Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
রাকেশ হটাও দাবি প্রবল

দিল্লির দরবারে অভিযোগ বিরোধীদের

পশ্চিমবঙ্গের তৃতীয় দফার ভোটে কারচুপি ঠেকাতে ব্যর্থ, এই অভিযোগ তুলে নির্বাচন কমিশনের বিশেষ পর্যবেক্ষক সুধীরকুমার রাকেশের অপসারণ দাবি করল কংগ্রেস এবং সিপিএম। নির্বাচন কমিশনের বিশেষ পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় হতাশ বিজেপি-ও। আজ, শনিবার এ ব্যাপারে বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দিল্লিতে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের বক্তব্য জানাবেন।

তমলুকে জেলা প্রশাসনিক ভবনে বৈঠকে ঢোকার আগে সুধীরকুমার রাকেশ। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস।

তমলুকে জেলা প্রশাসনিক ভবনে বৈঠকে ঢোকার আগে সুধীরকুমার রাকেশ। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৪ ০৩:৩৭
Share: Save:

পশ্চিমবঙ্গের তৃতীয় দফার ভোটে কারচুপি ঠেকাতে ব্যর্থ, এই অভিযোগ তুলে নির্বাচন কমিশনের বিশেষ পর্যবেক্ষক সুধীরকুমার রাকেশের অপসারণ দাবি করল কংগ্রেস এবং সিপিএম। নির্বাচন কমিশনের বিশেষ পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় হতাশ বিজেপি-ও। আজ, শনিবার এ ব্যাপারে বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দিল্লিতে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের বক্তব্য জানাবেন।

রাকেশের বিরুদ্ধে রাজ্যের বিরোধী দলগুলি প্রতারণার অভিযোগ এনেছে। তাদের অভিযোগ, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোটের যে আশ্বাস বিশেষ পর্যবেক্ষক দিয়েছিলেন, তা তিনি রাখতে পারেননি। প্রতিশ্রুতি রাখতে তাঁকে ৩০ এপ্রিল সক্রিয় হতে দেখা যায়নি বলেই দাবি করেছে বিরোধী দলগুলি। সে দিন যে চার জেলায় ভোট হয়েছে, সেখানে পুলিশ পর্যবেক্ষক, নির্বাচন পর্যবেক্ষক কিংবা মাইক্রো-অবজার্ভারদের কোথাও চোখে পড়েনি। ভোটকেন্দ্রগুলিতে ছিল না ভিডিও ক্যামেরাও। এমনকী, বিরোধী দলের নেতারা তাঁর কাছে ভোটের দিন নানা অভিযোগ জানাতে গেলে ভাল করে খতিয়ে না দেখেই তিনি সে সব খারিজ করে দিয়েছেন বলেও অভিযোগ।

এর মধ্যেই রাকেশের রিপোর্টের ভিত্তিতে শুক্রবার কমিশন জানিয়ে দিয়েছে, রাজ্যে তৃতীয় দফার ভোটে কোনও বুথেই পুনর্নির্বাচন হবে না। এতে আরও ক্ষুব্ধ বিরোধী দলগুলি। রাজ্যের পরবর্তী দুই পর্যায়ের ভোটে রাকেশ বিশেষ পর্যবেক্ষক থাকলে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয় বলে দাবি সিপিএম এবং কংগ্রেসের।

রাকেশ নিজে এ দিন তমলুকে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ খারিজ করে দাবি করেছেন, তিনি নিয়ম মেনেই যা করার করেছেন।

কমিশন সূত্রেরও বক্তব্য, ৩০ এপ্রিল ভোটের পরে রাকেশ প্রথম দুই দফার মতোই বিভিন্ন পর্যবেক্ষকের কাছ থেকে রিপোর্ট নেন। উদাহরণ দিয়ে রাকেশ তাঁর ঘনিষ্ঠমহলে জানিয়েছেন, বর্ধমান-পূর্ব কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ নিয়ে যে ধরনের অভিযোগ উঠেছিল, তার সঙ্গে পর্যবেক্ষকদের পাঠানো রিপোর্টের মিল ছিল না। জনাসাতেক পর্যবেক্ষকের কাছ থেকে তিনি প্রায় ২০০ বুথের রিপোর্ট নেন। পর্যবেক্ষকেরা শান্তিপূর্ণ ভাবেই ভোট পর্ব মিটেছে বলে রাকেশকে জানান। বীরভূম, বোলপুর, আরামবাগ বা শ্রীরামপুর কেন্দ্রের অভিযোগের ব্যাপারে অবশ্য সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা যায়নি। তবে সব অভিযোগই ভিত্তিহীন বলে খারিজ করে দেওয়া হয়েছে।

বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বৃহস্পতিবারই রাকেশ এবং রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক (সিইও) সুনীলকুমার গুপ্তের অপসারণ দাবি করেছেন। বিমানবাবুর বক্তব্য, “তৃতীয় দফায় সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ বিশেষ পর্যবেক্ষক। এই ব্যক্তি কার্যত তৃণমূলের মুখপাত্রের মতো আচরণ করছেন!” ভোটের দিন রাকেশ তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন তো বটেই, পরের দিন মন্তব্য করেছেন, “বিরোধীরা এজেন্ট দিতে না পারলে আমি কি জোগাড় করে দেব?” এতে আরও প্রতিক্রিয়া হয়েছে বিরোধী শিবিরে। বিমানবাবুর কটাক্ষ, “এই ব্যক্তি পটনা যাওয়ার আগে ছিলেন বাঘ। পটনা থেকে ফিরে হয়ে গেলেন বেড়াল!” সরকারি সূত্রই জানাচ্ছে, রাকেশ দু’দিনের জন্য পটনায় বাড়ি গিয়েছিলেন। রাজ্যে তৃতীয় দফার ভোটের আগে রাকেশ বলেন, তাঁর কাছে সব অসুখের দাওয়াই আছে। সে প্রসঙ্গ টেনে এ দিন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীরও তির্যক মন্তব্য, “দেখা গেল, যে দিন দাওয়াই দেওয়া দরকার, সে দিন ডাক্তারবাবু নিজেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন!”

অধীরবাবুর অভিযোগ, তৃতীয় দফার ভোট চলাকালীন তাঁদের কোনও অভিযোগকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, “আমরা দাবি করছি, সুধীরকুমার রাকেশকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হোক।

ওঁর মতো লোক যেখানে দায়িত্বে থাকবেন, সেখানে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট নিয়ে আমাদের অনেক আশঙ্কা আছে।” কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্যেরও বক্তব্য, “আমরা রাকেশের উপরে আস্থা রাখতে পারছি না। তাই তাঁর অপসারণ দাবি করেছি।” সিপিএমের এস আর পিল্লাই, নীলোৎপল বসু এবং সিপিআইয়ের ডি রাজা এ দিন সন্ধ্যায় দিল্লিতে সম্পতের কাছে গিয়ে রাকেশের অপসারণের দাবি জানিয়েছেন।

তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য এমন অভিযোগ তোলার জন্য বিরোধীদের কটাক্ষ করে বলেছেন, “তাদের পাপ কাজের জন্য সিপিএম এবং কংগ্রেসই বরং এ রাজ্য থেকে চলে যাক!” পার্থবাবুর ব্যাখ্যা, “লক্ষ করলে দেখা যাবে, বামফ্রন্ট ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পরে যে ক’টা ভোট হয়েছে, তখন সিপিএম এবং কংগ্রেস কমিশনকে সমর্থন করেছে। আর ভোট মিটলেই কমিশনের বিরুদ্ধে কুৎসা করতে নেমেছে। গত পঞ্চায়েত ভোটের আগে রাজ্যের নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডের প্রশংসা করেছে বিরোধীরা। আবার ভোট-পর্ব চলাকালীন সমালোচনা করেছে!” বিরোধীদের বক্তব্যকে তাঁরা যে কোনও গুরুত্ব দিচ্ছেন না, তা জানিয়ে পার্থবাবু বলেন, “আসলে কমিশনকে জুজু বানিয়ে বিরোধীরা কাজ হাসিল করতে চেয়েছিল! পারেনি! তাই এখন বিশেষ পর্যবেক্ষকের অপসারণ দাবি করছে।” তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েনের মন্তব্য, “পরবর্তী ২৩টি আসনের ভোটই আমাদের এখন একমাত্র লক্ষ্য। বাকি সব তুচ্ছ!”

মার্চ মাসে রাজ্যে ভোট প্রক্রিয়া শুরু হতেই রাজ্যের বিরোধী দলগুলি সিইও সুনীলবাবুর বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তোলে। দিল্লি থেকে উপনির্বাচন কমিশনার বিনোদ জুৎসি কলকাতা এসে সুনীলবাবুকে আরও সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দেন। এর পরে ভি এস সম্পত কলকাতা সফর সেরে দিল্লি ফিরতেই রাজ্যের এক জেলাশাসক ও পাঁচ এসপি-কে বদলির নির্দেশ দেওয়া হয়। পাঠানো হয় এক ডজন পুলিশ পর্যবেক্ষককে। প্রথম দফা ভোটের আগে বিশেষ পর্যবেক্ষক হয়ে রাজ্যে আসেন রাকেশ।

রাকেশের উপরে রাজ্যের বিরোধী দলগুলি খড়্গহস্ত কেন? বিরোধীদের বক্তব্য, রাজ্যে আসার পরে রাকেশের নানা বিবৃতি এবং হাবভাব তাঁদের আস্থা ফিরিয়ে এনেছিল। অনুব্রত মণ্ডলের খাসতালুক বীরভূমে গিয়ে বিশেষ দাওয়াই দেওয়ার কথাও বলেন। কিন্তু তৃতীয় দফার ভোটে, তৃণমূলের দুর্গরক্ষার লড়াই শুরুর দিনেই তাঁদের আশাভঙ্গ হয়েছে।

অনেকে অবশ্য বলছেন, এ সবই বিরোধীদের চেনা কৌশল। বিরোধী থাকাকালীন মমতাও একই দাবি জানাতেন। তবে এ বারে বিরোধীরা ‘চক্রান্তের’ গন্ধ পাচ্ছেন। দমদম লোকসভা কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী অসীম দাশগুপ্ত এ দিন বলেছেন, “প্রথমে রাজ্যের শাসক দল কমিশনের বিরুদ্ধে প্রায় যুদ্ধ ঘোষণা করল। প্রথম দুই পর্বে কমিশনের ভূমিকাও মোটামুটি সন্তোষজনক ছিল। কিন্তু তৃতীয় পর্বে কমিশনের ভূমিকা বিস্ময়কর! তৃণমূলও তখন নীরব! এই বিস্ময়ের পিছনে কী রহস্য আছে, সেটা এখনও খোঁজ করতে পারিনি!” তৃণমূলেরও একটি সূত্রের খবর, তৃতীয় দফার ভোটের দিন সন্ধ্যা ৬টায় দলের তরফে সাংবাদিক সম্মেলনের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু পরে তা বাতিল হয়ে যায়। ‘কমিশন যা বলার বলবে’, এইটুকু বলেই ছেড়ে দেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। গোটা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে প্রশ্ন তুলে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারও এ দিন বলেছেন, “প্রথম দু’দফা ভোটে কমিশন যে ভূমিকা পালন করেছিল, তাতে বিরোধী দলগুলিও দু’হাত তুলে সমর্থন জানিয়েছিল। কিন্তু তৃতীয় দফায় তারা সেই ভূমিকা পালন করতে পারেনি।”

এত যে অভিযোগ এল, সে সম্পর্কে কমিশনের আধিকারিকরা কী বলছেন? সিইও-র দফতরের এক কর্তা জানাচ্ছেন, ৩০ এপ্রিল তাঁদের কাছে সরাসরি একশোরও বেশি অভিযোগ আসে। প্রতি ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ ছিল। ওই কর্তার দাবি, তাঁদের কাছে সরাসরি যে অভিযোগগুলি এসেছিল, তার ৩০-৩৫%-ই ভুয়ো বলে তাঁরা জানতে পারেন। কমিশনের কর্তাদের একাংশ বলছেন, সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট নিশ্চয়ই তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পর্যবেক্ষকদের রিপোর্টকে তাঁরা অস্বীকার করতে পারেন না।

কিন্তু যে ভাবে রাকেশ সে দিন প্রথমে বেদীভবন ছেড়ে বেরোননি, বিরোধীদের বসিয়ে রেখে কমিশনের দফতরে পৌঁছন দুপুর দু’টোয়, বহু বুথে ডিজিটাল ক্যামেরা বা মাইক্রো-অবর্জাভার কোনওটাই থাকেনি (দু’টোর মধ্যে একটা থাকার কথা), আবার ১৭ হাজারের বেশি বুথের মধ্যে মাত্র ৩২৪টিতে ওয়েবক্যাম থাকলেও ‘সার্ভার ডাউন’ বলে হঠাৎ সেগুলি কাজ বন্ধ করে দিয়েছে এই যাবতীয় উদাহরণ দেখিয়ে সিপিএম নেতা রবীন দেবের পাল্টা দাবি, “পর্যবেক্ষক এবং কমিশনের গোটা ভূমিকাই সন্দেহজনক ও রহস্যময়!”

এক বিরোধী নেতার মন্তব্য, সে দিন রাকেশ নিজে রাস্তায় নেমে ভোট প্রক্রিয়া পরিচালনা করলে এমন অভিযোগ হয়তো উঠত না। কিন্তু যে ভাবে ভোট শুরুর ৭ ঘণ্টা পরে নিজের দফতরে গিয়েই ভোটকে অবাধ ও স্বতঃস্ফূর্ত বলে অভিহিত করেছেন, তাতেই বিরোধীরা চক্রান্তের গন্ধ পাচ্ছে। তবে রাকেশকে সরানোর দাবি তুললেও বিরোধীরা মানছেন, রাকেশ এক জন আমলা মাত্র। যদি তৃতীয় দফার ভোটে কোনও ‘ষড়যন্ত্র’ হয়েও থাকে, একা রাকেশ তার জন্য দায়ী নন। ভোটের প্রতিটি মুহূর্তের দিকে নজর রাখার দায়িত্ব যাদের, পশ্চিমবঙ্গের ‘আসল’ দৃশ্য কী ভাবে সেই জাতীয় নির্বাচন কমিশনের নজর এড়িয়ে গেল, সেই প্রশ্নও তুলেছে বিরোধীরা।

বিজেপি কিন্তু বাকি বিরোধীদের মতো রাকেশের অপসারণ দাবি করেনি। দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, “আমরা পুরো বিষয়টি কমিশনের উপরে ছেড়ে দিচ্ছি।” বিজেপি সূত্রের ব্যাখ্যা, কংগ্রেস-সিপিএম-বিজেপি এক হয়েছে বলে নিয়মিত আক্রমণ শানাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। এখানেও বাম-কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপি-র সুর মিলে গেলে মমতার অভিযোগই মান্যতা পেয়ে যেতে পারত। তাই তারা সতর্ক হয়ে পা ফেলতে চাইছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

election in west bengal sudhirkumar rakesh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE