিধাননগর এবং হাওড়ায় বহিরাগত দুষ্কৃতী ও পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে

শাসক দল ভোট লুঠ করেছে বলে অভিযোগ তুলে সব বিরোধী দল একযোগে নির্বাচন বাতিলের দাবি তুলেছে। সিপিএম, বিজেপি, কংগ্রেস সবাই একবাক্যে জানিয়ে দিয়েছে, নতুন করে ফের নির্বাচনের দিন ঘোষণা করতে হবে।

ডব্লিউবিসিএস অফিসার থেকে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার হওয়া সুশান্তরঞ্জন অবশ্য ভোট বাতিল করার পথে হাঁটবেন না বলেই জানিয়ে দিয়েছেন। দিনভর সল্টলেক থেকে আসানসোল বা বালি— সর্বত্র এই সর্বগ্রাসী গোলমালের পরেও তাঁর জবাব, ‘‘অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোট হয়েছে, বলছি না। বিধাননগরের ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৮-৯টি ওয়ার্ডে কিছু অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে।’’

তাঁর কথা মতো, বিধাননগরের ৪১, ৩২, ৩৩, ২৫, ২১, ৯ ও ৩৮ নম্বরে ওয়ার্ডে গোলমালের খবর পাওয়া গিয়েছে। এ ছাড়া আসানসোলের ৪টি ও হাওড়ার ৪টি ওয়ার্ডে গোলমাল হয়েছে। বিরোধীরা পুরো নির্বাচনই বাতিল করার যে দাবি তুলেছে, তা খারিজ করে তিনি জানিয়েছেন, রিটার্নিং অফিসারের রিপোর্ট দেখেই পুনর্নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হবে।

মীরা পাণ্ডের পর যখন রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্বে ডব্লিউবিসিএস অফিসার সুশান্তবাবুকে আনা হয়, তখনই প্রশ্ন উঠেছিল, তিনি কি পূর্বসূরির মতো নিজের সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে সমান তালে টক্কর দিতে পারবেন রাজ্য সরকারের সঙ্গে? ২০১০ সালে বাম জমানায় কলকাতা পুরসভার নির্বাচনে তিনি কেন্দ্রীয় বাহিনী এনে ভোট করিয়েছিলেন। পরে ২০১৩ সালে মমতার জমানাতেও পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে এই নিয়ে তাঁর সঙ্গে রাজ্য সরকারের মতপার্থক্য হয়। নিজের সাংবিধানিক অধিকার আদায়ে তিনি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গিয়েছিলেন।

সেই মামলায় সুপ্রিম কোর্ট যে ধারাটির কথা উল্লেখ করেছিল, এ দিন বিরোধীরাও সংবিধানের সেই ২৪৩কে ধারার প্রসঙ্গ তুলে বলেন, সেই আইন অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচন কমিশনের মতোই রাজ্য নির্বাচন কমিশনও বিপুল ক্ষমতার অধিকারী। অবাধ ও শন্তিপূর্ণ নির্বাচন করার জন্য সব রকম ক্ষমতা ব্যবহার করার যাবতীয় সুযোগ রয়েছে তাদের হাতে। কিন্তু অভিযোগ, বাস্তবে তার কোনও প্রয়োগ করতে পারেননি সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়। কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়ে দিয়েছিল, রাজ্যে যে ৬ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী রয়েছে, তিনটি পুর নিগমের নির্বাচনে কমিশন তা ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু তা হয়নি। আর বহিরাগত ও বাইকবাহিনী নিয়ন্ত্রণে কমিশনের নির্দেশকে পুলিশ তথা সরকার তো পাত্তাই দেয়নি! কমিশন অবশ্য চুপচাপই থেকেছে, বলছেন বিরোধীরা! তারই জেরে তাঁদের এ দিন একযোগে গোটা ভোটটাই বাতিলের দাবি। যা শুনে মীরাদেবী বলেন, ‘‘আমার জানা নেই যে, কোথাও পুরসভা বা পঞ্চায়েতের হয়ে যাওয়া ভোটের পুরোটাই এ ভাবে বাতিলের দাবি ওঠেছে!’’ তিনি জানান, কোনও নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতা রয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে তিনি ওই সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন।

এ দিন সকাল থেকেই বিধাননগরে বহিরাগতদের তাণ্ডব শুরু হয়ে যায়। বিভিন্ন জায়গায় ছাপ্পা ভোট দেওয়া তো ছিলই, তার সঙ্গে শুরু হয় ভোটারদের হুমকি দেওয়া, এজেন্টদের মারধর, সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের উপর দলবদ্ধ আক্রমণ, মার, ক্যামেরা ভাঙা। এবং তার সিংহ ভাগই হয়েছে পুলিশের সামনে! সাতসকালেই শাসক দলের ভোট লুঠের ওই ছবি টেলিভিশনের সৌজন্যে রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। অসংখ্য বৈধ ভোটার ভোট দিতে না পেরে সংবাদমাধ্যমের সামনে ক্ষোভ উগরে দেন। ভোট লুঠের অভিযোগ জানিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সকাল থেকে নির্বাচন কমিশনারের কাছেও ফোন করে অভিযোগ জানায়। কিন্তু দিনের শেষে অভিযোগকারী নেতাদের বক্তব্য, সবই ‘ভস্মে ঘি ঢালা’ হয়েছে! টিভিতে সব দেখে, ফোনে জানার পরেও সুশান্তবাবু বিরোধী প্রার্থী ও ভোটারদের নিরাপত্তার কোনও ব্যবস্থাই করতে পারেননি বলে তাঁদের অভিযোগ। বরং কমিশন সূত্রে জানা গিয়েছে, সরকারি কর্মী ও কমিশনের কর্মীদের প্রতি তাঁর নির্দেশ নিয়ে শাসক দল যাতে ক্ষুব্ধ না হয়, তা নিশ্চিত করতে ভোটের দিন সকাল থেকে নিজের চেম্বারে তৃণমূলের এক প্রাক্তন কাউন্সিলারের জামাইকে বসিয়ে রেখে ছিলেন! যিনি পদাধিকার বলে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের এক জন করনিক (হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট)।

সুশান্তর ঘরের সামনে এ দিন যে ভাবে বিরোধী দলগুলি অবস্থানে বসেছে, তা আগের কোনও নির্বাচনে দেখা যায়নি। বিকেল ৩টে নাগাদ বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের ঘরের সামনে ধর্নায় বসে যান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন শিশির বাজোরিয়া, রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, লকেট চট্টোপাধ্যায়-সহ অন্য নেতারা। রাহুল বলেন, ‘‘আমরা বহু দিন ধরেই বলছিলাম যে, উনি পারছেন না, ছেড়ে দিন। কিন্তু তা তিনি করছেন না!’’

এর কিছু পরেই কমিশনারের সঙ্গে দেখা করতে আসেন কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য। আরও পরে সিপিএম নেতা রবীন দেব। তাঁরাও কমিশনারের কাছে নির্বাচন বাতিলের দাবি জানান। প্রদীপবাবু বলেন, ‘‘বিধাননগরে কোন নির্বাচনই হয়নি। হাওড়াতেও একই অবস্থা। আমরা বলেছি নতুন করে ফের নির্বাচন করতে হবে।’’ রবীনবাবু বলেন, ‘‘ভোট যে শান্তিপূর্ণ ভাবে হবে না, সে কথা আমরা আগেই কমিশনারকে জানিয়েছিলাম। কিন্তু উনি কোনও ব্যবস্থা নেননি। আজই নির্বাচন বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা জানাতে হবে। না হলে অবস্থান চলবে।’’ রাতে সিপিএম ও বিজেপি নেতাদের সঙ্গে আলাদা করে বৈঠক করেন সুশান্ত। সেখানে ঠিক হয়েছে, হাওড়া ও বিধাননগর নিয়ে তাদের সিদ্ধান্ত আজ, রবিবার বিকেল ৫টার মধ্যে কমিশন জানিয়ে দেবে বিজেপি ও সিপিএম নেতৃত্বকে। এর পরে রাতেই বামফ্রন্ট ও বিজেপি তাদের অবস্থান তুলে নেয়।

পড়ুন: পাছে দাপট কমে যায়, শাসকের ভরসা তাণ্ডবে

পড়ুন: বেঁচে ফেরার অভিজ্ঞতা

পড়ুন: ভোট দেওয়াই হল না, গেরো রহস্যের মেরো

পড়ুন: সাংবাদিক নিগ্রহের নিন্দা, গ্রেফতারির দাবি

পড়ুন: ভোট করাল ভজাইরা, পাহারা দিল পুলিশই

পড়ুন: এ রকম ‘পিসফুল’ ভোটই ভাল, তাই না!

পড়ুন: ইহারা জননীর গর্ভের লজ্জা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE