Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

পর্দার প্রতিবাদীর পরিবর্তনে রিঙ্কুরা হতাশ

সিনেমায় যেমন হয়... কথাটা এ বার বলা যাচ্ছে না। কেননা সিনেমার সঙ্গে বাস্তব যে মিলছেই না! ফিল্মি চরিত্র বন্দি থাকছে চিত্রনাট্যেই। কারণ রক্তমাংসের জগতে যাঁকে দেখা গেল, তিনি অন্য মানুষ। রুপোলি পর্দার তাপস পাল ছিলেন মূর্তিমান প্রতিবাদী। খুন ও ধর্ষণের প্রতিবাদে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও মাঠে নেমেছেন। বাস্তবেও মাঠে নেমেছেন তাপস পাল। কিন্তু নদিয়ার চৌমুহা গ্রামে তাঁর গর্জনের বহুল আলোচিত ফুটেজ দেখার পরে চলচ্চিত্রের তাপসের সঙ্গে তাঁকে মেলাতে পারছেন না নায়কের ভক্তেরাই।

‘আটটা আটের বনগাঁ লোকাল’ ছবির দৃশ্য

‘আটটা আটের বনগাঁ লোকাল’ ছবির দৃশ্য

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৪ ০৩:২৮
Share: Save:

সিনেমায় যেমন হয়... কথাটা এ বার বলা যাচ্ছে না। কেননা সিনেমার সঙ্গে বাস্তব যে মিলছেই না!

ফিল্মি চরিত্র বন্দি থাকছে চিত্রনাট্যেই। কারণ রক্তমাংসের জগতে যাঁকে দেখা গেল, তিনি অন্য মানুষ।

রুপোলি পর্দার তাপস পাল ছিলেন মূর্তিমান প্রতিবাদী। খুন ও ধর্ষণের প্রতিবাদে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও মাঠে নেমেছেন।

বাস্তবেও মাঠে নেমেছেন তাপস পাল। কিন্তু নদিয়ার চৌমুহা গ্রামে তাঁর গর্জনের বহুল আলোচিত ফুটেজ দেখার পরে চলচ্চিত্রের তাপসের সঙ্গে তাঁকে মেলাতে পারছেন না নায়কের ভক্তেরাই। এমনকী যাঁদের জীবনের সত্যি ঘটনার ভিত্তিতে ছবিতে তাঁর অভিনয়, তাঁরাও নেতা তাপসের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছেন খলনায়কের ছায়া।

মঙ্গলবার বিকেলে বারাসত আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে সে-কথাটাই বললেন রিঙ্কু দাস। ২০১১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বারাসত স্টেশনের কাছে রিঙ্কুর সম্ভ্রম বাঁচাতে গিয়েই দুষ্কৃতীদের হাতে খুন হন তাঁর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ভাই রাজীব। ‘আটটা আটের বনগাঁ লোকাল’ ছবিটি সেই ঘটনা নিয়েই। আর তাতে প্রতিবাদী চরিত্রের ভূমিকায় তাপস পাল। সেলুলয়েডের সেই তাপসকে দেখে কান্না চাপতে পারেননি রিঙ্কু। এ দিন তাপস-প্রসঙ্গ উঠতেই তাঁর মুখে ম্লান হাসির রেখা। রিঙ্কুর কথায়, “এটা উনি কী বললেন, বলুন তো! নেতা হয়ে যদি উনি রেপ করব, গুলি করব এ-সব বলেন, তা হলে তাঁর অনুগামীরা কী করবে? আমার ভাইয়ের হত্যাকারীরাই তো প্রশ্রয় পাবে! তা-ই নয় কী?”

রাজীব-হত্যা মামলার বিচার এখনও চলছে বারাসত আদালতে। সেই উপলক্ষেই এ দিন সেখানে গিয়েছিলেন রিঙ্কু। নিজের ভাইয়ের হত্যাকাণ্ড নিয়ে সিনেমা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সিনেমাটা দেখতে দেখতে খুব কেঁদেছিলাম। ভাবছিলাম, তাপস পালের মতো কেউ যদি আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসত।” একটু থেমে রিঙ্কুর সংযোজন, “ধুর, সবই অভিনয়! বাস্তবটা একেবারে অন্য রকম। এখন বুঝতে পারছি!”

‘আটটা আটের বনগাঁ লোকাল’ মুক্তি পেয়েছিল ২০১২ সালে। তাতে তাপস অভিনীত চরিত্রটির নাম অনন্ত দাস। ট্রেনের ছাপোষা গেরস্ত অফিসযাত্রী অনন্তই এক দিন ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ান। তাপসের অভিনয় দেখে রিঙ্কু বলেছিলেন, “এক বারও মনে হয়নি, উনি অভিনয় করছেন। চরিত্রটা যেন ওঁর ভিতরের মানুষ!” নন্দনে ছবিটির প্রিমিয়ারে তাপসও বলেছিলেন, এটা নিছক অভিনয় নয়। রাজীব আর তাঁর দিদির জন্য যন্ত্রণার প্রকাশ।

নদিয়ার গ্রামে এ বার কিন্তু দেখা গিয়েছে সাংসদ-অভিনেতা তাপস পালের পরিবর্তন! যিনি দেশের আইন ব্যবস্থার তোয়াক্কা না-করে অক্লেশে খুনখারাপি, ধর্ষণে প্ররোচনা দিচ্ছেন। সিনেমার অনন্ত বাবাকে বলেছিলেন, “খুনের ঘটনা ঘটছে। রাস্তাঘাটে মেয়েদের উপরে অত্যাচার হচ্ছে। আমার মেয়েটাও তো বড় হচ্ছে বাবা। এ-সবের কেউ প্রতিবাদ করবে না?” সেই সংলাপ ছিল ক্যামেরার সামনেই।

আবার ক্যামেরারই ফুটেজে দেখা গিয়েছে, মেয়েদের বিরুদ্ধে জঘন্যতম অপরাধে দলের ছেলেদের কার্যত উদ্বুদ্ধ করছেন বাস্তবের তাপস পাল!

চলচ্চিত্র-বিশারদদের একটি অংশ রুপোলি পর্দায় বাস্তবের একক বা সমষ্টিগত মানুষের স্বপ্নপূরণ দেখানোর পক্ষে। অন্য এক দল সিনেমা-বিশেষজ্ঞ চলচ্চিত্রকে লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবে দেখতে ভালবাসেন। দু’পক্ষের কাছেই বাস্তব আর সিনেমা পরস্পরের সহযোগী, পরস্পরের পরিপূরকও। কিন্তু সিনেমার লড়াকু তাপস আর বাস্তবের খলনায়ক তাপস কোথাও মিলছেন না। তাপসের এই আচরণ সামগ্রিক ভাবে সমাজে কুপ্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন সিনেমায় তাঁর কোনও কোনও সহকর্মীও। যেমন ‘আটটা আটের বনগাঁ লোকাল’ ছবিতে রাজীবের খুনির ভূমিকায় অভিনেতা, গায়ক শমীক সিংহ। তাঁর মতে, তাপসের আচরণে খুব খারাপ বার্তা গিয়েছে। তাঁর প্রশ্ন, “এই তাপস পালকে দেখে কি আদৌ ভয় পাবে ধর্ষক-খুনেরা?”

পুরোপুরি একসুর অভিনেত্রী সোনালী চক্রবর্তী। ছবিতে রিঙ্কুর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তিনি। সোনালীর কথায়, “খুব খারাপ লাগছে। ওঁর (তাপস) মুখ থেকে যে-সব শব্দ বেরিয়েছে, তার দায়ভার ওঁকেই নিতে হবে।” ওই ছবির পরিচালক দেবাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য মনে করেন, বিশেষ পরিস্থিতিতে, উত্তেজনার শিকার হয়ে তাপস এমনটা বলে ফেলেছেন। দেবাদিত্যের কথায়, “এই মন্তব্য আমি সমর্থন করি না। ব্যক্তিগত ভাবে যে-তাপস পালকে চিনি-জানি, তিনি এমন মানুষই নন। তাই অবাক হয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে, উনি কোনও রাজনৈতিক পরিস্থিতির চাপে পড়ে এমন সব কথা বলে ফেলেছেন।”

ছবির শেষ দৃশ্যে অনন্তের সংলাপ ছিল, ‘মানুষ আর মানুষ থাকছে না। বুনো জন্তুর মতো হয়ে উঠছে। কেউ কেউ আবার গুন্ডা-মাফিয়া হয়ে টিভির পর্দায় হাত নাড়ছে।’

নদিয়ার গ্রামে নেতা তাপসের ফুটেজ দেখার পরে অনেকেরই প্রশ্ন, ওই কথাগুলো কি বাস্তবের তাপসকেই নিশানা করছে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE