Advertisement
১৯ মে ২০২৪

নিজের কিডনি বেচেই পাচার চক্রের চাঁই

ছবির সাহেব ও বাস্তবের রাজকুমার। পঁয়ত্রিশ বছর আগের বাংলা ছবির সঙ্গে বাস্তবের কী অদ্ভুত মিল! আবার বেজায় গরমিলও! ছবিতে বেকার যুবক ‘সাহেব’, বোনের বিয়ের জন্য টাকা জোগাড় করতে নিজের একটি কিডনি বেচে দিয়েছিল।

রাজারহাট-বিষ্ণুপুর এলাকায় রাজকুমারের বাড়ি। ছবি: শৌভিক দে।

রাজারহাট-বিষ্ণুপুর এলাকায় রাজকুমারের বাড়ি। ছবি: শৌভিক দে।

প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৬ ০২:৫৮
Share: Save:

ছবির সাহেব ও বাস্তবের রাজকুমার। পঁয়ত্রিশ বছর আগের বাংলা ছবির সঙ্গে বাস্তবের কী অদ্ভুত মিল! আবার বেজায় গরমিলও!

ছবিতে বেকার যুবক ‘সাহেব’, বোনের বিয়ের জন্য টাকা জোগাড় করতে নিজের একটি কিডনি বেচে দিয়েছিল। বাস্তবের রাজকুমারও ৭৫ হাজার টাকায় নিজের কিডনি বিক্রি করে দিয়েছিল অভাবে পড়ে।

তবে মিল ওই পর্যন্তই। ছবিতে সাহেবের কিডনি বেচার খবর পাওয়ার পর গোটা পরিবার তাকে সম্মান জানায়। যদিও তার ফুটবলার জীবনের ইতি হয় সেখানেই। আর কিডনি বিক্রি করার পরই রাজকুমারের মাথায় ঢোকে, এই ব্যবসায় এক বার ঢুকে পড়তে পারলে প্রচুর মুনাফা।
যাত্রা শুরু করে অপরাধের জগতে। হয়ে ওঠে আন্তঃরাজ্য কিডনি পাচার চক্রের চাঁই। মঙ্গলবার রাজারহাটে দিল্লি পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পরে সেই কাহিনি কবুল করেছে রাজকুমার।

জেরায় রাজকুমার পুলিশকে জানিয়েছে, কী ভাবে গোটা চক্রটি চলে, সেটা বুঝে নিয়ে সরাসরি এর প্রধান কারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সে। কালেদিনে নিজেই হয়ে ওঠে চক্রের পাণ্ডা। কলকাতা, দিল্লি, জালন্ধর, কোয়ম্বত্তূর, হায়দরাবাদের মতো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তো বটেই, যার জাল ছড়িয়ে নেপাল-শ্রীলঙ্কা-ইন্দোনেশিয়ার মতো পড়শি দেশেও।

তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, গোড়ায় দক্ষিণ ভারতে এ কাজে ভিড়লেও বছর তিনেক আগে সে রাজারহাটের খামার শিবতলা তল্লাটে বসবাস শুরু করে। দিল্লি পুলিশ কলকাতার উত্তর প্রান্তে রাজকুমারের ঘাঁটি গাড়ার কথা কিছু দিনের মধ্যেই জানতে পেরেছিল। তার খোঁজে বছর খানেক আগে দিল্লি পুলিশ এক বার হানাও দেয় বাগুইআটিতে। সে বার তাদের খালি হাতে ফিরতে হয়। স্থানীয় পুলিশ সূত্রের খবর, সম্ভবত সে যাত্রা রাজকুমারের বাড়িটি চিহ্নিত করতে পারেনি দিল্লি পুলিশ।

রাজারহাটের খামার শিবতলা তল্লাটে ছোট ছোট কারখানাকে ঘিরে জনবসতি। মূলত নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের বাস। এলাকাটি রাজারহাট-বিষ্ণুপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন। মঙ্গলবার রাতে হানা দেওয়া পুলিশের দল ওই প্রত্যন্ত তল্লাটে ‘সেভেন হিলস’ নামে এক অট্টালিকা দেখে অবাক হয়ে যান। সরু গলির তস্য গলিতে ঝকঝকে গোলাপি রংয়ের দোতলা বাড়ি। আশপাশের ছোট ঘরবাড়ির তুলনায় বেখাপ্পা। প্রতিবেশীদের মতে, এলাকায় প্রায় কোটি টাকার ‘রাজত্ব’ বানিয়েছে রাজকুমার। বছর তিনেক আগে প্রথম সেখানে একটি একতলা বাড়ি কিনে বসবাস শুরু করে রাজকুমার ও নয়ন রাও। রাজকুমার জানায়, নয়ন তার স্ত্রী। তাদের ৭ বছরের একটি ছেলের সন্ধানও পেয়েছে পুলিশ। তবে নয়ন সত্যিই রাজকুমারের বৈধ স্ত্রী নাকি পাচার চক্রের সদস্য, সে ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত নন তদন্তকারীরা।

বুধবার এলাকায় গিয়ে জানা য়ায়, রাজকুমার পাড়ায় জানিয়েছিল, তাদের স্যালাইনের ব্যবসা আছে হায়দরাবাদে। তবে প্রতিবেশীদের সঙ্গে খুব একটা মেলামেশা করত না তারা। রাজকুমার অধিকাংশ সময় বাইরেই থাকত। তবে নিম্নবিত্ত পাড়ায় ধূমকেতুর গতিতে একটি পরিবারের শ্রীবৃদ্ধি হতে দেখে পড়শিদের মধ্যে কানাঘুষো, ফিসফাস শুরু হয়। এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘কত টাকা থাকলে কেউ একটি একতলা বাড়ি কেনার তিন বছরের মধ্যে একটি দোতলা বাড়ি ও তার পাশে জমি কিনতে পারে!’’

ছবির সাহেবের আত্মত্যাগ সামনে এসেছিল তার বোনের বিয়েকে ঘিরে। রাজকুমারের কিডনি আত্মসাতের কাহিনি ফাঁসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তার ‘বিবাহবার্ষিকী’র অনুষ্ঠান। প্রতিবেশী মালা মুখোপাধ্যায় জানান, মঙ্গলবার ছিল রাজকুমার-নয়নের বিবাহবার্ষিকী। এলাকার শ’দেড়েক মানুষ নিমন্ত্রিত ছিলেন। সেই সূত্রেই প্রতিবেশীরা ওই বাড়িতে ঢোকার সুযোগ পান। অন্দরের সাজসজ্জা দেখে হাঁ হয়ে যান অনেকেই। রাজকুমার তাঁদের জানান, রং আর সাজসজ্জায় ৩০ লক্ষ টাকা লেগেছে। বিবাহবার্ষিকীর ওই অনুষ্ঠানের মধ্যেই রাজারহাট থানার পুলিশকে নিয়ে দিল্লির সরিতা বিহার থানার পুলিশ হানা দেয় ‘সেভেন হিলস’-এ।

প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, নয়ন ঝরঝরে বাংলা বলেন। নিজেকে টালিগঞ্জের মেয়ে বলে দাবি করেন। পুলিশের ধারণা তাঁরই পরিচিত কেউ বাগুইআটিতে থাকেন। যাঁর মাধ্যমে রাজারহাটের খামার শিবতলা এলাকায় ঘাঁটি গেড়েছিল রাজকুমার।

রাজকুমারের বাবা ভেঙ্কট রাও প্রাক্তন ব্যাঙ্ককর্মী। স্ত্রী রাম বাঈ ও বড় দুই ছেলেকে নিয়ে থাকেন খড়্গপুরের মালঞ্চতে। সে বাড়ির নামও ‘সেভেন হিলস’। তবে রং সবুজ। রাজকুমারের মা জানালেন, ছোট ছেলে বছর সাতেক আগে খড়্গপুরের এই বাড়ি ছেড়েছে। তখন জানিয়েছিল, হায়দরাবাদে একটি সংস্থায় কাজ পেয়েছে।

ধৃত আরও ১

কিডনি পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ভানু প্রতাপ নামে আরও এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করল পুলিশ। বুধবার কানপুর থেকে তাঁকে ধরা হয়। ভানু প্রতাপকে নিয়ে এই ঘটনায় মোট ১০ জনকে গ্রেফতার করা হলো। মঙ্গলবারই রাজারহাট থেকে দিল্লি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে কিডনি পাচার চক্রের পান্ডা টি রাজকুমার রাও। গত সপ্তাহে এই কিডনি পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কানপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে উমেশ এবং নীলু নামের এক দম্পতিকে। গ্রেফতার করা হয়েছে মমতা ওরফে মৌমিতা নামে এক মহিলাকেও। উমেশ ও নীলু পুলিশকে জানিয়েছে, তাঁরা যথাক্রমে ৪ লাখ ও ৩ লাখ টাকায় কিডনি বিক্রি করেছেন। তাঁদের ছেলেদের চিকিৎসার জন্য টাকার দরকার ছিল।

আরও পডুন

অ্যাপেনডিক্সের যন্ত্রণা বলে কিডনি কেটে সাফ

খড়্গপুরেও রাজকুমারের বাড়ি ‘সেভেন হিলস্’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kidney Trafficing
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE